May 15, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নারীর মানসিক বিকাশই মুক্তির উপায়

তৌকির ইসলাম ।। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশীয় সমাজ ব্যবস্থায় নারীর অবদমিত অবস্থার অনেকগুলো কারণের একটি বড় কারণ হচ্ছে নারীর মানসিক অবস্থা। একজন নারী জন্মের পর থেকেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা নারীর মন ও মানসিকতার কোনো বিকাশ ঘটতে দেয় না। যারা নিজের ইচ্ছায় অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে চান, তারা হয় পরিবার না হয় তথাকথিত সমাজের নিয়ম কানুনে আটকে যান। আর সকল কিছুর উপরে উঠে যেসব নারী সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখে তারা বিষ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তার তন্ত্র-মন্ত্র পরিবারেও রোপণ করে ফেলে সুতরাং এই উপমহাদেশীয় পরিবার ব্যবস্থায় অধিকাংশ নারীর জন্ম একজন পুরুষের মতো আনন্দের হয় না। শিশুকাল থেকেই নারীকে বোঝানো হতে থাকে যে সে নারী, সে দুর্বল। তার বাইরে যাওয়া মানা, বেশি হাসা মানা, ভালো খাবার খেতে চাওয়া মানা, উচ্চশিক্ষা মানা, স্বামীর অথবা পার্টনারের কথার অমতে যাওয়া মানা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যাতাকলে পড়ে নারীর মানসিক বিকাশ তো ঘটেই না বরং নারী নিজেই কখন পুরুষতান্ত্রিকতাকে সমর্থন করা শুরু করে তা সে নিজেও বুঝতে পারে না।

আসলে নারীর মুক্তি লুকিয়ে আছে নারীর মানসিক বিকাশে কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর মানসিক বিকাশকে, নারীর উন্নয়নকে ভয় পায়। একটা বাস্তব উদাহরণ দেই। বাংলাদেশে গুটি কয়েকজন নারী রাইডার আজকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কম-বেশি সমাদৃত হচ্ছেন। কিন্তু মোট রাইডারের অর্ধেক যদি নারী হতেন তাহলে পুরুষ রাইডাররাই তা মানতে পারতেন না। বরং তখন অভিযোগ তুলে দিতেন যে মানুষ নারী রাইডারদেরকে বেশি পছন্দ করেন কারণ মানুষ নারী থাকতে পুরুষের পিছনে বসে যাবে কেন! পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ও মনোভাব একটা ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতাকে কীভাবে একটি অসুস্থ যৌনবিকৃত চিন্তায় পরিণত করে এটি হচ্ছে তার উদাহরণ। এরকম মন্তব্য হজম করার মত মানসিক শক্তি এখনো আমাদের নারীদের মাঝে পরিবার কিংবা সমাজ গড়ে তুলতে পারে নি। ফলে রাইডার ঐ গুটি কয়েকই।

ঠিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীর মানসিক উন্নতিকে সমাজ ও পরিবার বাধা দিয়ে যায়। যারা সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে চায়, তারা অনেক কিছুই স্যাক্রিফাইস করেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা আবার এই স্যাক্রিফাইসকে ভালোভাবে নিতে পারে না। আসলে নারীর মানসিক উন্নয়নে যে বাধা তার পেছনে দায়ী রাষ্ট্র, সমাজ এবং পরিবার। রাষ্ট্র ও সমাজ নারীর ক্ষমতায়নের নামে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবকে পুষে যায়। রাষ্ট্র কিংবা সমাজের অনেক উঁচু পদে থাকা নারী নিজেই অনেক ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক। পরিবার না পারে সমাজের বাইরে যেতে না পারে নারীর পক্ষ নিতে। তাই নারীকেই হতে হয় বলি। আর নারীকে শেখানো হয় তার এই বলি হওয়াই হচ্ছে তার মাহাত্ম্য।

নারীর মানসিক উন্নয়নের জন্য সকলের আগে পরিবারের এগিয়ে আসা উচিত। ছেলে ও মেয়েতে পার্থক্য না করে দুইজনকে সমানভাবে বড় করা উচিত। এতে মেয়ে হীনমন্যতায় ভুগবে না আর ছেলে নিজেকে মানুষ না ভেবে পুরুষ ভাবা শুরু করবে না। পরিবার যখন নারীর মানসিক উন্নয়ন ঘটাতে পারে, নারী তখন নিজেই সমাজের সাথে লড়াই করে যাওয়ার সাহস পায়। এতেই নারীর মানসিক বিকাশ সাধিত হয়। আর যেসব নারী পরিবারেরও সমর্থন পান না তাদের মধ্যে খুব কমই পারেন নিজের সাথে, সমাজের সাথে লড়াই করে নিজের মানসিক অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে।

নারীর মানসিক উন্নয়নে শিক্ষাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিন্তু উপমহাদেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থাও ক্ষেত্র বিশেষ পুরুষতান্ত্রিক। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় নারীর পক্ষে থিওরি পড়া ছাড়া খুব কমই হাতে কলমে শেখার সুযোগ আছে। কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের কাজকে আলাদা করে দেওয়াও নারীর মানসিক বিকাশে বাধা। সমাজ এখনো কোনো প্রযুক্তিগত কাজে নারীকে মেনে নিতে পারে নি। একজন নারী এসে আপনার ফ্রিজ অথবা কিচেনের পানির কল ঠিক করছে তা মানার জন্য সমাজ এখনো অপ্রস্তুত, পরিবারও প্রস্তুত নয়।

আসলে নারীর মানসিক বিকাশ শুধুমাত্র নারীর নিজের মানসিক অবস্থানের উন্নতি ঘটলেই হবে, তা নয়, বরং পুরো সমাজ, পরিবার এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার নারীর মানসিক উন্নয়ন ঘটানোর জন্য। নারীর মানসিক বিকাশ ঘটলে পুরো মনুষ্য সমাজের মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে।

অনেক সময় মনে হয় লিঙ্গ বা জেন্ডার এই অধ্যায়টুকু পৃথিবীর সকল গ্রামার থেকে তুলে দেওয়া উচিত। বিশেষ কিছু যেমন মা-বাবা, ভাইবোন ইত্যাদি বাদে মানুষের পরিচয় হওয়া দরকার মানুষ দিয়ে, হি অথবা শি দিয়ে নয়। তবেই না মানুষের চিন্তা ধারায় পরিবর্তন আসবে। নারীর মানসিক বিকাশ ঘটবে, তবেই পুরুষের মানসিক উন্নতি ঘটবে।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *