চিপকো আন্দোলন: গাছকে জড়িয়ে ধরেছিলেন যে নারীরা
পূরবী চৌধুরী ।।
আজ থেকে প্রায় ৪৮ বছর আগে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে চিপকো আন্দোলন হয়েছিল। চিপকো আন্দোলনের কথাটি আসলেই চোখে ভেসে ওঠে কিছু মানুষ গাছ জড়িয়ে আছে, এমন দৃশ্য। এই আন্দোলনের একটা বড় অংশ জুড়ে ছিলেন নারীরা। প্রকৃতির সাথে নারীর সম্পর্ক নিবিড়, তাই নারীরা তাদের পরিবার ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে জড়িয়ে ছিলেন প্রতিটি ক্ষেত্রে।
আমরা প্রকৃতি ও পরিবেশের অংশ, আর গাছ এই পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। গত কয়েক দশক কলকারখানা গড়ে তোলাসহ বনজ নানা সম্পদ ব্যবহার হয়েছে যথেচ্ছোভাবে। ফলে পৃথিবী তার ভারসাম্য হারিয়েছে। বেড়েছে প্রাকৃতিক দূর্যোগের মাত্রা। তাই এখন সারাবিশ্ব কিছুটা নড়ে চড়ে বসেছে, পরিবেশ রক্ষাকে সামনে রেখে টেকসই উন্নয়নে মনোনিবেশ করা হয়েছে প্রতিক্ষেত্রে। কিন্তু পরিবেশের প্রতি এই মনোযোগ তৈরি একদিনে হয়নি বা পরিবেশ গুরুত্বও পায়নি। নানা সময়ে নানা দেশে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন গড়ে উঠেছে। ভারতের চিপকো আন্দোলনও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনগুলোর অন্যতম।
চিপকো শব্দটার অর্থ জড়িয়ে ধরা, গাছকে জড়িয়ে ধরে কুঠারাঘাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছিল আন্দোলনকারীরা তাই এটি চিপকো আন্দোলন নামে পরিচিত। গাছকে জড়িয়ে ধরে গাছকে রক্ষা করা, বিষয়টি অনুভূতির জায়গায় একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছিল, যার মাধ্যমে এক অহিংস প্রতিবাদ করেছিলেন গ্রামবাসীরা। এই আন্দোলন শুধু গাছ কাটার বিরুদ্ধে ছিল না বরং ছিল বনকে রক্ষার মাধ্যমে বনের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীকে বাঁচিয়ে রাখা, বন ও পাহাড়ের সম্পদ ব্যবহারে স্থানীয়দের জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করা ছিল এর উদ্দেশ্যে। তাই এটা শুধু পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন না বরং আর্থসামাজিক আন্দোলন। সেই সময় সরকারি নিয়ন্ত্রণে কিছু প্রতিষ্ঠান ছিল যারা কলকারখানা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেও বনভূমি কেটে উজার করেছিল, তাই এই আন্দোলনকে কিছুটা রাজনৈতিক আন্দোলনও বলা যায়।
চিপকো আন্দোলন অর্থাৎ ভারতের বন সংরক্ষণ আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৭৪ সালে হিমালয় অঞ্চলের উত্তরখণ্ড প্রদেশে এবং এটি পরবর্তীতে সারাবিশ্বের পরিবেশ আন্দোলনের সমাবেশবিন্দুতে পরিণত হয়। এই আন্দোলনের মূল পরিচালনাকারী সুন্দরলাল বহুগুনা মহাত্মা গান্ধীর অনুসরণকারী ছিলেন। আন্দোলনটি একই রকম ইকো গ্রুপকে বন উজার কমানোর কাজে ভূমিকা রাখাসহ বিশ্বব্যাপী সচেতনতা তৈরি করেছিল। সর্বোপরি এটি ভারতের সুশীল সমাজকে আলোড়িত করেছিল, সাথে আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির স্বার্থরক্ষাসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ভূমিকাও রেখেছিল। যে বিষয়টি মূখ্য তা হলো আন্দোলনে পুরুষরা থাকলেও নারীরা মূখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। চিপকো আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছিল। উত্তরাখণ্ডের গৌরা দেবী, সুরক্ষা দেবী, বাচনি দেবী, চান্দি প্রসাদ ভট্ট, বিরুক্ষা দেবী এবং অন্যান্য আরো অনেকে আন্দোলনে অংশ নেন। বর্তমানে এই আন্দোলনকে ইকো-সোশ্যালিজম এর চাইতেও ইকো-ফেমিনিজম হিসেবে দেখা হচ্ছে কিন্তু এটিকে নারীবাদী আন্দোলনের সাথে মেলানোও যাবেনা। কারণ এই আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তির জায়গায় নারীরা থাকলেও নেতৃত্বের জায়গায় পুরুষরাও ছিলেন। কিন্তু মূলত নারীদের উপর এই ব্যাপকভাবে বন উজার বেশ প্রভাব ফেলেছিল। কারণ জ্বালানী ও খাদ্য সংগ্রহের পাশাপাশি খাবার এবং সেচের পানি, এসবের অভাবের কারণে মূলত নারীরাই নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়ে আসছিল। তাই শুরু থেকেই এই আন্দোলনে নারীরা ওতোপ্রতোভাবে জড়িত ছিল। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে চিপকো আন্দোলনে প্রাথমিক স্টেকহোল্ডার হিসেবে নারীরাই বনায়নে ভূমিকা রাখেন। বন সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার, ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশের সঠিক ব্যবহারে ভূমিকা রাখায় চিপকো আন্দোলনকে রাইট লাইভলিহুড পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
চলুন আন্দোলনটির আদ্যপান্ত জেনে নিই, আন্দোলনটি প্রথম শুরু হয় উত্তরাখণ্ডের চামেলি জেলায়, পরে তা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। জানা যায় গান্ধীবাদী সমাজকর্মী চণ্ডী প্রসাদ ভট্ট ১৯৬৪ সালে মান্ডাল গ্রামবাসীদের জন্য দাশোলি গ্রাম সৌর্য্য মান্ডাল (ডিজিএসএম) নামক একটি সমবায় সংস্থা গড়ে তোলেন, সংস্থাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল বনের সম্পদ ব্যবহার করে গ্রামবাসীর জন্য আয়ের ব্যবস্থা করা। প্রথম অবস্থায় ক্ষেত খামারের ব্যবহারের জন্য যন্ত্রপাতি তৈরির ওয়ার্কশপ করা হলো। কিন্তু বনের পুরোনো কিছু নিয়ম কানুনে কাজ আটকে গেল, কারণ এখানে ঠিকাদারী ভিত্তিতে সব কাজ হতো এবং চুক্তিভিত্তিতে শহর থেকে লোক নিয়ে কাজ করাতো ফলে সেখানে স্থানীয় লোকদের খুব কম আয় এবং বেশি কষ্টের কাজের জন্য নিয়োগ দেয়া হতো। সেই সময় গাছ কেটে বনের ভারসাম্য নষ্ট করা ছাড়াও গ্রামবাসীরা নানা প্রবঞ্চনার শিকার হয়েছিল। এরই সূত্র ধরে প্রথম ১৯৭৩ সালে এলাহাবাদের একটা স্পোর্টস কোম্পানিকে গাছ কাটা থামিয়ে দেয় এলাকাবাসী। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে বন বিভাগ রেনি গ্রামের কাছে অবস্থিত পেং মুরেন্দা নামক বনের প্রায় আড়াইহাজার গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় যে গ্রামটি ১৯৭০ এ অলকানন্দা নদীর বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছিল। ঋশিকেশের ঠিকাদার জগমোহন ভাল্লা ৬৮০ হ্যাক্টর জমি নিলামে নিয়ে গাছ কাটার কাজ শুরু করেন। ২৬ মার্চ ১৯৭৪ সালে রেনি গ্রামের নারীরা ঠিকাদারদের ফিরে যেতে বাধ্য করে। গাছদের করাত থেকে বাঁচাতে গাছকে জড়িয়ে রুখে দাঁড়ান সেই গ্রামের নারীরা। অলকানন্দা নদীতীরের সেই নারীরা সেদিন অপ্রতিরোধ্য ছিল, আটকে দিয়েছিল ঠিকাদারদের। সেই প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গৌরাদেবীসহ অন্যান্যরা। এটাই চিপকো আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, নারীদের অংশগ্রহণের কারণে সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয় কারণ সেদিনের সেই ঘটনায় শুধু নারীরাই অংশ নিয়েছিল। কিন্তু সেখানেই শেষ নয় এরা আবার ফিরে আসে আইনি কাগজ হাতে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। তখন সামনে আসেন সুন্দরলাল বহুগুণা যিনি চিপকো আন্দোলনের সমর্থক এবং সক্রিয় কর্মী ছিলেন। কিন্তু পাশাপাশি আর একটা তথ্য জানলে অবাক হবেন, তা হলো, এই আন্দোলনের মূলে ছিলেন তার স্ত্রী বিমলা। মাড়োরা গ্রামে তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং সুন্দরলাল স্ত্রীর পাশে দাঁড়ান। এভাবে নির্বিচারে গাছ কেটে ফেললে যে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয় সেই চেতনা সংগঠিত করতে পেরেছিলেন সুন্দরলাল। তিনি এই আন্দোলনকে হিমালয়ের চামেলি থেকে সংগঠিত করেছিলেন, প্রায় আড়াই বছর ধরে সাত হাজার কিলোমিটার পায়ে হেঁটেছিলেন এবং হাজার হাজার প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে পৌঁছে সেই গ্রামবাসীকেও আন্দোলনে একত্রিত করেছিলেন। তিনি আন্দোলনে সত্যাগ্রহ ও অনশন করেন, এই প্রতিবাদ ও আন্দোলনের বার্তা নিয়ে সুন্দরলাল পৌঁছে গিয়েছিলেন রাজধানী দিল্লিতে। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার আর্জি মেনে ১৯৮০ সালে পাহাড়ে গাছ কাটায় ১৫ বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এভাবে ১৯৮৩ সালে মূলত ইন্দিরা গান্ধীর একক প্রচেষ্টায় পরিবেশ সংরক্ষণের দাবিতে কেরালার নীরগিরি পাহাড়ের কুন্তী নদীর ওপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ হয়। ১৯৮০ সালে সুন্দরলাল বহুগুনাসহ আরও কয়েকজন নেতা ভাগীরথী নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতা করেন; যা পরবর্তীকালে ‘বীজ বাঁচাও আন্দোলন’ নামে পরিচিত। এ আন্দোলন আজও অব্যাহত রয়েছে।
এ আন্দোলনের আরো ইতিহাসে ফিরে গেলে দেখা যায় এর ভিত্তি রচিত হয় আরো দুই শতাব্দী আগেই। তখন ১৭৩০ সাল। রাজস্থানের প্রত্যন্ত অঞ্চল খেজারিলি গ্রামের রাজা অভয় সিং রাজপ্রাসাদ গড়ার উদ্দেশ্যে অসংখ্য গাছ কাটা শুরু করেন। আর এই কাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তিন সন্তানের মা অমৃতা দেবী, তার সাথে যোগ দেন গ্রামের বিষ্ণোয়ই সম্প্রদায়ের লোকেরাও। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যে করেই হোক গ্রামের গাছগুলোকে বাঁচাতে হবে। একইভাবে গাছের সাথে নিজেদের আটকে রেখে শুরু হয় প্রথম প্রতিবাদ। আর এভাবেই গাছকে জড়িয়ে ধরে রাখা অবস্থাতেই রাজার সৈন্যদের হাতে ৩৬৩ জনকে প্রাণ দিতে হয়েছিল।
১৯৬৩ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের অবসানের পর ভারতের উত্তরাখণ্ডে আন্দোলন আবার শুরু হয়। তখন উত্তরাঞ্চলের, বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলগুলোতে উন্নয়নের উদ্দেশ্যে বিদেশি সংস্থাগুলো ঐ অঞ্চলের বনজ সম্পদ ব্যবহার করতে চেয়েছিল এবং সরকারের অনুমতি পেয়ে শুরু হয়ে যায় বৃক্ষনিধন। অথচ জীবনধারণের জন্য বনজ সম্পদের ১০ শতাংশও ভোগ করতে দেয়া হতো না অঞ্চলের আদিবাসীদের। যাদের জন্ম ও জীবনধারণ ঐ প্রকৃতিকে ঘিরে তারা বনের সম্পদ ব্যবহারে নিগৃহিত হচ্ছিল প্রতিনিয়ত। অথচ বাণিজ্যিক কারণে এভাবে বৃক্ষনিধনের ফলে কৃষির ফলন কমে যাচ্ছিল, মাটি ক্ষয়, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে এসেছিল সমগ্র অঞ্চলটির ওপর। যা ভোগ করছিল গ্রামবাসীরা।
চিপকো পৃথিবীর পরিবেশ উন্নয়ন আন্দোলনগুলোর প্রথমদিককার আন্দোলন, তাই এটাকে ভিত্তি করেই ভবিষৎ পরিবেশ উন্নয়নগুলোর কথা ভাবা হয়। এই আন্দোলনের মূখ্য ভূমিকায় যারা ছিলেন তাদের মধ্যে চান্দি প্রসাদ ভট্ট ১৯৮২ সালে র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার এবং সুন্দরলাল বহুগুনা ২০০৯ সালে ভারতের পদ্ম বিভূষণ পুরস্কার পান। এ বছর ২১ মে সুন্দরলাল বহুগুনা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। চিপকো আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। অনেক নারীই অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের একজন ছিলেন মহিলা মঙ্গল দলের নেতৃত্বে, তিনি ছিলেন গৌরা দেবী। উনার বয়স যখন ২২ তখন তিনি এই আন্দোলনে যুক্ত হোন। তিনি বিধবা এবং এক সন্তানের মা ছিলেন। তিনি আদিবাসী ছিলেন। ১৯৭৪ সালে যেদিন গাছ কাটার উদ্দেশ্যে ঠিকাদাররা গ্রামে ঢুকেছিল তখন কৌশলে পুরুষদের গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। ওই সময় গৌরা দেবী এবং আরো ২৭ জন নারী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, করাতের সামনে নিজের প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন, ফলে গাছ কাটা বন্ধ করায় সফল হয়েছিলেন। কিন্তু এটা দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই আন্দোলনে আমরা পুরুষ নেতৃবৃন্দের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেখতে পাই কিন্তু নারীদের ইতিহাসে নাম থাকলেও সম্মাননাতে কারো কোনো নাম লেখা নেই।