ওমেনিজম: ফেমিনিজম থেকে কি আলাদা?
অর্চি সাহা ।।
“ছিঃ মেয়েদের মত কাঁদিস কেন, লজ্জা করে না?” কিংবা “মেয়েদের মত এতো ধীরে দৌড়াস কেন?” দুর্বল (!) পুরুষদের এভাবে মেয়েদের সাথে তুলনা করাটা আমাদের সমাজে একটা ডাল ভাতের মত ব্যাপার। যেন দুর্বলতা মেয়েদের চিরায়ত। ছেলেরা দুর্বল মানেই মেয়েলি। অথচ এমনও সমাজ আছে যেখানে মেয়েলি বা “ওমেনিশ” শব্দটার মানে দুর্বল তো নয়ই বরং মাত্রাতিরিক্ত বা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সাহসী, নিজের ইচ্ছায় চলার মত প্রত্যয়ী, প্রবল জ্ঞানপিপাশু মেয়েদের বোঝায়।
বলছি কৃষ্ণাঙ্গ লোককথার কথা, যেখান থেকে এই শব্দের বুৎপত্তি। কৃষ্ণাঙ্গ মায়েরা তাদের মেয়েদের মধ্যে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত এই গুণগুলো দেখতে পেলেই বলেন, “বেশি ‘মেয়ে’ (ওমেনিজ) হয়ে গেছ নাকি!” ইংরেজি সাহিত্যে ওমেনিজ শব্দটির পরিচয় ঘটান এলিস ওয়াকার তার ইন সার্চ অফ আওয়ার মাদারস গার্ডেনস: ওমেনিস্ট প্রোজ (১৯৮৩) বইটিতে। তার মতে ওমেনিস্ট শব্দটা ফেমিনিস্টের সমার্থক। কিন্তু ওমেনিজ বলা যায় শুধু মাত্র কৃষ্ণাঙ্গ বা বাদামি বর্ণের নারীবাদীদের। কেন? চলুন একটু ফিরে তাকানো যাক।
নারীবাদ কী? খুব সহজ কথায় হল সমানাধিকারের লড়াই থেকে নারীবাদের উৎপত্তি। হোক তা লিঙ্গ, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে। পৃথিবীতে প্রকৃতি বলুন, বন্যপ্রাণী বলুন বা নারীপুরুষ বলুন, বঞ্চিত মানেই তা নারীবাদের আলোচনার বিষয়। কিন্তু নারীবাদের ইতিহাসের শুরুতেই সব নারীর তা চর্চার অধিকার বা অংশগ্রহণ ছিল না। নারীবাদ সব নারীদের নিয়ে আলোচনা করত না এই কিছুদিন আগেও। নারীবাদের আঁতুরঘর খোদ আমেরিকাতেও কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা ছিলেন অবহেলিত। শ্বেতাঙ্গদের সাথে একই স্কুলে পড়ার মত অধিকার আদায় করেন রুবি ব্রিজেস, খুব বেশিদিন আগে না, মাত্র ১৯৬০ সালে। বর্ণবাদী সমাজের নারীবাদে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের অন্তর্ভুক্তি ছিল না বললেই চলে। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ ও ৮০’র দশকে শুরু হয় শ্বেতাঙ্গ নন এমন নারীদের লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন। তারাই এই চিন্তার সূচনা করেন যে নারীবাদে কেবল সমাজের উচ্চ বা মধ্যবিত্ত শ্বেতাঙ্গ নারীই না, নিম্নবিত্ত কৃষ্ণাঙ্গ নারীদেরও অন্তর্ভুক্তির অধিকার আছে। তাদের জীবন অভিজ্ঞতা ও বঞ্চনার কথা শ্বেতাঙ্গ নারীবাদীরা বলেন না, কারণ তারা এই বিষয়ে খুব সচেতনও না। সত্যি বলতে এই প্রবৃত্তি থেকেই মূলধারার নারীবাদের সাথে কালো এবং বাদামি বর্ণের নারীরা একাত্মতা বোধ করেন না। তাই এলিস ওয়াকার ভাবলেন কালো মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করে এমন একটি শব্দ দরকার যা নারীবাদের সমার্থক। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল এই যে নারীবাদ আর ওমেনিজম একই অর্থে মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।
ওমেনিজম শব্দটার প্রয়োজনীয়তা কী তা একটু দেখা যাক। আজকের যুগেও এই মূলধারার নারীবাদ ও ওমেনিজম- এই বিভাজনটা কতটুকু প্রাসঙ্গিক? নারীবাদের শুরুর ইতিহাস, সেই উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে বিংশ শতকের শুরুতে শহরকেন্দ্রিক শিল্পায়ন ও উদার সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রাক্কালে যার সূচনা, নাগরিক সমাজ মনে করতেন নারীরা নীতিগতভাবে পুরুষদের থেকে উন্নত তাই নারীদের উচিত সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেশি অংশগ্রহণ করা। কিন্তু এই অংশগ্রহণে কালো নারীরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। কারণ তখনও তাদের শ্বেতাঙ্গদের সাথে বাসে, ট্রামে ওঠার সাধারণ অধিকারটুকু পর্যন্ত নেই। মূলধারার নারীবাদ যখন ব্যস্ত সাদা নারীদের ভোটাধিকার আদায়ে, তৃণমূল কালো নারীদের সমাজে অংশগ্রহণ ও অবদান তখন পুরোপুরি নিগৃহীত। মূলধারার নারীবাদীরা কালোদের নিজেদের অংশই মনে করতেন না। যার ফলে কালো নারীরাও দেখতে পেলেন নারীবাদ আন্দোলনের অগ্রযাত্রায় তাদের সমাজের প্রতিনিধির ভূমিকা, সমস্যা, দাবি নিয়ে আলোচনা সামান্য থেকে নেই বললেই চলে। সেই নারীবাদ আন্দোলনের এখন চতুর্থ ঢেউ চলছে, কিন্তু কালো নারীদের অধিকার আদায়ের বাস্তবতা শ্বেতাঙ্গদের থেকেও দূরবর্তী। আসলে মূলধারার নারীবাদ যা এড়িয়ে চলে তা হল বর্ণবাদ, তাদের লড়াইটা খুব একপেশে লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে।
বলার অপেক্ষা রাখে না ওমেনিজম শব্দটি কালো বা বাদামি বর্ণের নারীদের অধিকারের কথা বলে। কিছু কৃষ্ণাঙ্গ নারী আন্দোলনকারীর বক্তব্যে জেনে নেয়া যাক এখনও এই বিভাজন প্রাসঙ্গিক কিনা। পলা গিডিঙস, একজন আফ্রিকান-আমেরিকান ইতিহাসবিদ ও লেখক বলছেন, “আধুনিক নাগরিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও নারীদের আন্দোলন সমসাময়িক সময়ে বিবর্তিত, কালো নারীবাদীদের যদি বলা হয় এ দুটোর মধ্যে যে কোন একটা বেছে নিতে, তবে মুশকিল। কারণ আমরা কৃষ্ণাঙ্গরা জাতি ও লিঙ্গকে আলাদা সত্তা ভাবতে পারি না। এই প্রসঙ্গে ব্রিয়ানা ব্লেকলি, ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অফ আমেরিকার একজন শিক্ষার্থী বলেন, “মূলধারার নারীবাদের সাথে সুবিধাবঞ্চিত জাতিগোষ্ঠীর নারীরা কোন সমন্বয় খুঁজে পান না। আমরা যদি জাতিগত বৈষম্য উপেক্ষা করে শুধু লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে কাজ করি তবে এর আওতায় পরা একটা বিশাল জনগোষ্ঠী বাদ পড়বে।” পৃথিবীর প্রতিটা জাতিগোষ্ঠীর চ্যালেঞ্জ স্বতন্ত্র। তাই মূলধারার নারীবাদীরা যদি তাদের দৃষ্টি প্রসারিত না করেন, এর বিভাজন হতে বাধ্য।
খুব সম্প্রতি দুজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীর সাথে হওয়া ঘটনা ওমেনিজম মুভমেন্টে তোলপাড় সৃষ্টি করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে আমাদের এখনও কতটা পথ পাড়ি দেবার বাকি। প্রথমটি হল ট্রাম্প প্রশাসনের প্রেস সেক্রেটারি শন স্পাইসার একজন নারী সাংবাদিককে “মাথা নাড়াবেন না” বলে অত্যন্ত উদ্ধত উক্তি করেন। শন স্পাইসার তার উগ্রতার জন্য কুখ্যাত, কিন্তু তারপরও এটা ভাবাই যায় না এমন উক্তি তিনি কোন শ্বেতাঙ্গ পুরুষকে উদ্দেশ্য করে করতে পারেন। দ্বিতীয় ঘটনাটির শিকার একজন কংগ্রেসওমেন, মাক্সিন ওয়াটার, যিনি তার চুলের কারণে অপমানিত হয়েছেন একজন টিভি উপস্থাপকের দ্বারা। দুটো ঘটনাই ঘটেছে নারীবাদ আন্দোলনের পথিকৃৎ দেশ আমেরিকায়। বিশ্বের অন্য যে কোন প্রান্তে যা জন গোচরে আসে না, তার সংখ্যা তবে কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। অন্তর্জালের আশীর্বাদে এসব অনাচারের বিরুদ্ধে একাত্ম হয়ে আজ প্রতিবাদ করা যায় পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকে। আপনি যদি একজন নারী হয়ে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এই আন্দোলনের আদর্শ ধারণ করতে পারেন তবে মাক্সিন ওয়াটারের ‘‘আমি একজন প্রত্যয়ী কৃষ্ণাঙ্গ/বাদামি বর্ণের নারী। আমাকে দমিয়ে রাখা যাবে না” এই বীজমন্ত্রে দিক্ষিত হন। আপনি না জাগলে সকাল হবে না।