May 15, 2024
সাহিত্যউপন্যাস

পৌনঃপুনিক [পর্ব – ০২]

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী ।। 

আদির অপেক্ষায় কত আকুলতা! কত কাতরতা! মা হওয়ার দিনগুলোতে হঠাৎই নিঃসঙ্গতায় ছিটকে পড়া। অফিস, বাড়ি সামলিয়ে পরপর দুই সন্তানের লালনপালন – দশভুজা হবার দৌড়ে কী রুদ্ধশ্বাস ছুটে চলা! বাচ্চারা বড় হয়েছে। বয়সের সাথে সাথে আদি এখন আগের চেয়ে ধীরস্থির, সংসারী মানুষ বলা যায়। ঘর গৃহস্থালি চলছে আপন নিয়মেই। সেইসব দিন পেছনে ফেলে এসেছে দোলন। এক বাক্যে বলতে গেলে আদি মানুষটা ভালোই। কিন্তু একজন মানুষ কেমন তা কি এক বাক্যে প্রকাশ করা যায়? কোনো মানুষই কি নিপাট ভালো অথবা মন্দ মানুষ হয়? নিজেকে জানতেই কোথা দিয়ে একখানা জীবন ফুরিয়ে যায়!

দোলন ভাবে, তার প্রথম উপন্যাসখানা এবার লিখেই ফেলবে! লিখতে বসে কোনো শব্দের জুতসই প্রতিশব্দ খুঁজছে ঠিক সেই সময় ফোনটা বেজে উঠবে।

: হ্যালো! কোথায় থাকো দোলন? তিনবার ফোন করছি!

: এখানেই থাকি! বলো!

: বাসায় কি টমেটো ছিল? পুদিনা পাতা নেবো?

: টমেটোর খবর জানি না আদি। আর এই অসময়ে গরমের মধ্যে টমেটো খেতে হবে কেন?

: না মানে তুমি তো পছন্দ করো তাই… এখন তো সব সিজনেই পাওয়া যায়। নিই তাহলে এক কেজি!

: তোমার যা খুশি আনো। বারবার ফোন দিয়ো না।

এর চেয়ে সাথে যাওয়া ভালো ছিল!

দোলন জানে এই ফোন আবার আসবে। বাজারে গিয়ে আট – দশবার ফোন করা আদির পুরনো অভ্যাস। ব্যাংকের নথিপত্র থেকে শুরু করে কাঁচাবাজার সংক্রান্ত আলাপ, বাসার খালা পানের সাথে বাবা জর্দা নাকি রতন জর্দা খায় – এমন অসংখ্য টুকরো টুকরো জিজ্ঞাসা। সবই নিত্যপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা। একুশ বছর ধরে যাপন করে আসা সংসারজীবন নানাভাবে নির্ভর করে দোলনের উপর। কিন্তু সব কিছুতে নিখুঁত হতে ইচ্ছে করে না তার আগের মতো। নাভিশ্বাস উঠিয়ে পারফেকশনিস্ট হওয়া, মাল্টিটাস্কার হওয়ার চেয়ে বরং ইচ্ছে হয়, একটু থামি!  কিছু কাজ না হয় পড়েই রইলো!

নিজের ভেতরের “আমি”টাকে কতকাল হেলায় ফেলে রাখা! কবে, কখন থেকে দোলন এমন নিরুত্তাপ হয়ে পড়লো, নিজেও ভেবে পায় না। নিরুত্তাপ কথাটাও বোধহয় ঠিক না। নিজেকে খুঁজে পেতে অল্প অল্প করে সাহস অর্জন করার জন্য অপরাধবোধ হয় না তার। একে যদি অন্যেরা নিরুত্তাপ হওয়া ভেবে নেয়, তাতে কী এমন এসে যায়?

সেদিন রিমি বলছিল, ঘুমের মধ্যে প্রায়ই নাকি সে ছোটকালের সেই খেলার মাঠে চলে যায়! দোলন অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল – আমারও তো এমন হয় রে! বিকেল হলে তুই, খুকু, লাবণী, মনু, লেনিন ভাই, আদরী দি, সবুজ – সবার হুল্লোড় কানে বাজে। আজ বুড়িচ্চি না কপাল টোকাটুকি খেলা হবে তা নিয়ে তুমুল ঝগড়া! ঘুমন্ত চোখ দুটো ঠেসে অন্ধকার করে রাখা আঙুলগুলো মনুর। চোখ গেল বলে! খেলা শেষে পিঠে দুমাদুম কিল মারতে হবে ! “আয় রে আমার গোলাপ ফুল!” –  অমনি কপালে বিদ্যুতের গতিতে টোকা পড়ে। গোলাপটা কে হতে পারে! রিমি নাকি খুকু? খেলার সাথীরা কে কোথায় চলে গেছে সময়ের প্রয়োজনে! রিমি ছাড়া অন্যদের সাথে  যোগাযোগ নেই। অথচ তখন একবেলা ভাত না খেলেও চলতো, কিন্তু খেলা ছাড়া দিন চলতো না। ইস্কুল থেকে ফিরেই মনটা ব্যাকুল হতো। বিকেল হলেই এ ওকে ডাকাডাকি। কত বছর পেরিয়ে গেছে! তবু সেই কোলাহল এখনো পিছু ডাকে। দোলন সেদিন কোথায় যেন পড়ছিল, “যখন থেকে শৈশব স্মৃতি তাড়িয়ে ফিরতে শুরু করবে, বুঝবে তোমার বয়স বাড়ছে।” বয়স বাড়ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ নিয়ে দোলনের মাথাব্যথাও নেই। চল্লিশের পর জীবনের এ অধ্যায়টা কেন জানি দোলনের বড্ড আপন মনে হচ্ছে। কারণ যত বয়স বাড়ছে, নিজের সাথে বোঝাপড়াটা গভীর হচ্ছে। আধো ঘুম আধো জাগরণের মতো জীবনটাকেও একটা মজার খেলা মনে হচ্ছে। এই যে, তেতো তত্ত্বকথায় ঠাসা বাস্তব উপেক্ষা করে শৈশবের খেলার মাঠে ফিরতে পারা, লেখালেখি আর দিবাস্বপ্নের ঘোর – সবকিছুই দোলনের কাছে টাইম মেশিনে ভ্রমণের মতো রোমাঞ্চকর। গন্তব্য যেখানেই হোক, এই ভ্রমণের একক অভিযাত্রী সে। এ যাত্রাপথটুকু সে কারো জন্যে হেলায় হারাবে না।

[চলবে]

 

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী : সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। এই মুহূর্তে শিল্পকর্ম এবং স্বাধীন লেখালিখিতে ডুবে থাকাতেই স্বচ্ছন্দ। মিশ্র মাধ্যমে শিল্পকর্মের বিষয় হিসেবে জানালার গল্পের আড়ালে আসলে ফেলে আসা সময়, স্মৃতির সঞ্চয় অথবা জীবনের কোনো চেনা গল্প রয়ে যায়। জীবনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে যে বিষয়গুলো বিশেষভাবে ভাবায় : নারী – পুরুষের সমতা, সম্পর্কের  টানাপোড়ন ও জটিলতা। পারিবারিক – সামাজিক নির্যাতন ও বৈষম্য। শিশুর নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আড়াই লক্ষাধিক বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী জীবন সংগ্রামের ইতিহাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *