February 23, 2025
সাহিত্যকবিতাফিচার ৩

আমাদের প্রভুদের মহানুভবতা

প্রিয়া দেব ।। 

আমাদের ছোট্ট নির্লিপ্ত শহরে আমরা যে যার মতো ভালো ছিলাম।

এখানে রোজ সকালে শুভ্র গোলাপের গায়ে নীল রঙয়ের প্রজাপতি আমরা দেখতে পেতাম, ছোট ছোট বালিকারা গান গাইতো, আমাদের অগ্রজ নারীরা কুয়াশার ভেতর আগুন জ্বালিয়ে বিগত বছরগুলোর ফসলের গন্ধ নিয়ে আলোচনা করতেন।

কোনো কোনো বিকেলে আমাদের মাতারা সদ্যজাত সন্তানের দাঁতবিহীন হাসি দেখে দ্বিধায় পড়ে যেতেন এটা খুঁজতে,

যে কোনটা শ্রেষ্ঠ?

স্বর্গ নাকি পৃথিবী।

তারপর একদিন আমাদের ছিমছাম শহরে প্রভুরা এলেন

তারা প্রভুত্ব কীভাবে প্রাপ্ত হলেন আমরা জানতাম না, আমরা শুধু জানতাম তারা প্রভু।

তারা তাদের প্রভুত্বের অহংকার ধীরে ধীরে আমাদের পিতাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন

কারণ হিসেবে তারা বললেন প্রভুত্বের গুণাবলী ধারণ করার ক্ষমতা মাতৃত্বের গুণ রাখা আমাদের মাতাদের নেই।

আমরা প্রভুগণের কথা মেনে নিলাম।

কারণ আমরা তাদেরকে বিনা প্রশ্নে সম্মান করতে শিখেছি

আর আমাদের আনুগত্যের তুলনা হয় না।

তারপর একদিন প্রভুরা আমাদের শহরের নারীদের নির্দেশ দিলেন আমাদের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর বলিদান দেওয়ার,

কারণ আমাদের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর প্রভুদের মহান চিন্তায় বিঘ্ন ঘটায়।

আমরা আমাদের কণ্ঠ প্রভুদের হাতে তুলে দিলাম।

এরপর রোজ ভোরবেলা শুভ্র গোলাপের গন্ধের চেয়ে বেশি তাজা রক্তের গন্ধ আমরা পেতে শুরু করলাম।

আমাদের সদ্য বড় হয়ে ওঠা বালিকাদের রক্তের গন্ধ।

তাদের মসৃন দুপা গড়িয়ে সেই রক্তের ধারা নেমে আসতো, তারা শুভ্র লাশ হয়ে রাজপথে পড়ে থাকতো

আমরা আমাদের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরের অভাবে তাদের জন্য কাঁদতে পারতাম না।

প্রভুরা আমাদের সান্তনা দিতেন

বলতেন বালিকারা তাদের কৃতকর্মের ফল পেয়েছে

আমরা সেই কৃতকর্ম সম্পর্কে জানতে চাইতাম না, কারণ প্রভুদের জ্ঞান প্রজ্ঞার প্রতি আমাদের সম্মান ছিল

আর জানেনই তো আমাদের আনুগত্যের তুলনা হয় না।

আমাদের বালিকারা এভাবে লাশ হয়ে যেতে লাগলো

বালিকাশূণ্য শহরে গোলাপের নীল প্রজাপতিরা ঘুরে বেড়াতো না আর

ধীরে ধীরে শহরে আমাদের মায়েরা ফসলের গল্প করা কমাতে লাগলেন

আমাদের পিতারা প্রভু হয়ে উঠতে লাগলেন

তারপর একদিন প্রভুরা আমাদের কাছে দৃষ্টি বলিদান চাইলেন

কারণ আমাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাদের প্রার্থনায় বিঘ্ন ঘটায়

আমরা বিনা প্রশ্নে দৃষ্টি দান করলাম।

তারপর ধীরে ধীরে আমাদের আমাদের শিশুকন্যারা স্তব্ধ হতে লাগলো, তারা কোথায় জানি হারিয়ে যেতে লাগলো, আমরা তাদের খুঁজে পেতাম না।

আমাদের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ছিল না।

আমরা শুধু শূণ্য চোখে তাদের খুঁজে বেড়াতাম।

প্রভুরা বললেন শিশুকন্যাদের অতিরিক্ত চপলতাই তাদেরকে এভাবে হারিয়ে যেতে বাধ্য করছে।

আমরা সেটা মেনে নিলাম

কারণ আমাদের আনুগত্যের তুলনা হয় না

কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমাদের হাহাকার থামলো না।

আমাদের কন্যাদের জন্য হাহাকার, আমাদের বড় হয়ে ওঠা বালিকাদের জন্য হাহাকার।

প্রভুরা সেসবে বিরক্ত হলেন।

তারা এবার আমাদের কাছে আমাদের সকল চিন্তাশক্তির বলিদান চাইলেন, কারণ আমরা তাদের বিরক্ত করছি বারবার।

হাহাকারে মগ্ন থাকা অপ্রয়োজনীয় চিন্তাশক্তি দিয়ে আমরা শুধুই বিশৃঙ্খলা ঘটাতে সক্ষম…..

এমনটাই তারা মনে করতেন

আমরা প্রভুদের সম্মান করতাম।

এক মেঘলা সকালে আমরা সমবেত হলাম নিজেদের চিন্তাশক্তির বলিদান করতে

আমাদের সামনে আমাদের মহান প্রভুরা দাঁড়িয়ে ছিলেন।

শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসছিল আমাদের মাথা

তারা বিরক্তি নিয়ে আমাদের দেখছিলেন

তখনি আমাদের মাঝে বেঁচে যাওয়া কিছু বালিকা চিৎকার করে বলে উঠলো

 “রাতের আঁধারে যে মুখোশ পরা প্রাণী আমাদের বালিকাদের, কন্যাদের টেনে নিয়ে যায়, তাদের মুখোশের আড়ালে থাকা মুখের সাথে আমাদের প্রভুদের মুখের অদ্ভুত মিল রয়েছে”

যদিও তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরের অভাবে সেটাকে ঠিক চিৎকার মনে হচ্ছিল না

আমাদের প্রভূরা বিচলিত হয়ে সেইসব বালিকাদের থামাতে বললেন, বললেন মিথ্যা বলার দৃষ্টতা দেখানোর কারণে তাদের যেন পুড়িয়ে মারা হয়।

আমরা তাদের থামিয়ে দিয়েছিলাম, কারণ আমরা প্রভুদের সম্মান করতাম।

যখন নিজেদের চিন্তাশক্তি বলিদান দিয়ে আমরা আমাদের বেঁচে যাওয়া বাকি কন্যাদের জ্যান্ত পোড়াচ্ছিলাম তখন তারা চুপচাপ জ্বলছিল

আমরা সেদিন প্রভুদের প্রতি একটু বেশিই কৃতজ্ঞ ছিলাম।

কারণ তারা যদি তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বরের বলিদান না চাইতেন তবে এই কন্যাদের চিৎকার আমাদের হৃদয় বিদীর্ণ করে দিতো

আমার মনে আছে, আমরা প্রভুদের মহানুভবতার কথা চিন্তা করে সেদিন অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম।

Leave a Reply