নিজেদের মূল্যটা নাহয় নিজেরাই ঠিক করি!
ঝুমা বন্দ্যোপাধ্যায় ।। অর্থনীতিতে দুটো জিনিসের গুরুত্ব খুব বেশি। একটা হলো দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ ও দ্বিতীয়টি শ্রমবিভাজন। খুব স্বাভাবিকভাবেই দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে চাহিদা ও যোগানের সূচকগুলির ওঠানামা কাজ করে। চাহিদা ও যোগানের ওঠানামার ভিত্তিতেই দ্রব্যমূল্য নির্ধারিত হয়। সাধারণত ভোগ্যপণ্যের বাজারে মানুষ এই লাভ-ক্ষতি বিচার করে বিনিযোগ করে। উন্নত দেশগুলিতে মানবসম্পদ উন্নয়নের উপর জোর দেওয়া হয়। আর উন্নয়নশীল দেশগুলিতে মানুষের যোগান বেশি হবার জন্য মানুষ সম্পদে পরিণত হতে পারেনা। কারণ চাহিদার তুলনায় যোগান বেশি এবং অর্থনীতির তৃতীয় ক্ষেত্রটির বিকাশও সঠিকভাবে হয়নি। তদুপরি সামঞ্জস্যহীন বিকাশের প্রভাব সর্বত্র প্রকট।
মূল্যের বিচারে নারীরা এখনও মূল্যহীন। কেননা বাড়ির কাজ ও সন্তান উৎপাদনের মূল্য মেয়েরা চাইতে জানেনা। যত বড় শিক্ষিতই হোক, বড় চাকুরিজীবী হোক, দিনের শেষে অধীনতামূলক মিত্রতার নীতিকেই বেঁচে থাকার লাভজনক উপায় হিসাবে বেছে নেয়। এবং প্রয়োজনে সব রকম ধর্ষণ মেনে নেয়। তবে ব্যাতিক্রম অবশ্যই আছে। এ যুগেও যেমন আছে, আবার সে যুগেও ছিল। সবটাই নির্ভর করেছে মেয়েরা নিজেকে পরিবারের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণভাবে তুলে ধরেছে তার উপর।
মেয়েরা বিয়ের পরে ঘর, বর সন্তান সামলাবে এটা এখনো যেমন হয়ে আসছে, তেমনি ছেলেরা অর্থ উপার্জন করে সংসারে সহায়তা করবে এটাও ঘটছে। দুটো কাজই খুব গুরুত্বপূর্ণ পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ও প্রয়োজনের নিরিখে। এগুলো আমাদের সবার জানা কথা। যারা অর্থনীতির কচকচি বোঝেনা, তারাও খুব ভালোভাবে বোঝে। কিন্তু অবস্থার সাপেক্ষে নিয়মের পরিবর্তন, পরিমার্জন ঘটে। সামাজিক শ্রমবিভাজনের ক্ষেত্রটিও একটি বহুকাল যাবৎ পরীক্ষিত সত্য। আমাদের দেশের বর্তমানে census পরিসংখ্যানে নারী-পুরুষের অনুপাত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তথাকথিত উন্নত এলাকাগুলিতে নারীর সংখ্যা দ্রুত কমছে। প্রযুক্তির সহায়তায় কন্যাভ্রুণ হত্যার ব্যবসা গোপনে বিরাট ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এদিকে আমাদের দয়াবশত যে শিশু কন্যারা পৃথিবীর মুখ দেখছে, এগিয়ে যাচ্ছে, বড় বড় ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, তাদের সংখ্যাটাও ক্রমবর্ধমান। বিভিন্ন প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সাফল্য সেটাই প্রমাণ করে।
আবার এটাও দেখা যাচ্ছে, যে সমস্ত মেয়েরা সাফল্যের স্বাদ পাচ্ছে তারা নিজেদের কেরিয়ার নিয়ে ভাবতে শিখেছে। বিয়ে ও প্রেমের ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত চিন্তাভাবনা করতে শিখেছে। অনেকে বিয়েও করতে চাইছে না। এগুলো মেয়েদের সামাজিক মূল্য বাড়াচ্ছে। কিন্তু তবুও এটাই সত্যি, আমাদের দেশে মেয়ের সংখ্যা কম। হয়ত এই যোগান কমে যাওয়াটাই নারীকে তার নিজস্ব মূল্য বৃদ্ধিতে পরোক্ষভাবে সহায়তা করবে। সুতরাং সংখ্যা কমে যাওয়াতে ভয় পাবার কারণ নেই। বরং অসুবিধা ঘটবে নারী লোলুপ, নারী-বিলাসীদের। তাদেরকে জোর করে ভোগ করার পথ বেছে নিতে হবে।
কিছুদিন ধরে খবরের কাগজের পাতায় নারী নির্যাতন বিষয়ক সংবাদ বহুচর্চিত। এই সংবাদগুলো অত্যন্ত সাহসী মেয়েদের কেস ফাইলের ভিত্তিতেই সংবাদপত্রে উঠে আসে। নইলে কেই বা চায় অযথা হ্যারাসমেন্ট ভোগ করতে। পিংক সিনেমার বচ্চন সাহেবের মতো উকিল মেলাও তো ভাগ্যের কথা। না বলতে শিখতে গেলে সবার আগে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা দরকার নচেৎ চিরটাকাল কয়জন মহিলা মহাকাশ জয় করল, কজন অলিম্পিকে মেডেল পেল, অনুন্নত দেশগুলো থেকে কতজন প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হল, সেই পরিসংখ্যান নিয়েই ধুয়ে জল খেতে হবে। অথচ প্রদীপের নীচটা সেই অন্ধকারেই থেকে যাবে।
আমাদের সামাজিক ব্যবস্থায় তোষণ নীতি শোষণ নীতির থেকেও ভয়ঙ্কর। যত বড় দানবই হোক না কেন জামাই বাবাজীর শ্বশুরালয়ে আদরযত্নের কোনো ত্রুটি হয় না। সেই একই কারণ। মেয়েটি বোঝা। এবং ব্যতিক্রমী মূল্যবান মেয়েটিকেও হয় নির্বাসিত হতে হয় নতুবা বিচ্ছিন্নভাবে বাঁচতে শিখতে হয়। এইভাবে বিচ্ছিন্ন মেয়েদের সংখ্যাটাও দিন দিন বাড়ছে। পিছিয়ে পড়া শ্রেণির তকমাটি আর কতকাল বয়ে বেড়াতে হবে? এগিয়ে যাওয়ার শর্তই হল পিছিয়ে পড়ার কারণগুলির সঠিক অনুসন্ধান। সেই অনুসন্ধানের দায় যে পিছিয়ে পড়ছে তার উপরও বর্তায়। নিজেদের মূল্যটা নাহয় নিজেরাই ঠিক করি। দ্রব্যমূল্যের ভারসাম্যের মতো সামাজিক কাঠামোর সঠিক মূল্যায়নই পারে একটি সুস্থ সমাজব্যবস্থার জন্ম দিতে। কেউ কি চান একটি প্রেমহীন, ভালোবাসাহীন ধর্ষণ অনুকূল সমাজব্যবস্থা? নাকি শ্রমের সঠিক মূল্যমানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সুন্দর মানব সমাজ?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]