November 22, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

প্রসঙ্গ: বুয়েট শিক্ষার্থীর সাইবার হ্যারাসমেন্ট ও স্লাট শেমিং

শামস্ আবীরুজ্জামান সিয়াম।। প্রথমে ভেবেছিলাম আস্ত একখানা বিস্তারিত লেখা লিখব। পরে ভাবলাম এত বিস্তারিত বলার দরকার নেই, স্বল্প কথায় কাজ সেরে আপাদত কেটে পরি। আলোচনার বিষয় – বুয়েট অনলাইন হ্যারাসমেন্ট ইস্যু, গোপনীয়তা তথা প্রাইভেসি রক্ষা ও “ব্লক মারুন ভালো করুন” তত্ত্ব।

দেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নগ্ন ছবি পাঠানো, সাইবার হ্যারাসমেন্ট ঘটনাগুলো প্রতিদিন নেহয়েত কম ঘটে না, এবং ঘটা মাত্রই দেশে এক দল বুদ্ধিজীবী, এলিট শ্রেণির আগমন ঘটে যারা ভিক্টিম ব্লেমিং, উক্ত ঘটনার পেছনে নারীদের দোষ খুঁজে জাতিকে উদ্ধার না করলে তাদের বুদ্ধিজীবী তকমা অপূর্ণই থেকে যায়।

আরেকটু খুলে বলি। সম্প্রতি বুয়েটে ঘটে যাওয়া অনলাইন হ্যারাসমেন্টের ঘটনা, যেখানে একজন নারীকে বুয়েটের ছেলেরা ইনবক্সে নগ্ন ছবি পাঠায়, অশ্লীল ভিডিও ও ইমোজি সেন্ড করে হয়রানি করে, সেই ঘটনার স্ক্রিনশট অনলাইন মিডিয়ায় আপনার একটু আনাগোনা থাকলে এই লেখা পড়ার আগে ইতিমধ্যেই দেখা হয়ে গেছে।

যথারীতি আমাদের অনলাইন বুদ্ধিজীবীদের তখন আবির্ভাব ঘটেছে এবং হাস্যকরভাবে তারা উক্ত স্ক্রিনশট ভাইরাল হওয়ার ক্ষেত্রে প্রাইভেসি রক্ষা হলো না, কনসেন্ট ছাড়া একজনের ব্যক্তিগত আলাপের স্ক্রিনশট ভাইরাল অন্যায় এই আলাপটা চালিয়ে গেছেন।

এই যে আপনারা যারা প্রাইভেসি ভংগের আলাপ করে হৈ হৈ রব তুলে ভিক্টিমকে দোষ দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের কাছে আমার একটামাত্র প্রশ্ন, অনলাইনে নগ্ন ছবি, পুরুষদণ্ডের ভিডিও, কুরুচিপূর্ণ হয়রানিমূলক মেসেজ কি গোপনীয় রাখার বস্তু?

আবার এই কনসেন্ট এবং প্রাইভেসির বিস্তর চিন্তা করা মানুষেরা কয়েকদিন আগে যখন একজন তরুণীর তার প্রেমিকের সাথে অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ভিডিও ভাইরাল হয়, তখন তাকে ব্লেম করতে এবং নোংরা কমেন্ট করতে ব্যস্ত ছিলেন। ভিডিওটা দুইজনের সম্মতিতে হয়েছিল, কিন্তু ভাইরাল করেছিল সেই তরুণীর প্রেমিক এবং তা হয়েছিল তরুণীর কনসেন্ট ছাড়া। সেই ঘটনায় আবার তারা প্রাইভেসি এবং কনসেন্টের কথা না বলে ক্রমাগত তরুনীকে ভিক্টিম ব্লেম করে গেছেন, অথচ সেই তরুণী ভিডিও ধারণের জন্য সম্মতি দিয়েছিল, ভাইরালের জন্য নয় এই ব্যাপারটা নিয়ে আওয়াজটুকু না তুলে কত সহজে পাশ কাটিয়ে চলে আজ তারা প্রাইভেসি ভংগ হওয়ার কথা বলছেন। দুই ক্ষেত্রে একই কাজ কিন্তু হচ্ছে, তা হলো ভিক্টিম ব্লেমিং এবং দুই জায়গাতেই ভিক্টিম একজন নারী। যারা একজন নারীর অন্তরঙ্গ মুহুর্তের রেকর্ড করা ভিডিও ভাইরালের ক্ষেত্রে প্রাইভেসির আর কনসেন্টের কথা ভুলে নারীকেই দোষী সাব্যস্ত করেন তারাই বুয়েটের ঘটনায় হয়রানিমূলক নোংরা কথোপকথন, ছবি গোপনীয় রাখতে হৈ হৈ রব তোলেন! দেখুন একবার হিপোক্রেসিটা দেখুন!

আরকদল এলিট শ্রেণি “অনলাইনে হয়রানির পেছনে নারীর যথেষ্ঠ দায় আছে” আবেগবিশিষ্ট আলাপ দিতে শুরু করেন। যেহেতু যিনি ভিক্টিম তিনি ওই ছেলেকে তৎক্ষণাৎ ব্লক করেননি এবং আলাপ চালিয়ে গেছেন তাই হয়রানির শিকার হওয়া উনার প্রাপ্য। এরা মনে করে উনি ছেলেটার মেসেজে বিরক্ত হলে, উনি ইন্টারেস্টেড না থাকলে বিনা কথায় ব্লক করতেন। যেহেতু উনি ব্লক করেননি তার অর্থ ভিক্টিম নারী ছেলেটার ছ্যাচরামো উপভোগ করছেন, নোংরা মেসেজ করলেও ছেলেটি যে অ্যাটেনশন দেয় সেটা উনার ভালো লাগে। এবং তারা মনে করেন আপনি যদি বিরক্ত হন তাহলে আপনার উচিৎ ইমমিডিয়েটলি ব্লক করে দেওয়া, না দেওয়ার অর্থ আপনি ইন্টারেস্টেড।

যদিও ভিক্টিম বারবার ছেলেটা চুমুর ইমোজি এবং নগ্ন ছবি পাঠানোর পর যখন স্পষ্ট মেসেজ পাঠালেন “I’m not interested”, তাও একবার নয় দু’বার। তারপরও এই তাবৎ বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর কাছে কেন এই “না” করাটা পর্যাপ্ত মনে হলো না নিজের অবস্থান বোঝানোর জন্য সেটা আমার বোধগম্য নয়।

আসলে মূল বিষয়টা ব্লক না, মূল বিষয়টা হচ্ছে ইগনোর। এই সমাজের এই হিপোক্রেট বুদ্ধিজীবীদের সবচেয়ে বড় জ্বালা এই জায়গাতেই যে ওই নারী তাদের ইগনোর করলেন না কেন, উনি এই হয়রানির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে যাবেন কেন – ঠিক এই জায়গাতেই হিপোক্রেট এলিট সাজা মানুষদের মূল সমস্যা।

কারণ আপনি নারী, আপনি অপরাধের শিকার হলে মুখ বন্ধ করে ইগনোর করবেন, আপনার ফোন নাম্বারে কেউ বারবার আপনাকে কল করে জোরপূর্বক প্রেম নিবেদন করলে আপনি তাকে না শাসিয়ে ফোন নাম্বার চেঞ্জ করে ফেলবেন, আপনি কলেজে যাওয়ার সময় রাস্তায় বখাটে উত্যক্ত করলে রাস্তা পাল্টে অন্য রাস্তা দিয়ে চলে যাবেন, গায়ে হাত দিয়ে স্পর্শ করলে সহ্য করবেন। আপনি কেন নাম্বার না বদলে জিডি করতে যাবেন, আপনি কেন রাস্তা না বদলে উত্যক্ত করা বখাটেদের কষিয়ে চড় মারতে যাবেন, আপনি কেন আপনাকে স্পর্শ করার সময় বখাটের হাত ধরে ফেলবেন!

আপনাকে ইগনোর করতে হবে কারণ আপনি একজন নারী, আর আপনি যদি না করেন তাহলে দোষ আপনাকে দেওয়া হবে ঠিক যেমনি বুয়েটের ঘটনায় ব্লক না করার জন্য ভিক্টিমকে দোষ দেয়া হচ্ছে কিন্তু “না” বলার পর কেন জারিফ আবার নোংরা ভিডিও, অঙ্গভঙ্গি করে মেসেজ পাঠাবে এই প্রশ্ন করে আঙুল কেউ তুলবে না। উপরের প্রত্যেকটা ঘটনা এবং বুয়েটের ঘটনায় “ব্লক মারলেন না কেন” বলে ভিক্টিম ব্লেমিং একই সুরে বাধা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা আমাদের শেখায় একজন নারী সব অন্যায় সহ্য করে যাবেন, নিজের সাথে হওয়া সব অন্যায়, কটুক্তি, অযাচিত স্পর্শ ইগনোর করবেন, পিছু হটবেন এবং প্রতিবাদ করলেই ওই নারীরই সমস্যা, সেই নারীর চরিত্রে খুঁত আছে বলে ট্যাগানো হবে।

আজকের বুয়েটের ঘটনায় যদি ভিক্টিম এই কনভারসেশনের স্ক্রিনশটগুলো গ্রুপে দিয়ে ভাইরাল না করে বরং ব্লক মেরে বা আইডি ডিঅ্যাক্টিভ করে বসে রইতেন তাহলে এই নোংরা মানুষদের আসল রূপ সম্পর্কে তাদের আশেপাশের লোকেরা কখনোই জানতে পারত না। ব্লক খাওয়ার পর “মেয়ে মানুষ লজ্জা পেয়ে ব্লক দিয়েছে” বলে খিল্লি উড়িয়ে এই গ্রুপ আরেকজন নারীকে টার্গেট করত, আরেকজনের সাথে হয়রানিমূলক আচরণ করত। কিন্তু উনি ঘটনার শেষ দেখে ছেড়েছেন এবং এসএস ভাইরাল করায় অন্তত আশেপাশের মানুষজন এই অমানুষদের সম্পর্কে জানতে পেরেছে, আরেকজন ভিক্টিম হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে। অন্তত একই চিন্তা নিয়ে হাটাচলা করা বাকি মানুষজন এখন এই ধরনের মেসেজ পাঠানোর আগে, হয়রানি করার আগে একটু হলেও দশবার ভাববে।

হিপোক্রেটদের কথা বাদ দিয়ে সুন্দর দিকের কথা বললে বলতে হয় যে এই স্ক্রিনশট ভাইরাল হওয়ার পর সম্পূর্ণ ব্যাচ তাদেরই ব্যাচের অপরাধীদের বয়কট করেছে এবং ভিক্টিমের পরিচয় ফ্লাশ আউট করে বের করে দেয় নি। যেকোনো ঘটনায় নারী ভিক্টিম হলে সবচেয়ে বেশি তাকে স্লাট শেমিংয়ের শিকার হতে হয়, তার পোশাক-আশাক ফটো ভাইরাল করে জীবনযাপন, চালচলন নিয়ে হাজারটা নোংরা মন্তব্য শুনতে হয়, সেটা অন্তত ঘটেনি, বুয়েটের সিএসই-১৯ ব্যাচের অ্যাকাডেমিক প্রেস্টিজের বাইরে এসে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার জন্যই তা ঘটে নি, সিএসই ব্যাচের এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]