পুরুষতন্ত্রের শ্রেণিবিভাজন ও নারীর ভেতরে জিইয়ে রাখা বিভেদ
নন্দিতা সিনহা ।। পৃথিবীর প্রতিটি সমাজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ নিজেদের মনে ও মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে শ্রেণিচেতনাকে সযত্নে লালন করে চলেছে। আর ভারতীয় উপমহাদেশের মত রক্ষণশীল সমাজগুলোতে শ্রেণিবৈষম্য আজও চরম মাত্রায় বিরাজ করছে। যার কারণে আজও জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ নিরপেক্ষ একটা স্থিতিশীল ও সুষম সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। পুরো পৃথিবীর শিক্ষার হার ক্রমাগত বেড়েছে, বিজ্ঞান প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে, কিন্তু এই শ্রেণি ধারণাকে আজো মন ও মস্তিষ্ক থেকে ঝেড়ে ফেলা যায় নি। বরং ‘লো ক্লাস’ এর মতন শ্রেণিবাদী ও বর্ণবাদী শব্দগুলো আজও গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
আদিম মানবসমাজে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা সক্রিয় ছিল। এরপর যখনই মানুষের মস্তিষ্কে উদ্বৃত্ত খাদ্য ও সম্পদের ধারণার উদ্ভব ঘটল তখন থেকেই শুরু হল দাস ব্যবস্থা। শক্তি ও সম্পদের জোরে মানুষ ‘দাস’ নামক এক শ্রেণির তৈরি করলো। যার ফলে দুটি শ্রেণির আত্মপ্রকাশ ঘটল – মালিকশ্রেণি ও দাসশ্রেণি। মূলত সেই সময় থেকেই শ্রেণিচেতনার উদ্ভব হয় মানবসমাজে। আরেকটা বিষয় এখানে অবশ্যউল্লেখ্য যে, সেই দাসশ্রেণি তৈরি হওয়ার সমসাময়িক কালেই সমাজের আরেক অংশ কোথাও ঘোষিত এবং কোথাও অঘোষিতভাবেই দাসশ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হলো। এই আরেক অংশটাই হলো নারী। নারী তখন থেকেই বাইরের পৃথিবী থেকে থিতু হলো বা বলা যায় তাকে সীমাবদ্ধ করা হলো। নারীকে ঘরে খাদ্য ও সন্তান উৎপাদনে পুরোপুরি নিয়োজিত করা হল। আর তখন থেকেই নারীর অবস্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হলো দাসশ্রেণিতে। মালিকশ্রেণিতে রয়ে গেল পুরুষেরা। এরপর থেকে মানবসমাজে একে একে উদ্ভব ঘটল সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থা, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও সর্বশেষে বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার। কিন্তু এর কোনো একটি ব্যবস্থাও এই শ্রেণিভেদকে মানুষের মন ও সমাজ থেকে দূর করতে পারে নি। মধ্যযুগের সামন্তবাদ ও বর্তমানকালের পুঁজিবাদ সেই শ্রেণিভেদ ও শ্রেণিবৈষম্যের পালে বরং হাওয়া দিয়েছে। যার উপস্থিতি আজও বর্তমান।
সমাজ পৃথিবী এখন বহুমাত্রিক শ্রেণিভেদে বিভক্ত। মালিক-শ্রমিক, ধনী-গরীব, সাদা-কালো, চাকুরীজীবি-বেকার, তথাকথিত সুন্দর-অসুন্দর ইত্যাদি ছাড়াও নির্দিষ্ট সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর সংখ্যাগত দিক থেকে কম বা আধিক্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে বর্তমানের শ্রেণিবিভক্ত সমাজ। তবে আপাতদৃষ্টিতে দেখতে এই শ্রেণিবিভক্তি অসংখ্য প্রকারভেদে দেখা গেলেও এখানে মূলত দুটি ক্যাটাগরির শ্রেণির অস্তিত্ব রয়েছে- শোষক ও শোষিত বা বলা যায় সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিত। এখানে সুবিধাভোগী শ্রেণিই সকল কিছুর হর্তাকর্তা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শ্রেণির হাতেই থাকে সমাজ, সরকার ও রাষ্ট্রের কলকাঠি। সেইসাথে রাষ্ট্রের তাবত শোষিত শ্রেণির ভাগ্যনিয়ন্তাও এই সুবিধাভোগী শোষকেরা। আর এই সিস্টেমে সম্পদ ও ক্ষমতা সবসময় উর্ধ্বমূখী, যার ফলে সুবিধাভোগী শোষকেরা দিনদিন আরও প্রভাবশালী হয় আর সর্বহারা শোষিতেরা দিনদিন আরও নিঃস্ব হতে থাকে।
এই শোষক-শোষিতবর্গীয় শ্রেণিবিভক্ত সমাজে লৈঙ্গিক শ্রেণিবিভাজনটাও ঘটেছে অনেক আগে থেকেই। সেই নারীকে ঘরে আবদ্ধ করার সময় থেকেই। সেটা কোনোমতেই অস্বীকার করা যায় না। আর সেই সাথে এটাও অস্বীকার করা যায় না যে, এই লৈঙ্গিক বিভাজনে শোষকের ভূমিকায় আজ অবধি থেকে এসেছে পুরুষ, আর সর্বহারা শোষিত শ্রেণিতে থেকেছে নারী। আর আজও আছে। পুরুষতন্ত্র নারীকে ধর্ম, সামাজিক ট্যাবু, লোকলজ্জা ইত্যাদির দোহাই দিয়ে দাবিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করে এসেছে। আর এক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্র সফলও থেকেছে অনেককাল, আজও আছে বলা যায়। অনেকেই কিছু সংখ্যক নারীর সফলতার উদাহরণ দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন দেখাতে চান। এখানে এটা মনে রাখা জরুরি যে, আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটেই যদি বলি তাহলে সমাজব্যবস্থা বলুন, শিক্ষাব্যবস্থা বলুন কি নারীর ক্ষমতায়নই বলুন, কোনো কিছুই এখানে সুষম বা সমানুপাতিক হারে ঘটে না। একদিকে কিছু নারী পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছে আর অন্যদিকে কিছু নারীকে আজও ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য, নিজের জীবনে, নিজের শরীরে নিজের অধিকার নিশ্চিত করতে অবর্ণনীয় লড়াই করতে হচ্ছে। তাই এভাবে একচোখা উদাহরণ টেনে সব নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে বলে দেখানোটা নিতান্তই মূর্খতাজনিত অবান্তর যুক্তি। এখানে নারী আজও প্রশ্নাতীতভাবেই পুরুষের চাইতে ‘নিম্নশ্রেণির’। কিছু ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া নারীর ক্ষমতায়নকে আবহমান কাল থেকে চলে আসা পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যবাদের বিপরীতে দাঁড়াবার মত বড়সড় কিছু বলা যায় না।
পৃথিবীতে বিদ্যমান সকল ধরণের শ্রেণিবিভাজনের মতো নারী ও পুরুষের মধ্যেকার এই আন্তঃলৈঙ্গিক বিভাজনেও পুরুষ শোষকের দ্বারা নারী শোষিত হয়ে এসেছে, আজও রয়ে গেছে সর্বহারা শ্রেণিতেই। আর শোষকেরা সর্বদাই শোষিতদের দমিয়ে রাখার সর্বোচ্চ ও সর্বাত্মক চেষ্টাটা চালিয়ে থাকে। শোষক সব সময় সচেষ্ট থাকে যাতে শোষিত শ্রেণি থেকে সর্বহারাদের কোনো প্রকারের শ্রেণি উত্তরণ ঘটতে না পারে। শ্রেণিভেদের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ ও পুরুষতন্ত্র সাধারণত একই নীতি অনুসরণ করে থাকে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় মালিকেরা শ্রমিকদের সবসময় নূন্যতম মজুরিটাই দেওয়ার চেষ্টা করে, যাতে শ্রমিকের কেবলমাত্র নিত্যদিনকার খাবারের সংকুলানটা হয়। এর বেশি মালিকেরা সাধারণত দিতে আগ্রহী থাকে না, কারণ এর বেশি দিলে শ্রমিকের অর্থসঞ্চয়ের সম্ভাবনা থাকে। আর অর্থসঞ্চিত হলে শ্রমিক স্বাধীন ব্যবসায়ী হয়ে মালিকের ব্যবসায়ক্ষেত্রে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নামার আশংকা থাকে। আর এমনটা ঘটলে মালিকের একচেটিয়া বাজার ও লাভের হার হাতছাড়া হয়ে গিয়ে ক্ষতির সম্ভাবনা বাড়ে। এ কারণে মালিক সর্বনিম্ন মজুরি দিয়ে শ্রমিককে শুধুমাত্র ভাত-কাপড়ের উপর রেখে শ্রমিককে ও তার শ্রমকে সারাজীবনের জন্য একপ্রকার কিনে নেয়। পুরুষতন্ত্রও নারীর উপর ঠিক এই ফর্মুলাটাই প্রয়োগ করে। মালিক ও পুরুষ নিজেদেরকে শ্রমিক ও নারীর চাইতে উচ্চশ্রেণির ভাবে। আর নিজেদের এই উচ্চস্থান কায়েম রাখার ভাবনা থেকেই তারা নারী বা তথাকথিত ‘ নিম্নশ্রেণি’কে চিরকাল অবদমিত করে রাখতে চায়। এই ‘নিম্নশ্রেণি’কে মাথা তুলতে না দেওয়ার সমস্ত কায়দাকানুন ‘উচ্চশ্রেণি’র লোকেরা সুপরিকল্পিতভাবে সাজিয়ে রাখে।
এখন মালিক-শ্রমিক, ধনী-গরীব, কর্মজীবী-বেকার, ফর্সা-কালোসহ নানান ও বহুমাত্রিক শ্রেণিবিভাজনের এই পৃথিবীতে সবথেকে আশ্চর্যজনক ও হাস্যকর বিভাজনের নাম নারীদের মধ্যে থাকা শ্রেণিভেদটা। হ্যাঁ, পুরো নারী জাতিই যেখানে পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রের সামনে আজও শোষিত সর্বহারা শ্রেণিতে রয়ে গেছে, কোনো নারী যতই সফল, মেধাবী, বিজ্ঞ হোক না কেন, দিনশেষে নারী আজও ‘নিম্ন’ ও দ্বিতীয় শ্রেণির প্রাণী বলে বিবেচিত হয়ে আসছে, সেখানে নারীদের মধ্যেও আবার রয়েছে শ্রেণিবিভাজন! মূলত এই বিভাজনটাকেই বলা যায় নারীর অভ্যন্তরীন ভাঙন বা অবক্ষয়। আর এই ভাঙন ও অবক্ষয়ের সুযোগটাই পুরুষতন্ত্র চিরকাল নিয়ে এসেছে। পুরুষশাসিত সমাজের শতকরা ৯৭ ভাগ নারীই শরীরে মনে পুরুষতন্ত্রের দাসত্বকে মনেপ্রাণে লালন করে, দাসত্বের এই বীজটাকে নারীর মধ্যে বপন করে দেওয়া হয়। আর অবশিষ্ট বাকি ৩ ভাগ নিয়মভাঙা নারী এখানে ‘অস্বাভাবিক’, ‘খারাপ’, ‘উশৃঙ্খল’ ও ‘অসামাজিক’ বলেই পরিচিত। এই নারীরা আত্মনির্ভরশীলতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। এরা আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে যে অবস্থানেই থাকুক এরা সমাজে পুরুষ ও পুরুষতন্ত্রের ছাপোষা বাকি নারীদের চেয়ে ‘নিম্নশ্রেণি’র বলে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে পুরুষতন্ত্রের উদ্দেশ্যসাধনকারী, পুরুষের ছাপোষা তথাকথিত ‘উচ্চশ্রেণি’র নারীরা যতই অযোগ্য, অপদার্থ, পরনির্ভর হোক না কেন তারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সুনজর পেয়ে থাকে। অবশ্য তা ততদিনই যতদিন এই নারীরা পুরুষতন্ত্রের উদ্দেশ্যসাধন করে। এর ব্যত্যয় ঘটলেই এতদিনের ‘উচ্চশ্রেণি’র সম্মান পাওয়া নারীর চট করে শ্রেণিপতন ঘটে। কিন্তু পুরুষের বেলায় এই শ্রেণিপতন কখনোই কোনোভাবেই ঘটে না। উচ্চশ্রেণি ধারণের জন্য পুরুষের লৈঙ্গিক ‘পুরুষ’ পরিচয়টাই যথেষ্ট, তা সেই পুরুষ ব্যক্তি হিসেবে যতই গণ্ডমূর্খ হোক কিবা যত বড় অমানুষই হোক। পুরুষের পতন হওয়ার মত কোনো স্থানই সমাজে নেই। কেবল মাত্র নারীরাই সকল প্রকারের সর্বোচ্চ পতনশীলতা নিয়ে জন্মায়। আর এই হিপোক্রেট সমাজ পুরুষই তৈরি করে রেখেছে শুধুমাত্র নারীর উপর প্রয়োগের জন্য।
পুরুষতন্ত্রের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় আজ এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, পুরুষের সহচর্য ছাড়া নারীর শ্রেণিউত্তরণ কখনোই কোনোভাবেই ঘটবে না, ঘটলেও তা স্বীকৃতি পাবে না। তাই পুরুষ হতে না পারলেও পুরুষের উদ্দেশ্যসাধন করে, পুরুষতন্ত্রের এই অসম ও অমানবিক শৃঙ্খল পায়ে দিয়ে অধিকাংশ নারী সমাজে ‘উচ্চশ্রেণি’ ধারণ করতে চায়। মূলত এরই উদ্দেশ্যে পুরুষতন্ত্র নারীদের মধ্যে এই শ্রেণিবিভাজনটা ঘটিয়ে নারীদের মধ্যেকার এক ভিত্তিহীন প্রতিযোগিতা ও ঘৃণা-বিদ্বেষকে উজ্জীবিত রাখতে চায়। এর ফলে নারী হয়েও এক নারী আরেক নারীকে ঘৃণা করে, তার সম্পর্কে মনে বিদ্বেষ, ক্ষোভ পুষে। স্বাধীনতা অর্জনকারী নারীরা পুরুষতন্ত্রের ‘উচ্চশ্রেণি’র নারীদের সামাজিক নিরাপত্তাকে আর সেই উচ্চশ্রেণির নারীরাই আবার অপরপক্ষের স্বাধীনতাকে হিংসা করে।
নারীদের মধ্যেকার এমন নানান অমূলক প্রতিযোগিতা ও ঘৃণা পুরুষতন্ত্র নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে অত্যন্ত সুকৌশলে সৃষ্টি করে রেখেছে। এগুলো নারীও নিজেদের জ্ঞান ও সচেতনতার সীমাবদ্ধতার দরুণ প্রশ্নহীনভাবে মেনে নিয়েছে। আজও পৃথিবীতে পুরো নারীজাতিই দ্বিতীয় লিঙ্গের নিম্নশ্রেণির এক ভোগ্য প্রাণী বলে বিবেচিত হয়। দিনশেষে তারা সর্বহারা শোষিত শ্রেণির, যাদেরকে অন্যায়ভাবে শোষণ করে করেই পুরুষতন্ত্র বেঁচে আছে, আর তা নারী নিজেও জানে না। শ্রেণিবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় সুষম ও নিরপেক্ষ উন্নয়ন যেমন কল্পনার অতীত, তেমনি শ্রেণিবিভক্ত নারীসমাজে নারীর আর্থসামাজিক মুক্তিও। এখন নারী এই শ্রেণিচতনা মনে মস্তিষ্কে ধারণ করে পুরুষতন্ত্রের উদ্দেশ্য সাধন করবে নাকি আবহমানকাল থেকে চলে আসা এসব অন্যায় অবিচারকে অস্বীকার করে ঐকবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াবে, সেটার দিক বিবেচনার দায়িত্ব নারীরই।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]