বেল হুকস: সাদা থেকে কালো নারীর মুক্তিকে আলাদা করতে পেরেছিলেন যিনি
ফাতেমা তুজ জোহরা ।।
আমেরিকান লেখক, অধ্যাপক, নারীবাদী এবং সমাজকর্মী গ্লোরিয়া জিন ওয়াটকিনস বিশ্বব্যাপী বেল হুকস নামেই পরিচিত। বেল হুকস নামটি তিনি নিয়েছেন তার প্রমাতামহী বেল ব্লেয়ার হুকসের নাম থেকে। তার প্রমাতামহী ছিলেন অসম্ভব সাহসী এবং স্পষ্টবাদী যার কারণে পেন নেইম হিসেবে গ্লোরিয়া এ নামটি গ্রহণ করেন।
নানারকম নারীবাদী তত্ত্ব, ব্ল্যাক ফেমিনিজম, শ্রেণিবিভাজন, লিঙ্গ বৈষম্য, পুঁজিবাদ, জাতিগত বিভাজনই তার লেখার মূল প্রতিপাদ্য। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০টিরও বেশি বই এবং অসংখ্য আর্টিকেল তিনি প্রকাশ করেছেন যার সবগুলোই প্রায় নারীবাদ, শ্রেণি বৈষম্য, যৌনতা, জাতিবিভাজন, কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন ইত্যাদি নিয়ে লেখা। তার প্রকাশিত এই বই এবং আর্টিকেলগুলো থেকে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু ডকুমেন্টারি ফিল্ম।
সাড়া জাগানো বই “Ain’t I a Woman?: Black Women and Feminism’’-এর লেখক বেল হুকস জন্ম নেন ১৯৫২ সালে, কেন্টাকির একদম ছোট্ট একটি শহর হপকিনসভিলেতে। তার বাবা বায়োডিস ওয়াটকিনস ছিলেন একজন প্রহরী ও মা ছিলেন গৃহকর্মী। ৬ ভাই-বোনের বিশাল সংসারে বেড়ে ওঠা গ্লোরিয়া জিন ওয়াটকিনসের স্কুল জীবন শুরু হয়েছিলো কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য তৈরি আলাদা একটি স্কুলে। তার ভাষ্যমতে, এখান থেকেই জীবনে স্বাধীনতার পাঠ নেয়া শিখেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে যখন তিনি শ্বেতাঙ্গদের সাথে কম্বাইন্ড স্কুলে ভর্তি হন, তখন জীবনের একটি বড় প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন। দারুণভাবে শ্রেণিবৈষম্যের শিকার হলেও তিনি সফলভাবে কয়েক বছর লেখালিখি ও শিক্ষকতার পর ১৯৮৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে সাহিত্যে বেল ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তার গবেষনার বিষয় ছিলেন আমেরিকান ঔপন্যাসিক টনি মরিসন।
১৯৭৮ সালে “And There We Wept” শিরোনামে বেল হুকসের প্রথম বই প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় বিখ্যাত “Ain’t I a Woman?: Black Women and Feminism’’ যার মূল প্রতিপাদ্য ছিলো কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের অধিকার। ব্ল্যাক ফেমিনিজম নিয়ে তার মৌলিক চিন্তা ও যুক্তির অনন্য এক প্রতিচ্ছবি এই বইটি। এছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে Feminist Theory: From margin to Centre, Teaching to Transgress: Education as the Practice of Freedom, Teaching Community: A Pedagogy of Hope, All About Love: New Visions ইত্যাদি।
কেরিয়ারের শুরুর দিকে বেল সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে এথনিক স্টাডিজের সিনিয়র লেকচারার হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৮০ এবং ৯০ এর শতকে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, সান্তা ক্রুজ, সানফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইয়েল ইউনিভার্সিটিসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার কাজ করেছেন।
১৯৮১ সালে সাউথ এন্ড প্রেস যখন তার বিখ্যাত রচনা “Ain’t I a Woman?: Black Women and Feminism’’ প্রকাশ করে তখন আমেরিকাতে মূলত নারীবাদী আন্দোলন জুড়েই শেতাঙ্গদের প্রভাব বেশি ছিল। মূলধারার নারীবাদ আন্দোলনে শ্বেতাঙ্গ, উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত নারীদের দুর্দশার বিষয়গুলো থাকলেও বর্ণবাদ উপস্থিত ছিল বিধায় কৃষাঙ্গ নারীদের অবমূল্যায়ন নিয়ে কোনো আন্দোলন ছিল না। সে সময় তিনিই কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের উপর যৌনতা ও বর্ণবাদের প্রভাব, তাদের অবমাননা, এই অবমাননায় মিডিয়ার ভূমিকা, শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য এবং পুঁজিবাদের সম্পর্ক একসাথে তুলে ধরেন। কালো নারীরাও নারী, নারীবাদী আন্দোলনে তাদের অবমূল্যায়নের কথাও বলতে হবে- এই বিষয়টি তিনিই প্রথম নারীবাদী আন্দোলনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেন। মূলত এই বইটি প্রকাশ পাওয়ার পর থেকেই বেল হুকস উত্তর-আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও সমালোচক হিসেবে বিশ্বে পরিচিত হন।
নারীবাদ কী?- এ প্রশ্নের উত্তরে বেল বলেছিলেন, পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গভিত্তিক শোষণ ও নীপিড়ন অবসানের নামই নারীবাদ। ১৯৮৪ সালে তার প্রকাশিত Feminist Theory: From margin to Centre-এ তিনি কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের সামাজিক অসমতা নিয়ে লেখেন। পশ্চিমা সমাজে গরীব এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের মুক্তি আর শ্বেতাঙ্গ উচ্চবিত্ত নারীদের মুক্তির ধরণ এক নয়। কৃষ্ণাঙ্গ নারীটিকে এখানে বারবার মনে করে দেয়া হয় যে সে এই সমাজের সামাজিক মাপকাঠির অনেক নিচু স্তরে বাস করে।
নারীবাদ তত্ত্বকে তিনি আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-লিঙ্গ নির্বিশেষে সমতা অর্জনই নারীবাদ। তাই নারীবাদে সমতা আদায়ের লক্ষ্যে শুধু নারীকে নয়, পুরুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। এভাবেই একদিন সমাজে নিপীড়ন দূর হবে। নারীবাদ আন্দোলন মানে পুরুষ বিরোধী আন্দোলন নয়। তাই সব বর্ণের, সব গোত্রের নারী অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নারী পুরুষকে একসাথেই কাজ করতে হবে।
বেল এর লেখায় ধর্মভিত্তিক সমাজে নারীর পুরুষের অধীনে থাকার বিষয়টি খুব চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। নারীর মননে ও মগজে পুরুষতান্ত্রিকতার আধিপত্য রয়েছে হাজার বছর ধরে। নারী ঘরের বাইরে কাজ করেও তাই পুরুষতান্ত্রিক আচার-ব্যবহারের বাইরে সহজে বের হতে পারে না। পুরুষ আধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্লান্তিকর আন্দোলন থেকেই নারীবাদের জেগে ওঠা। তাই নারী স্বাধীনতার সংগ্রামে পুরুষ আধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ পাওয়া স্বাভাবিক। শুরুর দিকের নারীবাদ আন্দোলনে তাই পুরুষের প্রতি ক্ষোভ ছিল। তবে বেল হুকসের কথা অনুযায়ী, নারীবাদ নারী ও পুরুষের অধিকারের সমতা চায়। এবং সেই সাথে পুরুষতান্ত্রিক লিঙ্গ বৈষম্য দূর করলেই একমাত্র নারীবাদের উদ্দেশ্য সফল হয়। এখানে পুরুষ বিরোধিতার কোনো স্থান নেই। তার এই তত্ত্বের জন্যেই অনেক জায়গায় বেল দারুণভাবে সমালোচিতও হয়েছেন।
১৯৯৪ সালে প্রকাশিত Teaching to Transgress: Education as the Practice of Freedom বইতে বেল তুলে ধরেন শিক্ষা কীভাবে একজন শিক্ষার্থীকে জাতি-ধর্ম-বর্নের উর্ধ্বে চিন্তা-ভাবনা করতে শেখায়। এই বইটির সফলতার ধারাবাহিকতায় প্রায় ১০ বছর পর বেল লেখেন Teaching Community: A Pedagogy of Hope. এই বইতে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে শিক্ষক এবং ছাত্র পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক হয়ে কাজ করতে পারে। শিক্ষাই একটা মানুষের মানসিক স্বাধীনতার মূলমন্ত্র যা বেল প্রতি পদে পদে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের জীবনের অসংখ্য অপমান ও নির্যাতনের বিরোধিতা করার জন্য লিখে গিয়েছেন বেল হুকস। তার Black Looks: Race and Representation বইতে কালোদের শোষণের কথা লিখতে গিয়ে লেখে, কালোদের তাদের শ্বেতাঙ্গ মালিকদের দিকে চোখ তুলে তাকানোর অধিকারও ছিল না। বেল ছোটবেলায় সাহস করে চুরি করে এক শ্বেতাঙ্গের দিকে তাকিয়েছিলেন এবং তখনই তার শিশুমনে কালোদের এই বাস্তবতা পরিবর্তনের চিন্তার সূচনা ঘটে।
সে সময়ের আমেরিকান মিডিয়া ছিলো ভয়াবহ রকম বর্ণবাদী। মিডিয়ায় কালো নারীদের উপস্থাপন করা হতো শ্বেতাঙ্গ নারীদের দাসী হিসেবে। সেক্স অব্জেক্টের বাইরে অন্য কোনোভাবেই কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের দেখা হতো না। পরবর্তীতে জুলি ড্যাশ, জিনাবু ডেভিসের মতো কৃষাঙ্গ নারীরা মিডিয়ায় সিনেমা বানানো শুরু অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়।
বেল হুকস শিক্ষাকে মানুষের স্বাধীনতার একটি বড় মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ৬৯ বছর বয়সী এই রাজনীতিক নারীবাদী তার লেখার জন্য পুলিৎজার পুরষ্কার, ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড, হেমিংওয়ে অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। তার জীবনে প্রভাব রয়েছে আফ্রিকান-আমেরিকান নারীবাদী সোজার্নার ট্রুথ, ব্রাজিলিয়ান শিক্ষাবিদ পাউলো ফ্রেয়ার, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রসহ আরো অনেকের। ২০১৪ সালে কেন্টাকিতে তিনি বেল হুকস ইন্সটিটিউট নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে বিভিন্ন নারীবাদী, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীদের জীবন ডকুমেন্ট আকারে সংরক্ষিত হয়।