May 21, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

অশ্লীলতার কি কোনো মাপকাঠি আছে?

সামিয়াতুল সামি ।। ‘অশ্লীলতা’ শব্দটার মাত্রা ঠিক কতখানি হবে এই ব্যাপারটা সবসময়ই রিলেটিভ একটা কন্সার্ন। ঠিক কতটুকু জিনিসকে কেউ অশ্লীল বলতে পারে, কতটুকু সীমার ভেতরে কোনো ব্যাপারকে অশ্লীল বলা যাবে না এরকম কোনো মানদণ্ড ইউনিভার্সালি ঠিক করা হয়নি। এই মানদণ্ড পরিচালিত এবং স্থাপিত হয় মূলত ভিন্ন ভিন্ন আইডিওলজি দ্বারা। কারো আইডিওলজিতে যেটা অশ্লীল অন্য কারো আইডিওলজিতে সেটা অশ্লীল না – এ রকমটা ঘটা কোনোভাবেই অবাক করা ব্যাপার না।

কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রাচীন ভারতীয় মন্দিরগুলির ভাস্কর্যে অজস্র  মৈথুনরত মূর্তির আধিক্য আছে। আপনি যদি কখনও ভারতের পুরীতে গিয়ে থাকেন তাহলে সেখানে দেখবেন, পুরীর মন্দিরের খুব উঁচুতে কোনার্ক, ভুবনেশ্বর, খাজুরাহো প্রভৃতি মন্দিরের সর্বত্রই আছে যৌনক্রিয়ারত মানুষ এমনকি পশুর মূর্তি। ইন্দোনেশিয়ার সেলিবিস দ্বীপের পুরনো মন্দিরের চারপাশে পাওয়া যায় স্তন, যোনি, নগ্ন পুরুষদেহ আর পুরুষাঙ্গের অজস্র মূর্তি। ভ্যাটিকানসিটির রাস্তায় রাস্তায়ও ছড়িয়ে আছে যৌন আবেদনে আবেগঘন নগ্ন নারী পুরুষের মূর্তি।

নগ্নতা আর যৌনতা গায়ে গা ঠেকিয়ে আছে মাইকেল এঞ্জেলার ডেভিডে, রডিনের চুম্বনে, ভেনাসে কিংবা পিকাসোর বহু ছবিতে। বাংলা সাহিত্যের বহু আগের সৃষ্টি কালীদাসের কালজয়ী মেঘদূতেও ছড়িয়ে আছে যৌনতা। মেঘদূতের কথা যেহেতু বললামই, হোমারের ইলিয়ডের কথাও তাহলে উল্লেখ করতে হয়। এমনকি আরো বলতে হয় আধুনিক কালের লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, চেতন ভগত, ভারতের ‘জ্যাকি কলিনস’ খ্যাত শোভা দে’র কথাও। এদের লেখাতে যেভাবে যৌনতার ছড়াছড়ি আছে সেটা পড়ে আপনি হয়তো ভাববেন এরা প্রত্যেকেই অশ্লীল।

আবার এই সমস্ত লেখকের বিশ্বব্যাপী যে জনপ্রিয়তা – সমালোচক ও পাঠক উভয়ের কাছে এদের যে গ্রহণযোগ্যতা- কেউই এদেরকে অশ্লীল বলবে না। এখানেই ঘুরেফিরে সেই পুরনো প্রশ্নটা চলে আসে- অশ্লীলতার মাপকাঠি কী? প্রশ্নটা জটিল হলেও উত্তরটা খুবই সহজ – অশ্লীলতার ইউনিভার্সাল কোনো মাপকাঠি নেই। কোনো জিনিসে যৌনতার অন্তর্ভুক্তির চয়েজটা ঠিক ততটুকুই সাধারণ যতটা সাধারণ আপনি এক কাপ চায়ে কত চামচ চিনি খাবেন সেটার চয়েজটা।

এখন বলা যাক, এই যৌনতার পছন্দটা ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন মাপকাঠি চড়ে আসে তাহলে এই ব্যাপারটাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? উত্তর হল – কাউকে কোনোভাবে বিব্রত না করে। একজন আর্টিস্ট দেখা গেল নিজের দক্ষ তুলির আঁচড়ে কোনো নগ্ন দেহ আঁকলেন আর সেই ছবিটা আপনার কাছে অশ্লীল মনে হল। এই আপনার কাছে মনে হওয়া অশ্লীলতার জন্যে আপনি সেই আর্টিস্টকে ততক্ষণ অব্দি শূলে চড়াতে পারেন না, সেক্সুয়ালি পারভার্ট বলতে পারেন না যতক্ষণ অব্দি ঐ আর্টিস্ট তার আঁকা নগ্নদেহ আপনার ইনবক্সে গিয়ে জোরপূর্বক আপনাকে আপনার সম্মতি ছাড়া দেখাচ্ছে। যদি সেরকমটা উনি করেন, আপনি তাকে শূলে চড়াতে পারেন, কিন্তু যদি তিনি নিজের প্রোফাইলেই তা শেয়ার করেন তাহলে আপনি দেখবেন কি দেখবেন না সেটা একান্তই আপনার পারসোনাল চয়েজ। মন চাইলে দেখবেন, না চাইলে দেখবেন না – কিন্তু আপনি দেখার পর ট্রিগার্ড হলে সেই আর্টিস্টের কোনো দায় নেই।

সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই একই ব্যাপার ঘটে। যৌনতায় ভরপুর কোনো বই আপনি পড়বেন নাকি পড়বেন না সেটা একান্তই আপনার ব্যাক্তিগত ইচ্ছা। কিন্তু সেই বই পড়ে যদি আপনি মনে করেন এটা অশ্লীল তাতে সেই লেখকের কোনো রকম দায় নেই। দায় তখনই থাকত যখন সেই লেখক আপনাকে সেটা পড়তে জোর করত। কিন্তু দোকানে রাখা বই নিজে গিয়ে কিনে দেখে এসে তাকে অশ্লীল আর পারভার্ট তকমা দিলে বুঝতে হবে আপনার ভেতরেই সমস্যা আছে।

এই ব্যাপারটাই ঘটে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে। কোনটুকু অশ্লীল আর কোনটুকু শ্লীল সেটা নির্ধারণের দায়ভার যেমন আপনার, তেমনি সেটা দেখবেন নাকি দেখবেন না সেই দায়ভারও আপনার। আপনাকে যদি কোনোভাবে সেটা দেখতে জোর করা হয়, সেটা আপনাকে দেখাতে যদি আপনার কন্সেন্ট না মানা হয় কেবলমাত্র তাহলেই আপনি কাউকে কুচুরিপূর্ণ কিছু ট্যাগ দিতে পারেন, নতুবা নয়।

এই ভিন্ন ব্যক্তি বিশেষে অশ্লীলতার প্যারামিটারে শোভা দে’র একটা উক্তি শোনা যাক। শোভা দে বলেন, “আমার উপন্যাসে যৌনতার বিষয়টি অবারিতভাবেই উপস্থিত। আমার লেখায় যৌন বিষয়গুলো কেন খোলামেলাভাবে উপস্থাপিত হয়, তার ব্যাখ্যা আমি দেব না”। “তাহলে কি সাহিত্যে অশ্লীলতা বলে কিছু নেই?” এ প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, “অশ্লীলতা সাহিত্যে নয়, থাকে পাঠকের মনস্তত্ত্বে”।

এই মনস্তত্ত্বেই আমাদের অশ্লীলতার বসবাস। যেমন, জন মেলার কলিয়ারের “লেডি গডিভা” কিংবা  গুস্তাভে কবেটের “দ্যা অরিজিন অফ দা ওয়ার্ল্ড” দেখার পর আপনার মনে নোংরা কামবাসনা জাগ্রত হতে পারে, কিন্তু আমার মনে তা কখনও জাগ্রত হয় না। আর এই মনে হওয়া আর না হওয়াতেই আমাদের পার্থক্য।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *