November 21, 2024
সাহিত্যআরও ভাবনাফিচার ৩

নারীবাদ নিয়ে প্রচলিত মিথ বনাম বাস্তবতা

 

বিদেশি আর্টিকেল অবলম্বনে: কাজী নাজীফা লামিনূর 

নারীবাদ একটি দর্শন যা কিনা  নারী-পুরুষের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমতায় বিশ্বাস করে। বর্তমান সময়ে নারীবাদের চর্চা যেমন বেড়েছে, স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা ও সমালোচনাও রয়েছে।

নারীবাদের সংজ্ঞার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মেরিয়াম-ওয়েবস্টার অভিধান তুলে ধরেছে নারীবাদের মূল দুটি দিক। একটি “লিঙ্গের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমতার তত্ত্ব” এবং অন্যটি “নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন”। তাহলে নারীবাদ কীভাবে নেতিবাচক স্টেরিওটাইপের সাথে যুক্ত থাকতে পারে!

অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনের মতো নারীবাদী আন্দোলনেও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন আসছে। জাতি, শ্রেণি, ধর্ম, বয়স এবং লিঙ্গ পরিচয় ভেদে সব মানুষের  সমতা নিশ্চিত করাই নারীবাদের বর্তমান ধারার উদ্দেশ্য।

সব নারীবাদী কি একই চর্চা করেন?

সব নারীবাদ-ই লিঙ্গ, জাতি এবং শ্রেণির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমতা অর্জনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে নারীবাদে থাকতে পারে বৈচিত্র‍্য। নারীবাদীরা হতে পারেন  ধার্মিক কিংবা নাস্তিক, শ্বেতাঙ্গ বা কৃষ্ণাঙ্গ, ল্যাটিনো, এশিয়ান। বিবাহিত, অবিবাহিত, সম্পর্কমুক্ত বা বহুমুখী সম্পর্কে যুক্ত, সমকামী, বিষমকামী, অযৌন, ট্রান্সসেক্সুয়াল, নারী, পুরুষ বা যেকোনো শ্রেণির মানুষ। তারা হতে পারেন রাজনৈতিকভাবে উদার এবং রাজনীতিমনা, তরুণ, তারুণ্যমনস্ক এবং বৃদ্ধ। অর্থাৎ নারীবাদ চর্চার জন্য কোনো নির্দিষ্ট জাত, ধর্ম, শ্রেণি বা বয়সের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই।

দুর্ভাগ্যবশত নারীবাদীরা প্রায়ই কিছু গৎবাধা ধারণার মুখোমুখি হন। যার মধ্যে অন্যতম হলো নারীবাদীরা পুরুষবিদ্বেষী, রাগী, তারা আকর্ষণীয় ও নারীসুলভ নয়, সব নারীবাদী সমকামী, নাস্তিক, তারা সকলেই কর্মজীবী ​​এবং ঘর-সংসার সমর্থন করে না, তারা বিয়ে ও যৌনতা পরীপন্থী  এবং নারীরাই কেবল নারীবাদী হতে পারে।

নারীবাদীরা কি নারীদেরকে পুরুষের  চেয়ে বেশি শক্তিশালী করতে চায় এবং তাদের মধ্যে যৌন আধিপত্য তৈরি করে?

নারীবাদ সবসময় লিঙ্গ সমতার পক্ষে। নারীবাদ নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব বা পুরুষের উপর নারীর কর্তৃত্বকে সমর্থন করেনা। বরং নারীবাদ নারী-পুরুষ উভয়ের উপর শক্তিশালী প্রভাব তৈরি করতে চায়। সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নারীপুরুষের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টিই নারীবাদ।

সুতরাং কেউ যদি দাবি করে, “আমি নারীবাদী নই, কিন্তু আমি সমতার পক্ষে” তাহলে এটা স্পষ্ট যে নারীবাদ নিয়ে তার মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে।

বর্তমানে নারীপুরুষের সমতা অর্জিত হয়েছে, তাহলে কেন নারীবাদ এখনও বিদ্যমান?

আসলে নারীবাদ এবং সমতার লড়াই আমাদের জাতি ও বিশ্বের দৃশ্যপটকে ব্যাপকভাবে বদলে দিয়েছে। ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে আশানরূপ অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে বেতনের ব্যবধান, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, যৌন নিপীড়ন, সহিংসতার বিরুদ্ধে সুরক্ষা, গণমাধ্যমগুলোর লিঙ্গ চিত্রায়ণ (Gender representation) ইত্যাদি বিষয়ে প্রচুর কাজ করা প্রয়োজন।

ব্যক্তিপর্যায়ে কেন নারীবাদের চর্চা করা উচিৎ?

বর্তমানে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ নারী। হতেই পারে যে আপনি একজন পুরুষ। তবে আপনি  নিঃসন্দেহে কোনো না কোনো নারীর সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ। হতে পারে তিনি আপনার মা, বোন, দাদী, চাচী, চাচাতো ভাই, বান্ধবী, স্ত্রী, অথবা বন্ধু। আপনি যদি তাদের নিয়ে সচেতন হোন, তাহলে নারীবাদ আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উপরন্তু, নারীবাদ হল সকল প্রান্তিক গোষ্ঠীর সমতা। যারা এলজিবিটিকিউয়াইএ (LGBTQIA), প্রতিবন্ধী এবং সংখ্যালঘু তাদের জন্য সমতা। নারীবাদের প্রতি যত্নশীল হওয়ার অর্থ এই জনগোষ্ঠীর প্রতি যত্নশীল হওয়া। এবং পরিশেষে, নারীবাদ শুধুমাত্র একজন নারীর বিরুদ্ধে নেতিবাচক স্টেরিওটাইপ পরিবর্তন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়, নারীবাদের একটি বড় দিক হচ্ছে পুরুষত্ব সম্পর্কে স্টেরিওটাইপগুলি বোঝা এবং এই স্টেরিওটাইপগুলি সমাজে কী প্রভাব ফেলে সে বিষয়ে কাজ করা।

আপনি যদি ব্যক্তিপর্যায়ে কখনো  ভিন্ন জাতি/লিঙ্গ/সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাজ না করে থাকেন তাহলে কেন আপনি নারীবাদ চর্চায় সচেতন হবেন?

নারীবাদ এবং সমতা নিয়ে আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু কেবল আন্তঃব্যক্তিক মিথস্ক্রিয়া নয়, বরং সামাজিক বৈষম্যকে প্রভাবিত করে এমন ব্যবস্থায় মনোনিবেশ করা। হতে পারে আপনি ব্যক্তিগতভাবে কুসংস্কার বিশ্বাস করেন না, এর অর্থ এই নয় যে আমরা একটি বর্ণ/যৌনতা/শ্রেণি/বৈষম্যবিরোধী সমাজে বাস করি। এই সমাজে অনেকেই আছেন যারা গোষ্ঠীর প্রচলিত রীতিনীতির  সাথে মানিয়ে চলতে পারছেন না। আবার মানুষ হিসেবে ব্যক্তির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সমাজ সাদরে গ্রহণ করতে পারে। আবার বিভিন্ন ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য অপছন্দনীয় হতে পারে। এটি খারাপ নয়। বরং স্বীয় বৈশিষ্ট্যগুলোকে তুলে ধরার মাধ্যমেই গোষ্ঠীর মধ্যকার অসমতাকে পর্যবেক্ষণ করা যায়।

সবশেষে নারীবাদ সম্পর্কিত আলোচনায়  একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা জরুরি। তা হলো সেক্স এবং জেন্ডারের মধ্যে পার্থক্য –

সেক্স হলো নারী বা পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য যা জন্মগতভাবে নির্ধারিত হয়। অন্যদিকে একজন নারী বা পুরুষকে সমাজ নির্মিত যেসব রীতিনীতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা হলো জেন্ডার।

 

কাজী নাজীফা লামিনূর: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *