May 15, 2024
ইতিহাসসাহিত্যফিচার ৩

রোজা লুক্সেমবার্গ – আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো

পূরবী চৌধুরী ।।

রোজা লুক্সেমবার্গ ছিলেন উনিশ শতকের প্রতিভাবান এক অসাধারণ বিপ্লবী যিনি শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন। সময়টা উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের শুরুর কথা, “জার্মানির বুর্জোয়া সমাজ তখন ক্রস রোডে দাঁড়ানো ছিল, হয় তাদের সেখান থেকে সোশ্যালিজমের দিকে যেতে হবে নয়তো তারা বর্বরতার দিকে যাবে’’। এই কথাগুলো তখন খুব প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল চারদিকে, যা রোজা লুক্সেমবার্গের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। তিনি সেই বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় এমন দাগ ফেলেছিলেন যা এখন পর্যন্ত মুছে যায় নি। তিনি ছিলেন আলোড়নসৃষ্টিকারী বিপ্লবী এবং অনেকটাই বেপরোয়া। সেই সময় নারী নেতৃত্বের সংগ্রামও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর চারপাশে তাঁর কাজ এবং লক্ষ্যকে আটকানো কিংবা দেয়াল তৈরি করা লোকের সংখ্যা ছিল অগণিত। তবে রোজা থেমে যান নি কিছুতেই, উনিশ শতকের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাশীলদের তিনি একজন।

রোজার রাজনৈতিক লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষা ছিল সমাজের পুঁজিবাদী ও শ্রমিকশ্রেণির বিভাজন কমিয়ে সুবিচার এবং সুসমবন্টন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এই বিষয়টি সেই সময়কার পুরো জার্মান সমাজব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সারা পৃথিবীতে তাঁর চিন্তা ও বিপ্লব লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। রোজা লুক্সেমবার্গ সম্পর্কে যে কথাটা খুব প্রচলিত তা হলো তিনি তাঁর সময়ের এক অসাধারণ প্রতিভাবান নারী বিপ্লবী ছিলেন যার রাজনৈতিক জীবন, সামাজিক অবস্থান সবকিছুতেই কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছিল। তিনি ছিলেন পোলিশ, ইহুদী, অভিবাসী, রাজনৈতিক উদ্বাস্তু এবং শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ নন। রোজার জীবনের এই সবগুলো শব্দকে পাশ কাটিয়ে সমাজ, রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে নিজেকে শক্ত অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করা সহজ বিষয় ছিলনা। এমন মানুষদের সাথে তিনি টক্কর দিয়েছেন যারা সমাজে প্রভাবশালী এবং রোজাকে তারা নীচুস্তরের মানুষ ভাবতেন। শ্রেণি বিভাজন সেই সময় ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল।

রোজা লুক্সেমবার্গের জন্ম ১৮৭১ সালের ৫মার্চ পোল্যান্ডের জামচেক শহরে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে, পুরো নাম রোজালিয়া লুক্সেমবার্গ। পোল্যান্ড তখন রাশান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। ওয়ারশতে শহরে স্কুলে পড়াশোনাকালীন সময়ে গোপন রাজনৈতিক সংঠনের সাথে জড়িয়ে পড়েন যারা মূলত শ্রমিকশ্রেণির অধিকার আদায়ের লড়াই করছিলেন। সেই সময় যারা এমন সমাজতান্ত্রিক দলের সাথে যুক্ত ছিল তাদের ফাঁসিতে ঝুলানো হচ্ছিল। ফলে পুলিশি হামলা থেকে বাঁচতে রোজা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন এবং আশ্রয় নেন সুইজারল্যান্ডে। সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আইন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। তারপর তিনি অর্থনীতিতে ডক্টরেট করেন এবং জার্মানিতে চলে আসেন। জার্মানিতে তিনি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে যোগ দেন এবং সেই সময় এই দল বড় ধরনের আন্দোলনে যুক্ত ছিল। জার্মানি যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে যায় তখন রোজা এবং কার্ল লিবনেচট (Karl Liebknecht ) স্পার্টাকাস লীগ নামে যুদ্ধবিরোধী আর একটি দল শুরু করেন। রোজা দ্রুতই পার্টিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান করে নেন কারণ তিনি ছিলেন অনন্য গুণসম্পন্ন নেতা, একজন অক্লান্ত সংগঠক, অগ্রগামী চিন্তাবিদ এবং শিক্ষাবিদ। তাঁর কাজ বহুমাত্রিক ধারায় বিভাজিত এবং বৈচিত্রময় ছিল।

রোজা ছিলেন মার্ক্সবাদী মতাদর্শের এবং যুদ্ধবিরোধী। শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা ছিল মূল লক্ষ্য তাই পুঁজিবাদ ও রাজতন্ত্রবিরোধীও। জার্মানীর স্পার্টাকাস লীগ দল পরে কমিউনিস্ট পার্টি হয়েছিল সেটার গুরুত্বপূর্ণ কর্ণধার ছিলেন রোজা। শত বছর আগে রোজা লুক্সেমবার্গের করা শ্রমিকদের মুক্তির সংগ্রাম ব্যর্থ হলেও জার্মানির শ্রমিক সংগঠন ও আন্দোলনের ঐতিহ্য এখনও রয়েছে। জার্মানির পুরোনো এই শ্রমিক সংগঠনের বিশাল সদস্যসংখ্যা বিশ্বের যেকোনো শ্রমিক সংগঠনের কাছে ঈর্ষণীয়। ঐ সময়ের অন্যান্য মার্ক্সবাদীর মধ্যে রোজা লুক্সেমবার্গের কাজের পরিধি ছিল বিস্তৃত, তিনি প্রযুক্তির পশ্চাদপদতা বা অনুন্নত বিশ্বে পুঁজির প্রসারের ক্ষতিকর দিক এবং এই বিষয়গুলোতে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে চেয়েছেন। ঐ সময় রোজা লুক্সেমবার্গ দ্যা রেড ফ্ল্যাগ (Die Rote Fahne) নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন যা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

১৮৯০ সালে জুরিখে রোজার সাথে পোলিশ বিপ্লবী লিও জগিচেসের পরিচয় হয়। জগিচেস ছিলেন রোজার প্রেমিক ও সহযোদ্ধা যিনি ১৭ বছর রোজার জীবনে ছিলেন এমনকি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তিনি রোজার কেবল ঘনিষ্ঠ জীবন সঙ্গীই ছিলেন না রাজনৈতিক জীবনের সাথেও ছিলেন। জগিতেস ছিলেন মৌলিক চরিত্রের অধিকারী, তাঁর সম্পর্কে রোজার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সমাজতন্ত্রী নারীবাদী ক্লারা জেটকিন লিখেছিলেন- “এই প্রকৃতির পুরুষ মানুষ বিরল যারা প্রখর নারী ব্যক্তিত্বকে সহ্য করতে পারে”। লুক্সেমবার্গ এবং জগিচেসের তীব্র আবেগী এবং ঝোড়ো সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রেই লুক্সেমবার্গের চরিত্রকে প্রকাশ করে – সেটা একজন নারী হিসেবে, এমনকি বিপ্লবী হিসেবেও। একজন পোলিশ ইহুদী বিপ্লবী নারী যিনি শিক্ষিত এবং বিচক্ষণ হবার পরও বিভিন্ন দলীয় নেতাদের থেকে অনেক বিরক্তি এবং বিরোধিতা পেয়েছেন।

সেই সময় নারীদের ভোটের অধিকারের জন্য আন্দোলন চলছিল। নারীদের এই আন্দোলনে রোজা সম্মুখের যোদ্ধা ছিলেন না যেমনটা তাঁর বন্ধু ক্লারা জেটকিন ছিলেন, যিনি ভোটাধিকারের এই আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। এই ধরনের কিছু মতানৈক্য রয়েছে রোজা লুক্সেমবার্গকে নিয়ে যে তিনি নারীবাদের স্বপক্ষে ছিলেন না। কিন্তু তিনি বলেছেন সমাজে নারীদের নিম্নশ্রেণিতে অবস্থান ও প্রবঞ্চনা সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবের দ্বারাই নির্মূল করা সম্ভব, নারীদের জন্য আলাদা আন্দোলন নয় বরং তিনি সমাজের প্রবঞ্চনা পাওয়া সকলের জন্য কাজ করে গেছেন। ১০০ বছর আগে নারীদের যে সামাজিক অবস্থান ছিল সেখান থেকে রোজা লুক্সেমবার্গ যেখানে পৌঁছেছিলেন সেই পথটাও ব্যাপক কষ্টসাধ্য ছিল, সেক্সিজম ছিল সবক্ষেত্রে। পুরুষ কমরেডদের মতো সমাজের সব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ব্যবহারের প্রবেশাধিকার ছিল না। তবে তিনি বিশ্বাস করতেন সবক্ষেত্রে সকলের সমঅধিকার পেলেই সমাজের সব অসামঞ্জস্যতা কমে আসবে এবং একদিন হয়ত তা বিলুপ্ত হবে। তিনি বলেছিলেন – “that humanity has an inherent yearning for freedom one which cannot be put down with rifles.” (অন্তর্নিহিত স্বাধীনতার আকাংখা রাইফেল দিয়ে আটকানো যায় না)।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে, সে সময় পরাজিত হওয়া জার্মানিতে বিপর্যয় নেমে এসেছিল। জার্মানির এমন পরাজয় দেশের জনগণের কাছে একবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। জার্মানির সমুদ্রপাড়ের রাজ্য হারানো ছাড়াও মিত্রপক্ষের অর্থ সম্পদের দাবির মুখে গুরুত্বপূর্ণ কয়লা ও ইস্পাতখনির মালিকানা দিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছিল। তবে যুদ্ধবিরোধী চুক্তি শেষ হবার আগেই জার্মানির শ্রমিকশ্রেণি অভিজাতদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিল। ১৯১৮ সালে প্রুশিয়া রাজতন্ত্রের অবসান হলে জার্মানীর হাল ধরেন সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা ফ্রিডরিক এবার্ট। সেই সময় ফ্রিডরিক এর্বাট এর সামাজিক গণতান্ত্রিক দলটিতে ডান ও বামপন্থীদের সমন্বয় থাকলেও ডানপন্থীদের প্রভাব ছিল বেশি। তবে এই শাসনব্যবস্থায় পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে শ্রমিক শ্রেণির প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি সে সময় সংসদীয় গণতন্ত্র চায়নি বরং চেয়েছিল সমাজের অধিক ক্ষমতাবান মূলধনওয়ালা পুঁজিবাদীদের উচ্ছেদ করে শ্রমিকদের অধিক সুযোগ সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা করা যায় এমন রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করা হোক। শুরু হয় কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলন, সেই সময় সরকারপক্ষ বিষয়টি মীমাংসা করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু আলোচনা সফল হয়নি। যুদ্ধোত্তর জার্মানিতে সম্রাট অপসারিত হলেও দেশে পুরোনো সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিরাজমান ছিল। ফলে এই ধরনের দাবি ক্ষমতাসীন দলের মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে ১৯১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি নির্বাচন হবার কথা থাকলেও ৬ জানুয়ারি জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি সদ্য ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বার্লিনে বিদ্রোহীরা কিছু সরকারি এবং সংবাদপত্র অফিস দখল করে। ১২ জানুয়ারি সরকারি সেনাবাহিনী রাজধানী বার্লিনে বিপ্লবীদের কঠোরভাবে দমন করেছিল এবং হাজার হাজার শ্রমিককে হত্যা করেছিল।

সেই বিপ্লবে অন্যতম নেতৃত্বদানকারী ছিলেন রোজা লুক্সেমবার্গ, ১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি কোনো ধরনের গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই রোজাকে ধরে হোটেল ইডেনে নিয়ে আসা হয়। সেই সময় রোজার সাথে আরো ছিলেন তাঁর সহযোদ্ধা কার্ল, সৈন্যরা তাঁদেরকে প্রথমে আলাদা করেন এবং অত্যাচার চালান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধফেরত রক্ষণশীল স্বেচ্ছাসেবী সৈন্যরা রোজাকে মাথায় গুলি করে হত্যা করেছিল বার্লিন শহরের কেন্দ্র টিয়ারগার্টেন এলাকায় এবং তারপর তাঁর মরদেহ ল্যান্ডউয়ার খালের পানিতে ফেলে দিয়েছিল। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে এই অপ্রতিরোধ্য বিপ্লবীকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ড জার্মানির ইতিহাসের দুঃখজনক ঘটনা। রোজা এবং কার্লকে মেরে ফেলার পর আরো অসংখ্য আন্দোলনকারীকে মেরে ফেলা হয়।

সৈন্যরা যখন রোজা লুক্সেমবার্গকে ধরে নিয়ে যাবার জন্য দরজার কড়া নাড়ছিল তখন তিনি শেষ এই কথাগুলো লিখে গিয়েছিলেন-

Order prevails in Berlin! You foolish lackeys! Your “order” is built on sand. Tomorrow the revolution will “rise up again, clashing its weapons,” and to your horror it will proclaim with trumpets blazing:

I was, I am, I shall be!

রোজা লুক্সেমবার্গের স্বরণে জার্মানির বার্লিনে ১৯৯০ সালে রোজা লুক্সেমবার্গ ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। সংক্ষেপে একে রোজা-লাক্স বলা হয়। এটি মূলত সোশ্যাল অ্যানালাইসিস অ্যান্ড পলিটিক্যাল এজুকেশন অ্যাসোসিয়েশন। এছাড়া প্রতিবছর রোজার সমাধিতে ফুল দিয়ে তাঁর অবদানকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

পৃথিবীব্যাপী হানাহানি, যুদ্ধ আর পুঁজিবাদের দৌড়াত্ম্য বেড়েই চলেছে। বাড়ছে অশান্তি, নৈরাজ্য এবং কট্টোরবাদীদের প্রভাব। সামাজিক বৈষম্য কমেনি, বরং নানারূপে নানাভাবে এসেছে। গত ১০০ বছরে বিশ্ব হয়তো উন্নয়নে এগিয়েছে অনেকদূর কিন্তু সত্যি কোথাও কি সেই অর্থে সমতা এসেছে? ১০০ বছর আগে এমন এক বিপ্লবী নারীকে প্রাণ দিতে হয়েছিল সমাজ এবং মানুষে মানুষে অসমতা কমানোর লড়াই করবার জন্য। হয়তো অসমতা কিংবা পুঁজিবাদের বিস্তার যাতে কেউ রুখতে না পারে তাই রোজা লুক্সেমবার্গের মতো সাহসী প্রাণগুলোকে থামিয়ে দেয়া হয় এভাবেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *