April 29, 2024
ফিচার ১সাক্ষাৎকার

প্রাণীদের জীবনবঞ্চিত করে যে আনন্দ লাভ করছেন, তা এক ফাঁপা আনন্দ

ক্যারল জে অ্যাডামস ১৯৯০ সালে রচিত যুগান্তকারী বই “দ্য সেক্সুয়াল পলিটিক্স অফ মিট” এর লেখক। তিনি “লিভিং অ্যামং মিট ইটার” এবং “প্রেয়ারস ফর এনিমেলস” সহ আরো বেশ কিছু বই লিখেছেন। অ্যাডামস ইউনিভার্সিটি অফ রচেস্টার এবং ইয়েল ডিভিনিটি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। ৭০ ও ৮০’র দশকের শেষের দিকে পশ্চিম নিউইয়র্ক এ  ইন্টারফেইথ এজেন্সিতে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

দিনের পর দিন শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত নারীদের জন্য তিনি হাউজিং কমিটি অফ দ্য নিউ ইয়র্ক গভর্নরস কমিশনে একটি হটলাইন প্রজেক্ট চালু করেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত এখানে তিনি চেয়ারপারসন হিসেবে কাজ করেন। তবে ১৯৮৭ সালে অ্যাডামস তার সঙ্গী রেভ ব্রুস ব্রুকানানের সাথে টেক্সাসের ডালাসে চলে যান। ব্রুকানান ঘরহারাদের জন্য একটি ডে সেন্টার চালান, অ্যাডামস সেখানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করেন। অ্যাডামস বর্তমানে কেয়ারগিভিং-এর উপর একটি মেমোয়ার (আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিকথা)-এ কাজ করছেন এবং সারা বিশ্বে “দ্য সেক্সুয়াল পলিটিক্স অফ মিট স্লাইডশো” নিয়েও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

Geez Magazine এ ক্যারলের এই সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয় ২০১৫ সালে। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য এটি অনুবাদ করেছেন  ফাতেমা তুজ জোহরা ।।

 

এমন অনেক চিন্তাশীল কর্মীকে আমি চিনি যারা বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার থেকে শুরু করে হোমোফোবিয়া (সমকামীদের প্রতি ক্ষোভ), ইকোসাইড (পরিবেশ ধ্বংসকারী), ইত্যাদি বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদেরও মৃত প্রাণীর মাংস খাওয়া নিয়ে তেমন কোনো মাথা ব্যথা নেই। এর কারণ কী?

সামাজিক বিভিন্ন ইস্যুতে ন্যায়বিচার নিয়ে চিন্তাশীলরা প্রাণীহত্যার মতো সহিংসতাকে কোনো সমস্যা হিসেবে দেখেন না কেন? আমার মতে এর বেশ কয়েকটি কারণ আছে। জন্মের পর থেকেই আমরা কিন্তু নিজেদের অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা জেনে বড় হয়েছি। আমরাই কথা বলি, আমরাই নিজের যুক্তি ও দাবি তুলে ধরি, আমাদেরই বিবেক আছে, আমাদেরই আত্মা আছে (হিব্রু শাস্ত্র অবশ্য ভিন্ন কথা বলে)। কাজেই অন্য প্রাণী থেকে আমরা ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রম হওয়ার যে চিন্তাধারা, এটাই মূলত অন্য প্রাণীর সাথে শ্রেণি বিভাজন তৈরি করে দেয়। শ্রেণি বিভাজনের এই সমস্যা দূর করার উপায় কী তাহলে? খুব সহজ। অন্য প্রাণীর সাথে মানুষের শ্রেণি বিভাজনের বিষয়টি ভুল প্রমাণ করা।

আমাকে প্রায়ই এটা জিজ্ঞাসা করা হয় যে পৃথিবীতে এতো মানুষ না খেয়ে আছে, তাহলে আপনি কেন অন্য প্রাণীদের নিয়ে কাজ করছেন? ক্ষুধার্ত মানুষের কথা কেন বলছেন না? এমনকি ৯০ এর দশকে আমি যখন আমেরিকান একাডেমি অফ রিলিজিয়নে ছিলাম, তখনও আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে পশু-পাখিদের নিয়ে চিন্তা করে আমরা কেন আমাদের সময় নষ্ট করবো? আমি বলবো এখানেই আসলে মানুষের ঐ ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্য কাজ করে। যেহেতু তারা নিজেদের প্রাণীদের চেয়ে উন্নত ভাবে, সে কারণেই তাদের ভাবনা চিন্তাতেও সেই চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছে। এই জিনিসটা আমি আখ্যায়িত করছি “রেট্রোগ্রেড হিউম্যানিজম” বা সহজে বললে মানবতার লোপ পাওয়া। অর্থাৎ এমন রিএকশন যেটি মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে যে মানুষের দুঃখ-কষ্টের দিকেই সবার আগে নজর দেয়া উচিত।

দ্বিতীয় সমস্যা হিসেবে আমি রেট্রোগ্রেড হিউম্যানিজমকে বলবো। মানুষের ক্ষুধা, পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমির অবক্ষয়, পানি দূষণ ইত্যাদি যেসব সমস্যা নিয়ে মানুষ প্রতিনিয়ত চিন্তিত, সেসবের সাথে প্রাণীর মাংস দুধের উৎপাদনেরও সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। অথচ মানুষ শুধুমাত্র তাদের সমস্যাকেই প্রাধান্য দেয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশিরভাগ প্রাণীই খামার করা প্রাণী, যাদেরকে আমি টার্মিনাল প্রাণী বলি। কারণ এদেরকে পোষা হচ্ছেই খাওয়ার জন্য। প্রাণীকে এখানে প্রাণী নয় বরং “হ্যামবার্গার” বা “চিকেন উইংস” জাতীয় খাদ্য হিসেবেই মানুষ দেখছে। এরা যে প্রাণী সে বিষয়ই মানুষের মগজ থেকে বেমালুম উড়ে গেছে। খাদ্যের কারণে একটি প্রাণীর জীবন নিয়ে নেয়া ন্যায় না অন্যায় সেসব দিক মানুষ একদমই ভাবছে না।

পৃথিবীটাই তো আসলে অন্যায়ে ভরা। আমরা নিজেদের প্রাণীদের থেকে আলাদা মনে করি, তাই নৈতিকভাবে প্রাণীদের সাথে কী ঘটছে তা নিয়ে আমরা খুব বেশি চিন্তিত নই। আমাদের বেঁচে থাকার তাগিদে অন্য প্রাণীদের দুর্ভোগের ব্যাপারটা আমাদের কাছে মানুষ হিসেবে অনেকটাই স্বাভাবিক।

রেট্রোগ্রেড হিউম্যানিজমে সামাজিক সমস্যাগুলোর একটা শ্রেণিভাগ বা ক্রম রয়েছে। অ্যানিমেল লিবারেশনে পিটার সিঙ্গার বলেছিলেন, “প্রথমে হলো কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তি আন্দোলন, তারপর হলো নারী মুক্তি আন্দোলন, তারপর সমকামী মুক্তি আন্দোলন, এখন সময় এসেছে পশু মুক্তি আন্দোলনের।” যেন প্রত্যেকটা সমস্যার গুরুত্বেরই কিছুটা কম-বেশি রয়েছে এবং পশু মুক্তি আন্দোলন শুরুর আগের আন্দোলনগুলির হয়তো সফল হয়েছে।

কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় ভুলটা হলো যেসব সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো কিন্তু সমাধান করা হয়নি। নারীমুক্তি বলুন, বা সমকামী আন্দোলনের কথাই বলুন না কেন, কোনোটারই কিন্তু এখনো সমাধান হয়নি। “নিদার ম্যান নর বিস্ট”-এ আমি তাই বলতে চেয়েছি যে যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ নিজেকে ঠিক অন্য কোনো প্রাণীর মতই ভাবতে পারবে না, ততক্ষণ অন্য প্রাণীরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।

“নারীবাদের মৌলিক ধারণা হল নারীরাও মানুষ” এরকমটাই দাবি করা হয়, যদিও আমার ধারণা ঠিক এরকম নয়। আমি মানুষের এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে চাই। শুরু থেকেই বহু শতাব্দী ধরেই ইউরোপীয় সাদা পুরুষরা এই ধারণা মানুষের মনে গেঁথে দিয়েছে। সেখান থেকেই আপনি নিজেকে বোঝাতে শিখেছেন যে আপনি যুক্তিবাদী কিন্তু আবেগপ্রবণ নন, আপনি স্বায়ত্তশাসিত কিন্তু ইন্টারকানেক্টেড নন। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে আমরা কেউই কিন্তু স্বায়ত্তশাসিত নই। আমরা নিজে নিজে হাঁটতে বা কথা বলতে শিখি না, আমাদের সমাজ আমাদের শেখায়। কাজেই আমরা আমাদের নিজেদের কাছে সীমাবদ্ধ। আমরা বুঝতেই পারিনি যে মানুষও কিন্তু এক ধরনের প্রাণীই, আর কিছু না।

দ্য সেক্সুয়াল পলিটিক্স অফ মিট” এর প্রায় পুরোটা জুড়েই আপনি বলেছেন যে প্রাণীদের “এটি” বলে সম্বোধন করলে তাদের লিঙ্গ পরিচয়ের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়। তাদের পরিচয় বাদ দিয়ে শুধুমাত্র দেহসর্বস্ব বা খাদ্য হিসেবে দেখা হয় কারণ বিশ্ব জুড়ে আমাদের ভাষাগত সমস্যা রয়েছে। এখন যে মানুষটি এই ধরনের বিষয়ে সচেতন, সে কীভাবে তার ভাষা পরিবর্তন করতে শুরু করতে পারে? বা আমরা যেভাবে কথা বলি তা যে আমাদের দেখার চোখেও প্রভাব ফেলে সেটা আমরা কীভাবে বুঝবো? 

আমরা পশুদেরকে নিজেদের ভাষায় অনুপস্থিত রাখি যাতে তাদের আইডেন্টিটি না থাকে। কাজেই তাদের যখন খাওয়া হয় বা অন্য যে কোনো নিপীড়ন হয়, তাদের কোনো আইডেন্টিটি থাকে না। শেখাটা আসলে একটা লম্বা প্রক্রিয়া। বহু বছর ধরে যারা প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করছেন তারাও দেখবেন “নিষ্ঠুর” শব্দটি ব্যবহার করে। শব্দটি এসেছে বর্বর থেকে যার আরেক অর্থ পশু। কাজেই অর্থ দাঁড়াচ্ছে পশুকে আঘাত করার ক্ষেত্রে আপনি পশুর মত আচরণ করছেন। তাই বলছি যে আমরা সেসব শব্দ বাদ দিতে চাই যেগুলোতে নিপীড়নের মনোভাব বজায় থাকে।

“পর্নোগ্রাফি অফ মিট”-এ আমি মানুষের বিভিন্ন আচরণকে কীভাবে পশুর সাথে তুলনা করা হয় এটা দেখাতে চেয়েছি। উদাহরণস্বরূপ, একজন ধর্ষককে যখন আমরা পশুর সাথে তুলনা করি তখন আমরা বোঝাতে চাই যে মানুষ তার এই প্রবৃত্তিটি আসলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। অথচ মানুষের এই আচরণ কিন্তু খুবই ইচ্ছাকৃত এবং পরিকল্পিত। অথচ মানুষ এটা স্বীকার করার পরিবর্তে এটাকে তাদের “পশু” স্বভাব বলে পার পেয়ে যায়। কাজেই, মানুষ তার বাস্তব জীবনের সমস্ত মানবিক কাজের জন্য নিজেদের মানুষ পরিচয়কে দায়ী করে আর সহিংস যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে সেটাকে পশু প্রবৃত্তি আখ্যা দেয়। অথচ প্রাকৃতিকভাবে সমস্ত প্রাণীই কিন্তু হিংস্র।

সেক্সুয়াল পলিটিক্স” বইটিতে আমার প্রিয় একটা লাইন হলো, “যেহেতু পুরুষের পতনের জন্য দায়ী নারী এবং পশু, কাজেই পুরুষের ভ্রাতৃত্ব নারী এবং পশু দুটোকেই বাদ দেয়।” মানুষ কে আর ব্রাদারহুডের অন্তর্গত কারা এটা বুঝতে জুডিও-খ্রীস্টান অরিজিনের গল্পের গুরুত্ব কতখানি?   

কিছু মানুষের জন্য বাইবেল হলো মানবিকতা রক্ষাকারী কবচ। তারা কিন্তু বাইবেলের সাথে পুরোপুরি সম্পৃক্ত নন। কিন্তু বাইবেল “সমকামী” নিয়ে যা কিছুই বলে, চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে। বাইবেলে যেমন বলা আছে নারীরা ধর্মযাজক হতে পারবে না, এটাও কিন্তু অনেকেই চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে। বাইবেলে কথিত কোনো কথা নিয়ে এক সময় তর্ক করা যেত না। কিন্তু যে বিষয়গুলো আমি মেনে নিতে পারছি না বা গ্রহণ করতে চাচ্ছি না, সেগুলোও বাইবেলে কথিত বলে মেনে নেয়াটা বিরক্তিকর। বাইবেল তো শুরু থেকেই বিশ্বাসের সীমানা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এখন আমি যদি কাউকে জিজ্ঞাসা করি যে আপনি কি হস্তমৈথুন করেন, এর উদ্দেশ্য একটাই, বাইবেলের অনুচ্ছেদগুলির অসঙ্গতিপূর্ণ ভণ্ডামিগুলোকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া। কারণ মানুষ হস্তমৈথুন করে ঠিকই, কিন্তু স্বীকার করে না।

জেনেসিস ১:২৬ এ বলা হয়েছে যে আমাদেরকে প্রাণীদের উপর “কর্তৃত্ব” দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কর্তৃত্ব যাই হোক না কেন পুরোটাই ভিগান পৃথিবীকে নির্দেশ করে। তাহলে ধর্মযাজকেরা এইসব কথার উলটো মানে করে সেগুলো কেন প্রচার করেন? তারা কেন ভাবতেই পারেন না যে তাদের নিজস্ব কাঠামোর মধ্যে তারা নিজেরাই অবাধ্য হিসেবে কাজ করছেন?

“গুড নিউজ ফর অ্যানিম্যালস” বইটির লেখক বেশ চমৎকার কিছু কথা বলেছেন। লেখকের প্রশ্ন ছিলো মেনোনাইট ধর্মাবলম্বী কৃষকেরা শূকরের এতো বড় খামার কীভাবে তৈরি করলো? উত্তর ছিলো, মেনোনাইটরা শূকরদের স্বাভাবিক এবং স্বভাবজাত প্রবৃত্তি নষ্ট হতে দেয়নি। তাদের এই কাজ আমাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। সত্যিই তো, আমরা কত সহজে ঈশ্বরপ্রদত্ত জীবনের স্বার্থকতাকে অস্বীকার করি।

ঠিক এ কারণেই আমি প্রায় ধর্মযাজকদের প্রচারিত কথার বাইরে যেতে চাই।

“লিভিং অ্যামং মিট ইটার”-এ আমি বলেছি যে মানুষ নিরামিষভোজী হয়েও দারুণভাবে জীবন উপভোগ করতে পারে যদি সে জানে যে আসলেই সে কোন উদ্দেশ্যে নিরামিষাশী হয়েছে। এরা কখনো আপনার প্রতি আক্রমণাত্মক হবে না। ভালো খাবার পেলেই যথেষ্ট। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আনন্দ। নিজের খাবারের ব্যাপারে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারার আনন্দ অন্যরকম। এই আনন্দ আপনি অনেক সময় অন্যের বাসায় দাওয়াত খেতে গেলেও পাবেন না। কারণ দাওয়াতে আপনি কী খাবেন তা আপনার উপর নির্ভর করে না। এখানে আপনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন না। যদিও আতিথেয়তা মানেই তাই।

মানুষ পেটের সাথে তর্ক করে উঠতে পারে না বলেই যিশু এবং শূকর নিয়ে তর্কে জড়ায়। নিরামিষাশী মানুষেরা একদম সাধারণভাবে শুধু তাদের খাদ্যাভাস পরিবর্তনে আগ্রহী নন। নিরামিষাশীদের পেট বা মন কোনোটাই আসলে খাবার গ্রহণের সময় মাংস খাচ্ছে না সবজি, সেটা খেয়াল করে না। টেস্টি খাবার পেলেই হলো। কাজেই আমিও মানুষকে মনে করে দিতে চাই না যে আপনি নিরামিষ খাবার খাচ্ছেন। বরং আমি ভাবতে পছন্দ করি যে তারা নিজেরাই বলবে নিরামিষ খাবারটি সুস্বাদু ছিল। এভাবেই ভিগান খাবার ছড়িয়ে পড়বে।

সেক্সুয়াল পলিটিক্স” বইটিতে আপনি স্পষ্ট করে বলেছেন যে আপনি একজন সাংস্কৃতিককর্মী, শিক্ষাবিদ নন। আপনি বহু দশক ধরে নির্যাতিত নারীদের সাহায্য করার জন্য এবং পশু অধিকারের সাথে জড়িত ছিলেন। বিষণ্ণ হওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখেন কীভাবে?

সুসান বি অ্যান্টনির দারুণ কিছু কথা আছে, উনি কীভাবে সবসময় ভালো সঙ্গী পেতেন সেই বিষয়ে। উনি কখনোই একা ছিলেন না। ভ্যাক্লাভ হ্যাভেল বলেছিলেন, বিশ্বকে পরিবর্তন করার জন্য আমরা যা করছি তাই করে যেতে হবে। আমরা জানি আমরা হয়তো জিতবো না। সবকিছু তো সাফল্য দিয়ে মাপা যায় না। এটা অনেকটা ইকোফেমিনিজমের মতো।

আমি বলছি না যে আমি হতাশ হই না। আমি বলছি না যে আমি উদ্বিগ্ন হই না। পৃথিবীতে বিদ্যমান সমস্ত ভুল সম্পর্কে কেবল আপনিই জানেন এমন তো নয়। কিন্তু তারপরেও বেঁচে থাকতে হবে। প্রিয় কুকুরের সময় উপভোগ করতে হলেও বেঁচে থাকতে হবে। সাধারণত আমি রান্নায় আনন্দ পাই। আমি মানুষের সাথে দেখা করতে বা নিরামিষ রেসিপি সম্পর্কে কথা বলতে আনন্দ পাই। আমি জানিনা এই মুহুর্তে জানি না যে ভিগানরা যখন একসাথে হয় তারা সব সময় রেসিপি নিয়েই আলাপ করে কি না, তবে আমার রেসিপি নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে।

মানুষ মনে করে যে আমরা তদেরকে জীবনের আনন্দই ছেড়ে দিতে বলছি হয়তো। কিন্তু না, আমরা কেবল তাদের উপলব্ধি করতে বলছি যে তাদের আনন্দের উৎস পরিবর্তিত হতে পারে। প্রাণীদের জীবন থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে আপনি যে ধরণের আনন্দ লাভ করছেন তা এক ফাঁপা আনন্দ।

ধর্মশালায় মৃত্যুর সময় বলা হয় যে আপনি আশা ছাড়বেন না। তবে আমার মা বেঁচে থাকবেন এমন আশা আর করেন না, বরং আশা করেন তার একটি ভালো মৃত্যু হবে।

কিছু কিছু আমিষভোজী মানুষ আছেন যারা এমন ভাব করেন যে মাংস খাওয়া ছেড়ে দিলে তাদের জীবনের সব আনন্দ মাটি হয়ে যাবে। আসলে কিন্তু তা নয়। ভিগান হয়ে আপনি শুধুমাত্র আনন্দের জন্য অন্য উৎস খুঁজে নিচ্ছেন। তবে এর জন্য সময় লাগে, চেতনা লাগে।

লোকেরা আমাকে বলে, যে আমি যদি তাদের জন্য রান্না করে দেই তাহলে তারা নিরামিষভোজী হয়ে যেতে রাজি। বেশ, তাহলে রান্না শিখে ফেলুন। আমি হুইসিন সস দিয়ে মিষ্টি আলুর একটি রেসিপি পারি। এটা খুব সহজ। আলু কেটে সসে মাখি, বেক করে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে মজাদার একটি রেসিপি। খুব বেশি ঝামেলার নয়। এরকম নানারকম ফলের সালাদ তৈরিও খুব সহজ। জীবন নিয়ে চিন্তা করুন। এই সুন্দর পৃথিবীতে আপনি এসেছেন, ভালো খাবার খাচ্ছেন, বেঁচে আছেন, এইতো অনেক, এই তো আনন্দের।

এটা আলাদা বিষয় যে আমিষভোজীরা খুব বেশি কিছু জেনে ফেলাকে ভয় পায়। কারণ সব জেনে গেলে প্রাণী হত্যা করে খাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। এই দুঃখবোধই তাদের মেরে ফেলবে। “প্রেয়ারস ফর অ্যানিম্যালস” বইটিতে আমি প্রাণীদের জন্য সত্যিই প্রার্থনা করেছি। আমার তাদের জন্য খারাপ লাগে। এই খারাপ লাগা যে আমাদের ধ্বংস করে দিচ্ছে তা নয়। মানুষ যখন মারা যায়, তখনও তো আমাদের কিছু করার থাকে না, হাত পা বাঁধা থাকে, তবুও আমরা দুঃখবোধ করি। প্রাণীদের ব্যাপারেও অনেকটা সেরকম।

দুঃখ নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে, এমন নয়। আবার এটাকে নির্মূল করতে হবে এমনও নয়। আমি এটাও বলছি না যে তিন দিন দুঃখ করে তারপর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে। বরং এমন একটি উপায় বের করুন যাতে করে দুঃখ আপনার সাথেই থাকে, বন্ধুর মত। এই পৃথিবীতে দুঃখ করার মত অনেক কিছুই আছে। প্রাণীদের সাথে যা ঘটছে তা দুঃখজনক। তবে আমি মানুষকে জানাতে চাই যে এই দুঃখ আমাদের ধ্বংস করে না। বরং এটা আমদের বুঝতে সাহায্য করে যে পশুদের সাথে কী ঘটছে, এটা কতোটা যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু মানুষ যখন জানতে চায় না, বুঝতে চায় না, যারা অজ্ঞ থাকতে চায় এবং নিজেকে দুঃখবোধ থেকে দূরে রাখতে চায়, তারা স্বার্থপর।

একটা কারণ হতে পারে যে আমাদের তো সেই মানসিক শিক্ষাই নেই যা আমাদের শেখাবে যে এসব দুঃখবোধই আমাদের আরো বেশি মানবিক করে তুলবে। দুঃখবোধই আপনাকে মানুষ হতে সাহায্য করে। আমাদের তো এই পৃথিবীতে শোক পালন করা উচিত। এই পৃথিবীতে কেবল আনন্দ অনুভব করা মানে আরো অনেক অনেক কিছু থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা। আমি যে সুস্বাদু ভিগান খাবার রান্না করি, এটা বানাতে যেমন আনন্দ পাই, পশুদের সাথে ঘটে যাওয়া অমানবিক সহিংসতার প্রতি আমার দুঃকবোধ সেই আনন্দের সাথে সহাবস্থান করে।

আমার কাছে ন্যায়বিচার মানে এমন একটি পৃথিবী যেখানে সমস্ত প্রাণী মিলে একে অপরের সকল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেওয়া হবে এবং এমন এক বিশ্ব তৈরি যেখানে সকল প্রাণী সহাবস্থান করবে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *