December 3, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

সবার উপর মানুষ সত্য কিংবা চন্দ্রনাথ বিষয়ে আমাদের অবস্থান

আরাফাত লিও তন্ময় ।। পৃথিবীতে একই সঙ্গে গীতা-কুরান-বাইবেল পাঠে অথবা প্রার্থনার সময় শাঁখ-ঘণ্টা-আযান দেয়া হলে ঈশ্বর-ভগবান যুদ্ধে লিপ্ত হয় না; এটা নিপাতনে সিদ্ধ। আপনি কখনও খবরে দেখবেন না, ঈশ্বর-ভগবানের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কেউ নিহত হয়েছেন।

কিংবা প্রার্থনার জন্য পবিত্র হতে গেলে স্নান বা ওযুর জন্য যে জল ব্যবহার করা হয় বিভক্তি নেই সেই জলেও। গঙ্গাস্নানে পবিত্র হওয়া সনাতন ধর্মালম্বী আর সেই গঙ্গাই যখন বাংলাদেশে প্রবাহিত হয় পদ্মা নামে- পদ্মার জলে ওযু করে নামাজ পড়তে যাওয়া মুসলমানের শরীরেও মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। আছে সুরতে, আচারে।

মাংস আর মাছ দুটোই খাবারের জিনিস কিন্তু দুটো একই সঙ্গে এক পাতিলে রান্না করে খাওয়া যায় না। রান্নার কিছু নিয়ম আছে। সেই নিয়ম মেনে রাঁধা সুষম খাদ্য শরীরের জন্য উপকারী। নতুবা যে খাবারে জীবন বাঁচে সেই খাবারই কেড়ে নেয় জীবন।

হিন্দু পুরাণ মতে চন্দ্রনাথ পাহাড় সনাতন ধর্মালম্বীর তীর্থস্থান। চন্দ্রনাথে কেবল তারাই যায় না। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী হাজারো মানুষ পর্যটক হিসেবে সেখানে যায়। তাতে হিন্দুরা বাঁধা দিয়েছেন এমন খবর কখনও শোনা যায়নি। চন্দ্রনাথ পাহাড় আল-আকসা নয় যেখানে মুসলমান-ইহুদি উভয় জাতিরই তীর্থস্থান। চন্দ্রনাথ পাহাড় কেবল হিন্দুদের তীর্থস্থান।

বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। তার আগে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেখুন, এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা বলে রাষ্ট্রকে ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবেন না দয়া করে। ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের কোনো সংঘাত নেই। একটা রাষ্ট্রই যদি না থাকে সেখানে আপনি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বলবেন কীভাবে? ধর্মনিরপেক্ষতার প্রাথমিক যে কাঠামো, সে অনুসারে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কোনো নাগরিককে ধর্মের বিচারে দেখবে না। কোনো নাগরিককে বাধ্য করবে না নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম পালনে। এবং কোনো অপরাধের বিচারও হবে না ধর্মের রীতিতে। একটি রাষ্ট্রের শতভাগ নাগরিক নির্দিষ্ট একটি ধর্মের অনুসারী নয়। রাষ্ট্র সকল নাগরিকেরই। সেই রাষ্ট্রে সকলের সমানাধিকার। সেই রাষ্ট্রে একজন ধর্মভীরুর নিরাপদ জীবন যাপনের যে অধিকার আছে, একই অধিকার থাকবে একজন ধর্মহীন নাগরিকেরও।

মুসলমানদের অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান মক্কা-মদিনা। আপনি ভাবতে পারেন, সেখানে গির্জা স্থাপনের জন্য প্রকাশ্যে কেউ আহ্বান দিচ্ছে কিংবা সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছে ঘণ্টা বাজিয়ে অথবা উলুধ্বনি দিয়ে?  তীর্থস্থানের মানে বুঝুন, চন্দ্রনাথ পাহাড়কে বায়তুল মোকাররমের সঙ্গে মেলাবেন না। বায়তুল মোকাররম বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ, কোনো তীর্থস্থান নয়। তাই আপনি দেখবেন একই শহরে আছে ঐতিহ্যবাহী ঢাকেশ্বরী মন্দির। কিন্তু আপনি মক্কা-মদিনায় সেরকম দেখতে পাবেন না। ধর্মানুসারী হিসেবে দেখার আশা করাও উচিত নয়।

পৃথিবী কেবল গুটি কয়েক ধর্মের নয়। আব্রাহামিক ধর্মগুলো (ইহুদি-খৃষ্টান-মুসলমান) ছাড়া আরও চার হাজারের বেশি ধর্ম আছে। এবং সেই সব ধর্মের অনুসারী লক্ষ লক্ষ মানুষ। কোনো ধর্মের অনুসারী কমছে, কোনো ধর্মের অনুসারী বাড়ছে। আবার কোনো কোনো ধর্ম বিলুপ্তির পথে আবার নতুন কোনো ধর্মবাদ প্রচার হচ্ছে। এখানে আপনার মনে রাখা প্রয়োজন, গবেষণা বলে- পৃথিবীর প্রতি ০৭ জন মানুষে ০১ একজন মানুষ ধর্মহীন বা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী। এসব তো ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব না। কোনো প্রকারেই কোনো মানুষের মনোজগতে সম্পূর্ণ প্রবেশ করা যায় না।

মনে রাখতে হবে যে, পৃথিবীতে কেবল মানুষ সত্য; দেখুন, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও বাংলাদেশ নামে স্বাধীন কোনো রাষ্ট্র ছিল না, যেমন ছিল না এর চব্বিশ বছর আগে পাকিস্তান নামের কোনো ভূখণ্ড। যেমনটা ছিল না দেড় হাজার বছর আগে ইসলাম নামের কোনো ধর্ম অথবা একুশশ’ বছর আগে খৃষ্টধর্ম।

পাল, সেন, মুঘল, ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ, নবাব সিরাজৌদ্দলা কিংবা ইংরেজদের শোষণ কোনোটাই স্থায়ী হয়নি। রাজা বদলেছে কেবল, প্রজা কিন্তু একই। এই ভারতীয় উপমহাদেশেরই মানুষ। তেমনই ক্ষণে ক্ষণে ঈশ্বর বদলাবেন কিন্তু তাঁর অনুসারী দলের মৌলিক কোনো পার্থক্য থাকবে না। এটাই চিরন্তন সত্য। পৃথিবীতে সুস্থভাবে বাঁচতে গেলে এগিয়ে আসতে হবে মানুষকেই। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঠেকিয়ে দিতে হবে সকল প্রকার ধর্মীয় আগ্রাসন। যেমনটা সম্ভব হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, অদূর অতীতে সশস্ত্র পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরিকল্পিত আগ্রাসন। তথাপি, অদৃশ্য ঈশ্বরের জন্য আমরা নিজেরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করতে পারি না নিশ্চয়?

চন্দ্রনাথ পাহাড় হিন্দুদের তীর্থস্থান কিংবা সকল মানুষের জন্য পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে ঠিকই আছে। সেটাকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় আগ্রাসন তৈরির পেছনে সুনির্দিষ্ট কী লক্ষ্য আছে সেই রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। ইতোমধ্যে, সেই দুষ্কৃতকারীকে গ্রেফতার করেছে দেশীয় গোয়েন্দারা। এটাকে পুঁজি করে ভবিষ্যতে যেন কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত না হয়- সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন।

সর্বোপরি, পৃথিবীটা মানুষের, সকল প্রকার বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে এখানে বাস করতে হবে মানুষকেই। মানুষ হয়ে মানুষের জীবন বিপন্ন না করে বরং শপথ করি চলুন- ধর্মের নামে যুদ্ধ করার থাকলে ঈশ্বর-ভগবান করুন; আমরা আর ও পথ মাড়াচ্ছি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *