November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

পিতৃতন্ত্রের আসল পুরুষ: ওদের মুক্তি মিলবে কবে?

নাহিদা নিশি ।। পিতৃতন্ত্র কি কেবল নারীর জন্যই অভিশাপ? আপাতদৃষ্টিতে এরকমটা মনে হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। পিতৃতন্ত্র নারীকে লাঞ্ছিত করেছে, বঞ্চিত করেছে, পুরুষকেও কিছু কম করেনি। নারী, পুরুষ, কিংবা অন্যান্য সেক্সুয়াল আইডেন্টিটির প্রতিটি ব্যক্তিই পিতৃতন্ত্রের জঘন্য সিস্টেমে ফেঁসে রয়েছে।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বেঁধে দেয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী যার শারীরিক গড়ন ভালো, যার চুল ছোট, যার সেক্সুয়াল পারফরমেন্স ভালো, যার ডোমিনেট করার ক্ষমতা আছে, যার অর্থ উপার্জনের ক্ষমতা আছে, যে পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারে, যে নারীকে সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করতে পারে, সেই আসল পুরুষ। ভয় পাওয়া, পিছিয়ে যাওয়া কিংবা ব্যর্থ হওয়ার কথা পুরুষের ডিকশনারিতে থাকতে নেই।

আমার ছোট ভাই সারাদিন বাড়িতে থাকে বলে আমার মাকে বলতে শুনি, “তুই একটা ছেলে মানুষ হয়ে সারাদিন মেয়েদের মতো বাড়িতে ঘুরঘুর করিস কেন!” এই কথা শুনে প্রচন্ড বিরক্ত হলো সে। মাঝেমাঝে মন খারাপ করে বাইরে চলে যায়, পুরুষ মানুষের মতো হওয়ার আশায়। ওকে দেখে ভালোভাবে বুঝেছি, কেউ পুরুষ হয়ে জন্মায় না আসলে; সমাজের চাপে ধীরে ধীরে পুরুষ হয়ে ওঠে। ক’দিন আগে ভাইয়ের গায়ে কোথা থেকে যেন একটা টিকটিকি এসে পড়লো! ভয় পেয়ে সে হাত থেকে খাবারের প্লেট ফেলে দিলো! মা ওকে অনেক বকাবকি করলো। না, ভাতের প্লেট ফেলে দেয়ার জন্য না, ভয় পাবার জন্যও না। বকলো, ছেলে হয়েও মেয়েদের মতো টিকটিকি দেখে ভয় পাওয়ার জন্য!

ভাবুন, এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ছেলেরাও কি কিছু কম বিপদে আছে? তাদের ঘরে বসে থাকা মানা, রান্নাঘরে ঘুরঘুর করা মানা, পরিপাটি থাকা মানা, ভয় পাওয়া মানা, এমনকি ব্যথা পেলেও কান্নাকাটি করা মানা। এই যে পুরুষের ওপর পুরুষ হয়ে ওঠার যে চাপ, এটা ভয়াবহ। পিতৃতন্ত্র পুরুষকে সেই সমস্তকিছু গ্রহণ করতে বাধ্য করে, যা নিতে সবসময় সব পুরুষ আগ্রহী না। পিতৃতন্ত্র পুরুষকে ‘না’ বলা থেকে বিরত রাখে। ‘না’ বললে পুরুষের ইজ্জত থাকে না, কারণ ‘আসল পুরুষ সবই পারে’। আর আসল পুরুষ হতে কে না চায়!

কলেজে পড়াকালীন সময়ে দেখেছি, বড় বোন’কে কোচিংয়ে নিয়ে আসে ছোট ভাই। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কী করো এখানে?” বললো, “আম্মু পাঠাইছে আপুর সাথে। রাস্তায় ছেলেরা ডিস্টার্ব করে তো!” শুনে এতো হাসি পেলো! এইটুকু বাচ্চা ছেলেকে পাঠিয়েছে বোন’কে দেখে রাখতে! কি হাস্যকর না! বড় বোন’কে পাহারা দেয় ছোটভাই, বড় বোনের সেফটি নিশ্চিত করে ছোট ভাই। বোন কারো সাথে কথা বলে কিনা, কারো সাথে ডেটে যায় কি না, ওড়না ঠিকঠাক পরে কি না, এইসমস্ত কিছুর তদারকি করার দায়িত্ব ছোট ভাইদের ওপর। বড় ভাইদের কথা বাদই দিলাম! কী জঘন্য! বোনেরা কখনো এসব করে কিনা আমি জানিনা! পিতৃতান্ত্রিক সমাজ মূলত পুরুষকে জন্মের পর থেকে নারীর পাহারাদার বানিয়ে রেখেছে। বাড়তি কাজের বোঝা চাপিয়েছে পুরুষের ঘাড়ে। সদ্যপ্রয়াত কমলা ভাসিন বলে গেছেন, “যতোদিন নারীর মুক্তি মিলবে না, ততোদিন পুরুষেরও মুক্তি নেই”।

প্রথম পুরুষ ছাত্রটিকে ভর্তি করানোর পর প্রথম নারী ছাত্রীটিকে ভর্তি করাতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় সময় নেয় ২৩৭ বছর। অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজ সময় নেয় ২৬০ বছর! এটা যেদিন প্রথম শুনি, মনে হয়েছিলো, ২৬০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে নারীদের কেবলমাত্র ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন নেবার জন্য! ২৬০ বছর, অনেক লম্বা সময়, যে সময়ের মধ্যে পুরুষেরা জ্ঞানে বিজ্ঞানে এগিয়ে গেছে কয়েকশ গুণ! কতো কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছে নারীরা! এরপর মনে হলো, পুরুষও কি কম বঞ্চিত হয়েছে! কোনো নারী’কে তারা সহপাঠী রূপে পেলো না। কোনো নারী’কে সহকর্মী হিসেবে পেলো না। কোনো নারী’কে বন্ধুরূপে পেলো না। এটা কি কম ক্ষতি!

নারী-পুরুষের মধ্যকার সুন্দর সম্পর্কটাকে পিতৃতন্ত্র নষ্ট করেছে। নারী’কে পুরুষের প্রেমিকার বদলে দাসী বানিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে একে অপরকে। পুরুষ’কে উস্কেছে ভায়োলেন্সের দিকে এগিয়ে যেতে। এই যে, পুরুষেরা বউ পেটায়, ধর্ষণ করে, খুন করে, চাঁদাবাজি করে, দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে, যুদ্ধ করে, এই সমস্তকিছু পুরুষের ওপর চাপিয়েছে পিতৃতন্ত্র। পুরুষ এইসব করে, ‘আসল পুরুষ’ হবার তাড়না থেকে।

পিতৃতন্ত্র পুরুষের ওপর চাপায় অর্থ উপার্জনের ভার। যে পুরুষ পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে খাওয়ানো-পরানোর দায়িত্ব নিতে পারে না, সমাজ সে পুরুষের পৌরুষ এর ওপর আঙুল তোলে। ব্যর্থ বলে উপহাস করে। গবেষণা বলছে, পুরুষের আত্মহত্যার পেছনে সবচেয়ে বড় দুটো কারণ হলো বেকারত্ব এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থান খারাপ হওয়া। সমাজ যেহেতু পুরুষের ব্যর্থ হওয়াকে নরমালাইজ করতে পারে না, সমাজ যেহেতু ব্যর্থ পুরুষ’কে নিয়ে হাসি- ঠাট্টা করে, সেহেতু পুরুষ নিজেও নিজের ব্যর্থতাকে মেনে নিতে পারে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র অপু’র আত্মহত্যার খবরটা শোনার পর থেকে বারবার মনে হচ্ছে, একটা ভালো চাকরি না পেলে, অনেক অর্থ উপার্জন করতে না পারলে কেনো একটা মেধাবী মানুষের জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে! কেনো কোনো ছেলের ওপর এতোটা বোঝা চাপাবে সমাজ! আমার ছেলে বন্ধুদেরও প্রায় হতাশ হয়ে বলতে শুনি, “চাকরি না পেলে তোদের তো অপশন আছে। সংসার করতে পারবি। কিন্তু আমরা কী করবো!” কিছু বলতে পারি না ওদের। কারণ আমি জানি, পৃথিবীতে খুব কম নারী আছে যারা চাকরির অভাবে কিংবা পারিবারিক বোঝা টানতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে, কিন্তু এরকম পুরুষের সংখ্যা অসংখ্য। এটা প্রচন্ড ভয়ঙ্কর।

এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যদি আমরা পুরুষের ব্যর্থ হওয়াটাকে নরমালাইজ করতে না পারি, ‘পারফেক্ট পুরুষ’ এর সংজ্ঞা বদলাতে না পারি, তাহলে এই সমাজকে কখনোই আধুনিক সমাজ বলা যাবে না। পুরুষ’কেও মুক্ত করতে হবে পিতৃতন্ত্রের শেকল থেকে। স্বীকার করতে হবে যে, পিতৃতন্ত্র শুধু নারী নয়, পুরুষের পক্ষেও সমান ক্ষতিকারক। পুরুষের হাসি-কান্না, আবেগ, ভয় সমস্তকিছুকে সহজ-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার সময় এসেছে। পুরুষও দুর্বল হবে, পিছিয়ে যাবে, বাচ্চা সামলাবে, রান্না করবে, অর্থ উপার্জন করবে, ব্যর্থ হবে, প্রয়োজনে বউয়ের আঁচলের তলায় বসে থাকবে, পুরুষও ভালোবাসবে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

One thought on “পিতৃতন্ত্রের আসল পুরুষ: ওদের মুক্তি মিলবে কবে?

  • অত্যন্ত ভালো লিখেছেন, পুরুষের ভেতরকার কথাগুলো খুব সুন্তরভাবে উপস্হাপন করেছেন। সত্যিই আসল পুরুষের সংজ্ঞা পাল্টাতে হবে। সমাজের মুক্তির জন্য, নারী-পুরুষের মুক্তির জন্য, পুরুষের হতাশা কমানোর জন্য।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *