কমলা ভাসিন: কবিতায় নারীবাদের কথা বলতেন যিনি
সদ্যপ্রয়াত খ্যাতিমান নারীবাদী কমলা ভাসিনের মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে এই শ্রদ্ধাঞ্জলিটি লিখেছেন ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক কল্পনা শর্মা, লেখাটি গত ১ অক্টোবর ২০২১ এ দ্য হিন্দু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছেন কারিন আশরাফ ।।
কোনো প্রভাবশালী, উচ্চপদস্থ কেউ নন তিনি। নন বিশ্বখ্যাত কোনো রক গায়ক। তবু মৃত্যুর পরে হাজারো মানুষের ভালোবাসা আর অশ্রুজলে সিক্ত হলেন তিনি। কারণ তিনি মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পেরেছিলেন। ভাবতে পারেন, তার জীবনটা ঠিক কেমন ছিল?
নারীবাদী আইকন কমলা ভাসিন। ৭৫ বছর বয়সে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ক্যান্সারের সাথে তাঁর নাতিদীর্ঘ লড়াই শেষ হয় গত সেপ্টেম্বর ২৫এ। তিনি আর তাঁর বন্ধুরা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর সময় ফুরিয়ে আসছে। একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁরা তাঁর পাশে ছিলেন। কমলাও তাঁর স্বভাবসুলভ আন্তরিকতায় চেষ্টা করে গেছেন মানুষের সাথে মিশতে। একজন নারীবাদী হিসেবে তাঁর জীবন উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছিল মানুষের সঙ্গে অর্থপূর্ণ যোগাযোগ স্থাপন করতে পারার অসাধারণ দক্ষতায়।
কমলা ছিলেন পেশায় সমাজবিজ্ঞানী। ৭০ এর দশকে ভারতে নারী অধিকার নিয়ে কর্মরত প্রথম দিককার জোটটির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন তিনি। তাঁরা নারী অধিকার, ন্যায়বিচার, যৌতুক নির্মূল আর ধর্ষণ বিষয়ক আইনের সংশোধনের জন্য লড়েছেন। সবার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই ছিল তাদের জন্য নারীবাদ। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সম্মিলিত প্রয়াসে। তারা মানুষের বিভিন্নতাগুলোকে দূরে ঠেলে না দিয়ে সানন্দে গ্রহণ করতেন, যাতে সমাজের সব ধারার লোকের কাছে পৌঁছাতে পারেন। তাদের এই দলটি ভারতের অন্যান্য মানবাধিকারবিষয়ক জোটের সাথেও যুক্ত ছিল।
সদা হাস্যোজ্জ্বল
কমলা সুকঠিন এই লড়াইয়ে যুক্ত করেছিলেন নতুন মাত্রা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্যাশন আর ক্রোধ ছাড়াও এই আন্দোলনের দরকার হাস্যরসের, সৃজনশীলতার, আর তাঁর নিজের ভাষায়, “ভালোবাসার”। এই গুণগুলো তাঁর কবিতা, গান আর স্লোগানে সবসময় পাওয়া যেত। তাঁর রচনা ছিল দৈর্ঘ্যে ছোট, তীক্ষ্ণ আর সূক্ষ্ম রসবোধে পরিপূর্ণ। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইটা তাঁর কাছে কোন মারাত্মক আর ভয়াবহ ব্যাপার ছিল না। বরং তিনি যেন সবাইকে মনে করিয়ে দিতেন এই লড়াইটি ইতিবাচক, আমাদের সবার সমান অধিকার আর ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে।
কমলা তাঁর ছোটদের জন্য সুন্দর যে বইগুলো লিখেছেন, সেখানেও এই ব্যাপারটা ফুটে উঠেছে। বইগুলো প্রমাণ করে, পুরুষতন্ত্রকে শুধু প্রতিবাদ করেই প্রতিরোধ করতে হবে, তা নয়। ছোট্ট মেয়েদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়ে, আর ছেলেদের এই স্বপ্নগুলোকে উদযাপন করতে উদ্বুদ্ধ করেও পুরুষতন্ত্রের খুঁটি দুর্বল করে দেয়া সম্ভব।
আশির দশকে যেকোন নারীবাদী সমাবেশে ছিল কমলার সরব উপস্থিতি ছিল। জটিল সব ধারণাকে সহজ করে উপস্থাপন করতে তিনি ছিলেন এতই পারদর্শী, যে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই সেগুলো বুঝতে পারত। আমাদের প্রত্যাশা, তাঁর লেখা শিশুদের বইগুলো বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হতে থাকবে। সরকারের সুবুদ্ধি থাকলে এই বইগুলো হয়তো স্কুল কারিকুলামের অংশ হত।
একতায় অকৃত্রিম
কমলার সাম্প্রতিক বই ‘মেনি নোটস ওয়ান সিম্ফোনি’ আজকের এই ঘৃণায় ভরা সময়ে অসাধারণভাবে দূরদর্শী। বইটি ‘সাঙ্গাত’ এর ওয়েবসাইট থেকে বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যাবে।
আসামে মুসলিমদের অন্যায় উচ্ছেদের প্রতিবাদে গুলির শিকার হয়েছিলেন মইনুল হক। ভাবুন তো একবার, হৃদয়ে কী পরিমাণ ঘৃণা জমলে নিথর গুলিবিদ্ধ একজন মানুষের বুকে পদাঘাত করতে পারে আরেকজন মানুষ? শুধু ধর্মের ব্যবধানই কি পারে কাউকে অমানুষ করে তুলতে? কীভাবে আমরা পারি এই ঘৃণাকে মোকাবেলা করতে? কোথা থেকেই বা জন্ম হয় এই ঘৃণার? এই স্রোতকে কীভাবে আমরা উল্টে দিতে পারি?
কমলার বইটি এসব ইস্যুকে এমনভাবে তুলে ধরে যেন একটা ছোট বাচ্চাও বুঝতে পারে। বইটিতে তিনি বুঝিয়ে বলেছেন ঠিক কেন আমাদের বৈচিত্র্য আর অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। প্রকৃতি থেকে উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “পার্থক্যের মানে অসমতা নয়। প্রকৃতিতে কেউ কারো চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বা নগণ্য না। আমরা কি বলতে পারি কোনটি বেশি ভালো — আগুন না পানি? পাখি, প্রজাপতি নাকি পশু? পিঁপড়া, বিড়াল নাকি হাতি? সমুদ্র, পাহাড় নাকি গ্রাম? রাত নাকি দিন? শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা নাকি বসন্ত? সেভাবেই সবার নির্দিষ্ট দায়িত্ব আর গুরুত্ব আছে আমাদের পরিবার আর সমাজেও”।
ডাইভার্সিটি বা বৈচিত্র্যের ব্যাপারে কত সহজ, তবু কত প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা! কমলা ন্যায়বিচারের ব্যাপারে লিখেছেন, “ন্যায়বিচার আর সমান অধিকার ছাড়া সত্যিকারের একতা অর্জন করা কঠিন। বিভিন্ন ধরনের মানুষের মধ্যে ঐক্য তখনই নিশ্চিত হবে, যখন ন্যায়বিচার, পারস্পরিক বোঝাপড়া আর সম্মান প্রতিষ্ঠিত হবে৷”
তাঁর এই কথাগুলো, যা কালোত্তীর্ণ হয়ে উচ্চারিত হবে বারবার: “মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আত্মকেন্দ্রিক ক্ষমতালোভী লোকেরা তৈরি করে বিভেদ। যারা মানুষে মানুষে ঘৃণা ছড়ায়, তাদের বিভক্ত করে, তারা কখনই ধার্মিক হতে পারে না। সত্যিকারের ধার্মিক তো তারাই — যারা সবাইকে দয়া করে, ভালোবাসে, যারা সৎ আর ন্যায়বান।”
কমলা ভাসিন শুধুই একজন ‘আইকন’ ছিলেন না; তিনি আলোর মশাল হাতে আমাদের পথ দেখিয়েছেন প্রগতির। তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ, বই, গান — আর তাঁর জীবনের এই ভালোবাসার আদর্শ জ্বলজ্বল করবে সবসময়।
কারিন আশরাফ: শিক্ষার্থী, হলিক্রস কলেজ