May 3, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ৩

বেটি ফ্রিডান: নারীর চিন্তাজগতে আঘাত করে গেছেন যিনি

ছিলেন নারী অধিকার আন্দোলনের মুখপাত্র, বিতর্ক ছিল যার নিত্যসঙ্গী, কট্টর সমালোচনা যার আদর্শের পথে বাধা হতে পারেনি, লেখনীর মাধ্যমে যিনি সাধারণ নারীদের মনে জাগ্রত করেছেন মুক্তির আকাঙ্ক্ষা,  তিনি আর কেউ নন- মার্কিন নারীবাদী বেটি ফ্রিডান। চিরস্মরণীয় এই নারীবাদীকে নিয়ে লিখেছেন কাজী নাজীফা লামিনূর।। 

নারী অধিকার আদায়ের যে সংগ্রাম তিনি শুরু করেছিলেন, জীবনভর সেই লড়াই করেছেন; তবু পিছিয়ে যাননি। মাথা নত করেননি নারীবাদবিরোধীদের কাছে। তাঁর লেখা ‘দ্য ফেমিনিন মিস্টিক’ বইটি প্রকাশের পরপরই সারাবিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।  বলা হয় ফ্রিডানের লেখা বইটি যুক্তরাষ্ট্রে নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের সূচনা করে।

বেটি ফ্রিডান ১৯২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম বেটি নওমি গোল্ডস্টেইন। পরিবারে তিন সন্তানের মধ্যে তিনিই ছিলেন বড়। বাবা হ্যারি গোল্ডস্টেইন পেশায় স্বর্ণকার আর মা মিরিয়াম হরোউইটজ ছিলেন সাংবাদিক। মা ছিল তাঁর অনুপ্রেরণা। স্কুলে সাহিত্য পত্রিকায় সম্পাদনা  করতেন ফ্রিডান। তখন থেকেই লেখালেখিতে পটু হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি শিক্ষার্থী হিসেবে  ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। স্বপ্ন দেখতেন উচ্চশিক্ষা অর্জনের। ১৯৪২ সালে স্মিথ কলেজ থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি নেন। এরপর পিএইচডি’র জন্য ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট বার্কলিতে। তবে পিএইচডি আর করা হয়নি কারণ সেখানে অমত ছিল তাঁর প্রেমিকের। পরে সেই সম্পর্কও আর রাখেননি তিনি। যোগ দেন সাংবাদিকতায়। পাশাপাশি  শ্রমিক ইউনিয়নের রাজনীতিতে খুব সক্রিয় হয়ে ওঠেন বেটি। ১৯৪৭ সালে বিয়ে করেন জনসংযোগকর্মী কার্ল ফ্রিডানকে। পরপর তিন সন্তানের মা হয়ে পুরোদস্তুর সংসার শুরু করেন। তখন বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে গিয়ে চাকুরি ছাড়তে হয় তাকে।

একদিন কলেজের সাবেক সহপাঠীদের সঙ্গে আড্ডায় বসে গল্প হয় তাদের জীবনযাপন নিয়ে। সেখান থেকে জানতে পারেন জীবন নিয়ে তাদের আক্ষেপের কথা। যার অন্যতম কারণ সংসার সামলাতে গিয়ে চাকরি, উচ্চশিক্ষা বা নিজের যেকোনো ইচ্ছাকে উৎসর্গ করতে হয় নারীকে। বন্ধুদের জীবনের গল্পে নিজেকে খুঁজে পান বেটি, সিদ্ধান্ত নেন তাঁর ভাবনাগুলো লিখবেন।  যার ফল ‘দ্য ফেমিনিন মিস্টিক’। বইটি লিখতে তিনি সময় নেন চার বছর। বইটি প্রকাশের পর আশাতীত খ্যাতি লাভ করে। প্রায় বিশ লাখ কপি বিক্রি হয় এই বইয়ের। পাশাপাশি বইটি লিখে ব্যাপক আলোচিত হন ফ্রিডান। বইটির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে  ফ্রিডান বলেছিলেন, তিনি এমন একটি সমস্যার কথা বলতে  চেয়েছেন, যে সমস্যার কোনো নাম নেই (The problem that has no name)।

বইটিতে তিনি বলেছেন সেইসব নারীর কথা, যারা তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে ভুলে শুধুমাত্র স্বামী-সংসার-সন্তানকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছে নিজেদের পৃথিবী। বইটির ভিতরে সেইসব গৃহিনীরা নিজেদের অস্তিত্বকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তারা বুঝে উঠতে শুরু করেন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিচারে নারীরা কতটা পিছিয়ে। তখন যুক্তরাষ্ট্রে নারীরা কর্মক্ষেত্রে কিছু সেবামূলক পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করতে পারতো মাত্র, মত প্রকাশ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা তাদের ছিল না।

‘দ্য ফেমিনিন মিস্টিক’- বইটিতে সহজ ভাষায় বেটি বলেছেন: কেবল সংসারধর্ম রক্ষা আর নূন্যতম শিক্ষায় মেয়েদের সন্তুষ্ট হলে চলবে না। জাগতে হবে, জাগাতে হবে অন্যদের। নিজেদের ভাবনার জগৎকে সাজাতে হবে।

নারী জীবনের পূর্ণতা” প্রসঙ্গটিকে সকলের সামনে এনেছেন ফ্রিডান। তিনি  তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, “নারীবিষয়ক পত্রপত্রিকায় এমন সব প্রচারণা চালানো হয় যেন পরিপূর্ণতা ব্যাপারটি কী তা নারীরা কেবল মা হওয়ার সময়ই জানতে পারে। যেন  নারীর জীবনে নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার একটাই উপায়, তা হলো সন্তানের মা এবং কারো স্ত্রী হওয়া।”

সারাজীবন স্বামী-সংসার-সন্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকা নারীর চেতনায় আঘাত করে তাদের জাগানোর চেষ্টা করেছেন বেটি ফ্রিডান। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, সন্তান জন্মদান ও শরীরের জৈব কার্যক্রম সম্পন্ন করা ছাড়া নিজেকে গড়ে তোলার কোনো ইচ্ছা নেই কেন নারীদের?  তিনি মনে করেন, নারীদের এমন জীবনযাপন এক ধরণের আত্মহত্যা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার রেকর্ড বৃদ্ধির পরিসংখ্যানের কথা উল্লেখ করে ফ্রিডান তার বইয়ে  বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সহজলভ্য না হওয়ার কারণেই নারীরা অতিরিক্ত সন্তানধারণে বাধ্য হচ্ছেন। এর পরিপ্রক্ষিতে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে বিবাহিত নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের স্বাধীনতা দেয়।

ফ্রিডান লিঙ্গসমতা অর্জনের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নারী পুরুষের সমতাভিত্তিক মজুরি নিশ্চিতকরণ। এই লক্ষ্যে তিনি  ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব উইম্যান বা ‘NOW’ প্রতিষ্ঠা করেন যা তার জীবনের অন্যতম কৃতিত্ব। ফ্রিডান ও তাঁর সহকর্মীদের আন্দোলনের ফলস্বরূপ ১৯৬৩ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ‘ইকুয়াল পে অ্যাক্ট’-এ স্বাক্ষরের মাধ্যমে মজুরি কাঠামোর লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের অবসান ঘটান। পরবর্তীতে গর্ভপাতবিরোধী আইন রদের আন্দোলনও শুরু করেন  ফ্রিডান।

আশির দশকের শুরুতে ডানপন্থীদের শক্ত অবস্থানের কারণে নারীবাদীরা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। ফলে ফ্রিডান ও তাঁর সহকর্মীদের কাজও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই বলে নিজের কাজে পিছু হটেননি তিনি। লেখালেখি, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, বক্তৃতা ইত্যাদির মাধ্যমে নিজের মতপ্রকাশ ও নারী অধিকার আদায়ের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন তিনি।

১৯৮১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘দ্য সেকেন্ড স্টেজ’ বইটিতে তিনি ভিন্ন যুক্তি দেখান। সেখানে বলা হয়েছে আধুনিক নারীবাদীরা পুরুষবিদ্বেষী কর্মকাণ্ড এবং সংসার ও সন্তানধারণের বিরোধিতা করলে তা পরিণামে নারীদের ক্ষতির কারণ হবে। তাঁর এমন যুক্তি  রক্ষণশীলদের পক্ষে গেলেও কট্টর নারীবাদীরা এর তীব্র নিন্দা করেন।

ফ্রিডান নারী অধিকারের সমর্থনে জনমত গড়ে তুলতে বিভিন্ন দেশ ঘুরে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেন। বক্তৃতা দিয়েছেন হার্ভার্ড ও ইয়েলের মতো  বিশ্ববিদ্যালয়ে।  পাশাপাশি ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় জেন্ডার বিষয়ে থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন।

‘দ্য সেকেন্ড স্টেজ’ ছিল তাঁর তৃতীয় বই। তার আগেই, ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘ইট চেঞ্জড মাই লাইফ: রাইটিংস অন দ্য উইমেন’স মুভমেন্ট’, যাতে স্পষ্টভাবে নারী আন্দোলনের সামগ্রিক অবস্থা তুলে ধরেন তিনি।

বার্ধক্যের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করতে  ১৯৯৩ সালে প্রকাশ করেন  ‘দ্য ফাউন্টেইন অব এইজ’। জীবনের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিচারণ করে সর্বশেষ লেখেন ২০০০ সালে ‘লাইফ সো ফার’। নারীবাদী আন্দোলনের এই কিংবদন্তী ২০০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

ফ্রিডানের ‘দ্য ফেমিনিন মিস্টিক’ বইটি প্রকাশের পর দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পত্রপত্রিকাগুলো তাঁকে ‘নারীবাদের জননী’ হিসেবে আখ্যা দেয় । লেখিকা বারবারা সিম্যান বলেছিলেন, ‘কালোদের কাছে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র যা, নারীদের জন্য বেটি ফ্রিডানও তাই।’

তবে সত্তর দশকের নারীবাদীদের অধিকাংশই তা মনে করেন না। অনেকেই মনে করেন ফ্রিডান নারী বিষয়ে লেখালেখির সনাতনী ধারার চর্চা করেছেন।

নারীবাদের কথা বলতে গেলেই পুরুষদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হবে, এমন ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন না বেটি ফ্রিডান। রাজনীতিসচেতন ফ্রিডানের বিশ্বাস ছিল সমাজে নারীর প্রাপ্য মর্যাদা নিশ্চিত করতে নারী-পুরুষ উভয়ের সচেতনতা জরুরি।

আদর্শে অটল ফ্রিডান নিজের ভাবনাগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। তবু মৃত্যুর আগে আক্ষেপভরে বলেছিলেন, ‘বিপ্লব এখনও শেষ হয়নি’। তাঁর সারাজীবনের সংগ্রামের মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন শুধু ঘরের কোণে বন্দি হয়ে থাকা নয়, অজানাকে জানার জন্য ঝুঁকি নেয়া, নিজের বুদ্ধি ও মেধা সম্প্রসারিত করা নারীর অধিকার। যে সৃজনশীলতায় নারী ও পুরুষ উভয়ের সমান অধিকার, সেটির চর্চা করতে না পারলে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠা যায় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *