May 15, 2024
ফিচার ১মুক্তমত

ভিডিও ছেড়ে দিলে মেয়েরা কেন আত্মহত্যা করবে?

প্রিয়া দেব ।। ইদানীং আমাদের চারপাশে বহু নতুন নতুন আলোচনার ভিড়ে কয়েকটা ক্ষুদ্র ঘটনা চাপা পড়ে গেছে খুব সযত্নে। আমাদের সিনেমা কান উৎসবে চলে গেছে, আমাদের দেশের ছোট ছোট বাচ্চারা তাদের বয়সী বাচ্চাদের বিলাসিতার খাদ্য বানাতে গিয়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, পরীমণিকে নিয়ে নোংরামো করতে করতে আমাদের আশপাশের মানুষেরা ক্লান্ত হয়ে গেছেন এবং আমাদের একজন নেতা ত্রাণ দিতে গিয়ে ফ্রিতে গরীব মানুষের গায়ে হাত তুলে নিজের জাত চিনিয়েছেন।

ভালোই চলে যাচ্ছে আমাদের জীবন। কিন্তু এতো ঘটনার মধ্যে মিডিয়া একটা ঘটনাকে তেমন গুরুত্ব দিতে ভুলে গেছে অথবা গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। সেটা হলো একজন তরুনীর আত্মহত্যা, একজন তরুনীর তার প্রেমিকের সাথে অন্তরঙ্গ মূহুর্তের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে এবং অতি অবশ্যই সেটা ভাইরাল করেছেন মেয়েটির প্রেমিক নিজে, ভাইরাল করে দেওয়ার পর শুরু হয়েছে সেই ভিডিও নিয়ে হাসি তামাশা, মেয়েটিকে নিয়ে সেখানে বিচিত্র সব নোংরামো স্বাভাবিক নিয়মেই হচ্ছে। এবং সেসব সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছেন। আসল নোংরামো শুরু হয়েছে মেয়েটির মরে যাওয়ার পর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সকল অর্ধশিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিজেদের বিচিত্র সব মতামত দেওয়া শুরু করেছেন। তাদের মতামত কিছুটা এরকম – ‘‘যেহেতু মেয়েটা ভিডিওতে নিজের ইচ্ছায় কাপড় খুলেছে, মেয়েটা হাসি মুখে নানারকম পোজ দিয়েছে, যেহেতু মেয়েটার সম্মতিক্রমেই ভিডিও করা হয়েছে, সেহেতু মেয়েটার এমন পরিণতিই হওয়া উচিত।

ছেলেকে সাধারণ নিয়মেই কেউ কিছু বলছে না, কারণ পুুরুষ মানুষ এমনটা করবে সেটাই সবার কাছে স্বাভাবিক, ছেলেদের সাথে ওই মেয়ে ভিডিও করতে গেছে কী জন্য এরকম প্রশ্ন করে খুব সহজেই ছেলেদেরকে একটা সেইফ সাইডে রেখে মেয়েটিকে গালিগালাজ করা হচ্ছে। কিন্তু কারো মনে একবারো এই প্রশ্ন আসছে না যে, ওই ছেলেটা আর মেয়েটা উভয়ের সম্মতিতেই ভিডিওটা হয়েছে, যখন ভিডিও হয়েছে তখন দুজনের মধ্যে কেউই এই ভিডিও পাবলিক করার উদ্দেশ্যে করেন নি কিংবা ভবিষ্যতে করতে পারেন এমন কোনো চিন্তা করেন নি। তারপরও ওই ছেলেটি ওই মেয়ের সম্মতি ছাড়া ভিডিওটি ভাইরাল করেছে, এখানে অপরাধী হচ্ছে একমাত্র ওই ছেলে। এরপরও যখন সবাই মিলে “ছেলেরা তো এমন করবেই” বলে কথা এড়িয়ে যান তারা খুব সচেতনভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন ছেলেরা তো এরকমই করতেই পারে, যেহেতু সে পুরুষ, সেহেতু তার চরিত্রের এরকম নোংরা দিক ইগনোর করাই যায়। কিন্তু ব্যাপার সেটা না, ব্যাপার হচ্ছে এখানে ছেলেরা এরকম করবেই ভাবাটা মানেই হচ্ছে “সব ছেলেই অপরাধী” এই ধারণাকে বিশ্বাস করা। যদি আজকে আপনি এখানে সযত্নে আসল দোষীকে দোষী না মানেন, তবে আপনি সমাজের কাছে মেসেজ ছড়াচ্ছেন যে ছেলে মানেই তাকে বিশ্বাস করা যাবে না। এর সাথে সাথে সমাজ থেকে এই অপরাধকে সরানোর পথেও এই চিন্তাগুলো বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মনে করে নারীর কোনো শারীরিক চাহিদা থাকতে পারে না, নারী সাহস করে নিজের প্রেমিকের সাথে জীবনকে উপভোগ করতে পারে না। এ সমাজ তাদের সংজ্ঞায়নে সতী নারীকেই সমাজে চায়, যে নারী তাদের ফালতু সংজ্ঞায়নকে পায়ে মাড়িয়ে এগুতে চায় সে নারীকেই তারা কঠিন শিক্ষা দিতে চায়। আর এ কঠিন শিক্ষাটাই হচ্ছে ওই নারীকে সমাজের সামনে উলঙ্গ করে ছেড়ে দেওয়া, যেহেতু আমাদের সমাজ কোনো উলঙ্গ নারী মানেই জাত চলে যাওয়া! সে কারণে ওই সমাজ তখন সেই নারীকে প্রবল মানসিক চাপে রাখে, ওই নারীকে প্রতি পদে হেনস্তা করে, ওই মেয়ের পরিবারকেও আস্ত ছাড়ে না।

মেয়েটার দোষ কিন্তু একটাই, একবার সাহস করে নিজের প্রেমিককে ভরসা করা। এখন যদি পরস্পর সম্মতিক্রমে ইন্টিমেট হওয়া দোষ হয় তবে আজকে জাজমেন্টে বসা সমাজের প্রতিটা নারী-পুরুষের বাবা মাও সমান অপরাধে অপরাধী। এখন যদি বিবাহ নামক সার্টিফিকেটের কথা তোলা হয় তবে প্রশ্ন আসে দুজন এডাল্টের বিবাহ ছাড়া মিলিত হওয়া আদতে অপরাধ কিনা। যদি এটা আইনে অপরাধ না হয় তবে সকল আলোচনার ওইখানেই ফুলস্টপ দিতে হবে। এখন যদি ধর্মীয় পয়েন্ট অব ভিউ কেউ টানে তবে আমি বলবো যাবতীয় ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, সারাদিন নায়িকাদের ছবি দেইখা নোংরা নোংরা কমেন্ট করা এবং সারারাত পর্ন দেখে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ধর্মীয় সবক দেওয়া জাতির কাছ থেকে আমি ধর্মীয় বয়ান শুনতে আগ্রহী না। আপনি অক্ষয় কুমারের ফিলহাল গানের স্ট্যাটাস দেবেন, মিয়া খলিফাকে ইনস্টাতে ফলো দেবেন, ডাবল মিনিং কথা ছাড়া আপনার তেমন ভালো লাগে না, আবার সিজনাল ধার্মিক সাইজা আপনি আসবেন একজন ভিকটিমকে ধর্ম শেখাতে! যতক্ষন পর্যন্ত নিজেদের মাথা থেকে ভিকটিম ব্লেমিংয়ের নতুন নতুন থিওরি আসা বন্ধ হচ্ছে না ততদিন নিজেকে সুস্থ মস্তিষ্কের মনে করবেন না।

কিছু নতুন নতুন প্রগতিশীল আছেন, যারা সব কিছু ঠিক রেখেই কথা বলেন কিন্তু শেষে এসে দুনিয়ার সকল মেয়েকে উপদেশ দেন, যাতে তারা কোনো পুরুষকে বিশ্বাস না করেন, নিজেদের প্রাইভেট ছবি কাউকে না দেন, ভিডিও না করেন, মানে দিনশেষে সচেতন হবে সেই মেয়ে নিজেই, যেন দোষটা একমাত্র মেয়ের। তারা কোনো পুরুষকে কখনো বলেন না যে পুরুষদেরকে নিজেকে শোধরাতে হবে, এইরকম কাজ পার্টনারের অনুমতি ছাড়া করাটা যে বড় রকমের অপরাধ সেটা তাদের বুঝতে হবে এবং অপরাধটার পেছনে যে দায় একমাত্র তাদের সেটাও তাদের বুঝতে হবে। মনে রাখতে হবে দিনশেষে ওই মেয়েকে সচেতন হতে বলা মানে আবারো মেয়েটাই দোষী ওইটা প্রমাণ করা, এই কাজটা ভুলেও করা যাবে না।

আমাদের এই সমাজটা এমনিতেই মেয়েদের জন্য জটিল, এটাকে দিন দিন আরো জটিল করার বহু রাস্তা দিন দিন আবিষ্কার হচ্ছে। এত কিছুর মধ্যেও মেয়েরা শত বাঁধা পেরিয়ে এগোনোর চেষ্টা করছে। আজকে এই সকল কারণে যখন কোনো মেয়েকে আমি মরতে দেখি তখন খুবই খারাপ লাগে। যেখানে একজন মানুষ নিজের দোষ না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র হিপোক্রেট কিছু মানুষের জন্য মরতে বাধ্য হয়। এইসব মরে যাওয়া মেয়েদের যে সকল প্রগতিশীলরা ভীতু কিংবা কাপুরুষ বলেন তাদেরকে দেখলেই আমার হাসি পায়। এই সমস্যার কোনো সমাধান বার করায় এনারা ভূমিকা রাখেন না, চারপাশের মানুষের মানসিকতা নিয়ে হাহাকার করেই উনারা দায়িত্ব শেষ মনে করেন। আবার তারাই ওইসব মেয়েদের স্ট্রাগলকে বিন্দুমাত্র অনুভব না করে মেয়েদের কাপুরুষ বলেন। আমি নিজে এরকম বহু মেয়ের সাথে কথা বলেছি, এদেরকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকা বেশিরভাগ পুরুষ এইসব মেয়েদেরকে সমাজের ভয় দেখান, পরিবারের ভয় দেখান। এই মেয়েরা কিন্তু নিজের নগ্নতার মুখোমুখি হতে ভয় পান না, তারা ভয় পান এই নগ্নতা প্রকাশ পেলে তাদেরকে সমাজ বাঁচতে দেবে না। আমি নিজেও বহু সস্তা স্টকারের মুখোমুখি হয়েছি, ইভটিজারের মুখোমুখি হয়েছি, তারা প্রেম প্রস্তাব দিয়েছেন, রাজি যখন হইনি তখন আমাকে সর্বোচ্চ প্রাথমিক ভয় দেখিয়েছেন আমার ফোন নাম্বার ভাইরাল করার কিংবা আমার ছবি এডিট করে নোংরামো করার। আমি ভয় পাইনি, এ সমাজের ভীষণরকম সস্তা কোয়ালিটির ভয়গুলো আমাকে কখনো কাবু করতে পারেনি।

আমি একলা বাঁচতে জানি, সাহস নিয়েই বাঁচতে জানি। হিপোক্রেট সমাজের হিপোক্রেট মানুষকে আমি নিজেও সম্মান দেই না, তাদের কাছে সম্মান আশাও করিনা। আমি জানি সবার পরিস্থিতি সমান হয় না, সবাই লড়াই করতে পারে না। আমি তবুও চাই এই মেয়েগুলো বাঁচুক। যাবতীয় নোংরামোকে পেছনে ফেলে তারা বাঁচতে শিখুক, তারা সাহস করুক। যদি এ জগতের সব হিপোক্রেট দিনশেষে এই মেয়েদের দোষ দেয়, তবুও এই মেয়েরা গলা উঁচিয়ে নিজেকে নিরপরাধ বলতে শিখুক। আমাদের হিপোক্রেট প্রগতিশীলরা কবে আসল দোষীকে দোষী বলতে শিখবেন আমি জানিনা, আমি তবুও আশা রাখি একদিন মা বোন রেখে উনারা নিজেদের বাপ ভাই আর ছেলেদের মানুষ হবার উপদেশ দেবেন। আজ না বদলাক কালকে এই নোংরা সমাজ বদলাবে। সমাজকে বদলাতে হবেই। আজকে একটা মেয়ে যার পরিচয় সে মানুষ, সেই মেয়েদেরকে এভাবে দিনের পর দিন মরতে দিতে যে সমাজ ভূমিকা রাখে সেই সমাজকে বদলাতে হবেই। আর এ বদলানোর জন্য আওয়াজ তোলা খুব জরুরি।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]