November 21, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ৩

‘মেন উইল বি মেন’ বনাম বিষাক্ত পৌরুষ

কাজী নাজীফা লামিনূর ।। 

“বি আ ম্যান, ব্রো- পুরুষমানুষ এত আবেগী হলে চলে নাকি!” পুরুষেরা বন্ধুমহলে প্রায়শই এমন উক্তি শুনে অভ্যস্ত। ছোট্ট ছেলে শিশুটিকে নানী-দাদীরা আহ্লাদ করে জোর গলায় শেখান, “কি রে, ব্যাটাছেলেরা শক্তপোক্ত হয় তো, পড়ে গেলে ব্যথা পায় নাকি!” পুরুষকে কঠোররূপে  পুরুষালি করে তোলার এই সামাজিকীকরণ চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। আধুনিক সমাজে এসেও আমরা যেন এই ধ্যান-ধারণা থেকে বের হতে পারছি না।

ভারতীয়  পরিচালক বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত তাঁর “স্বপ্নের দিন” চলচ্চিত্রে দেখিয়েছেন, গ্রামাঞ্চলে পুরুষদের স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির প্রচারণার বিরুদ্ধে তারা কীভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করে। সেখানে সংলাপ ছিল, সরকারি প্রচারক (প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি) বলেছিলেন, পরিবার ছোট রাখতে পুরুষদের ছোট্ট একটু কাটা-ছেঁড়া করতে হবে। উত্তরে গ্রামের পুরুষেরা বলেন, “কেন আমরা ব্যাটা ছেলেরা কাটা-ছেঁড়া করবো?  এটা যাদের ধর্ম তারা করবে।”

তাইতো! শরীর কাটা-ছেঁড়া, ক্ষয় করা যেন নারীর ধর্ম। কি স্পষ্টভাবে পুরুষের সামাজিকভাবে গড়ে ওঠা মানসিকতাকে এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

“মেন উইল বি মেন” – বহুল জনপ্রিয়, আলোচিত ও সমালোচিত একটি বিজ্ঞাপনীয় ট্যাগলাইন। এর অর্থ দাঁড়ায়, পুরুষের কোনো পরিবর্তন হয় না। এই সমাজ বিশ্বাস করে কোনো নিয়ামকই পুরুষের কট্টর পৌরুষকে দমাতে পারে না। ঠিক এমন এক সংকীর্ণ ধারণাকে বলা হয় টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি বা বিষাক্ত পৌরুষ। এটি অতিরঞ্জিত পুরুষালি বৈশিষ্ট্যের নেতিবাচক দিকগুলি বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক “জেন্ডার কমিউনিকেশন ” এ বারবার আলোচনায় আসছে এ বিষয়টি। জার্নাল অফ স্কুল অফ সাইকোলজির একটি গবেষণা টক্সিক ম্যাসকুলিনিটিকে  ব্যাখ্যা করেছে-  “সামাজিকভাবে পুরুষালি বৈশিষ্ট্যের চর্চাকারী যা কর্তৃত্ব ও আধিপত্যকে উৎসাহিত করে, নারীদের অবমূল্যায়ন করে ও সহিংসতায় অংশ নেয়”।

টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি পুরুষকে হিংসাত্মক, যৌনক্ষুধাসর্বস্ব, আক্রমণাত্মক, অনুভূতিশূন্য এবং (পুঁজিবাদী  পরিকাঠামোয়) আর্থ-সামাজিক কর্তৃত্ব দিয়ে পরিচিত করে। এ হল পুরুষত্বের এমন এক সাংস্কৃতিক ধারণা, যেখানে শক্তিপ্রদর্শন ও কর্তৃত্বই একমাত্র গুণ। আবেগ, অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ যেন পুরুষের দুর্বলতা বা মেয়েলি প্রতীক। এখানে পুরুষের ক্ষেত্রে হাইপারসেক্সুয়ালিটি  বা অতিমাত্রায় যৌন সক্রিয়তা এবং যৌন আধিপত্য পুরোপুরি  স্বীকৃত, এমনকি প্রশংসিত।

টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি শব্দটি ১৯৮০ সালের দিকে পৌরাণিক পুরুষদের আন্দোলন থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। পুরুষেরা একটি আন্দোলনের ডাক দেয় যার লক্ষ্য ছিল পুরুষদেরকে তাদের ‘পুরুষত্ব’ সম্পর্কে সচেতন করা। কারণ তখন পুরুষদের কিছু গোষ্ঠী বুঝতে পেরেছিল যে তারা আর পূর্বপুরুষদের মতো পুরুষালি আচরণগুলোকে আধুনিক সমাজে চর্চা করতে পারবে না। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা বিশ্বাস করত যে তারা যদি এই তথাকথিত ‘পৌরুষ’ ধরে রাখতে  না পারে তবে  শেষ পর্যন্ত বড় অরাজকতা সৃষ্টি হবে।

পরবর্তীতে ২০১০ সালে বিভিন্ন মিডিয়া আলোচনাগুলো পুরুষত্ব এবং পুরুষত্বের ঐতিহ্যগত এবং স্টেরিওটাইপিকাল নিয়মগুলো বোঝাতে ‘টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। সমাজবিজ্ঞানী মাইকেল ফ্লাডের মতে এই ধারণার মধ্যে পুরুষদের অবশ্যই সক্রিয়, আক্রমনাত্মক, কঠোর, সাহসী এবং প্রভাবশালী হতে হবে এমন প্রত্যাশা অন্তর্ভুক্ত।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ টেরি অ্যালেন  কুপার্স বলেন, আমেরিকান কারাগারে পুরুষালি নিয়মগুলো জীবনের একটি বৈশিষ্ট্য, সেখানে কর্মী এবং কয়েদি উভয়ের মধ্যে চরম আত্মনির্ভরশীলতার গুণাবলী, সহিংসতার মাধ্যমে অন্য পুরুষের উপর আধিপত্য, নিজের দুর্বলতা এড়ানো, শাস্তি, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এসব কিছুর মধ্যদিয়ে জেল জীবনের কঠোর অবস্থা মোকাবিলা করতে হয়। অনেকে হয়তো এই আবেগকে দমন করতে গিয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে। যার ফলাফল আত্মহত্যা।

লক্ষ্য করলে দেখা যায়, শিশুদের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে পুরুষালি বা মেয়েলি কোনো আচরণ তৈরি হয় না যদি না পরিবারের সদস্যরা তাকে সেভাবে গড়ে তোলে। ছেলে শিশুর ওপর সামাজিকভাবে চাপিয়ে দেয়া দৃঢ়তা, আধিপত্য, আত্মনির্ভরশীলতার মতো নিয়ম মানসিক ট্রমা হিসেবে রূপ নিতে পারে। পরবর্তীতে ব্যক্তিজীবনে এমন মানসিক অবস্থা তাকে সহিংস করে তুলতে পারে। এ বিষয়ে পুরস্কার বিজয়ী  আমেরিকান লেখক চিমামান্ডা এনগোজি আদিচি বলেন, “এখন পর্যন্ত আমরা পুরুষদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ যে কাজটি করি তা হলো তাদের আমরা কঠিন হতে শেখাই। আমরা তাদের মধ্যে নশ্বর অহংকার গড়ে তুলি”।

এটা অনেকেই বিশ্বাস করে যে টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি বিপজ্জনক কারণ এটি একজন মানুষের  বৃদ্ধি এবং পুরুষ হওয়ার অর্থের সংজ্ঞাকে সীমাবদ্ধ করে রাখে। এটি মানুষ এবং তার পরিবেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে। যখন একজন পুরুষ এই অতিরঞ্জিত পুরুষালি বৈশিষ্ট্যগুলোর  সংকীর্ণ দৃষ্টিতে বিশ্বকে দেখে, তখন সে মনে করতে পারে যে তারা শুধুমাত্র এই বৈশিষ্ট্যগুলি মেনে চলার মাধ্যমেই গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করবে। ফলস্বরূপ সমাজে পুরুষের মধ্যে নারীবিরোধী মনোভাব প্রবল হয়ে উঠতে পারে। এমনকি এই অস্বাভাবিক আধিপত্য চর্চা পুরুষদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব-সহিংসতার সৃষ্টি করতে পারে।

এখন আমরা যদি এর সমাধানের দিকে এগোতে চাই তাহলে প্রথম কাজ হবে পুরুষদের জেন্ডার স্টাডিজের আওতায় আনা। আধুনিক জেন্ডার স্টাডিজে (লিঙ্গ শিক্ষা) মেনজ স্টাডিজ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ পুরুষদের বোঝানো দরকার যে, নারীদের কেবলমাত্র যৌনবস্তু ভাবতে শেখা, উচ্চস্বরে কথা বলা, অন্যের উপর কর্তৃত্ব ফলানো, খিস্তি করা, সেক্সিস্ট জোক বলা, নীল ছবি দেখা- এগুলো করা মানেই পুরুষ হয়ে ওঠা না। তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে শুধু না, সাংগঠনিকভাবে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র পর্যন্ত সকল  স্তর যদি সহায়ক ভূমিকা রাখে তবেই সম্ভব। সকল ক্ষেত্রে টক্সিক ম্যাসকুলিনিটির বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন। কিন্তু এ সমাজ বা রাষ্ট্র এই সহায়তাটুকু করবে কিনা সেটাই প্রশ্ন।

‘ডিয়ার বয়েজ’-এর মতো আরো প্রজেক্ট দরকার। কলকাতা পুলিশের ‘ডিয়ার বয়েজ’ প্রজেক্ট প্রবল বিরোধিতার  মুখে পড়েছিল কারণ  অনেকের ধারণা, এত দায়িত্ব নিয়ে কিশোরদের লিঙ্গ সমতার শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। অথচ বাড়িতে ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লিঙ্গ সমতার শিক্ষা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র মেয়েদের  সম্মান করা, ছেলেদের রঙ বনাম মেয়েদের রঙ, ছেলেদের খেলনা বনাম মেয়েদের খেলনা, মেয়েদের কান্না বনাম ছেলেদের কঠোরতা এই খুব সাধারণ ধারণাগুলো শিশুদের মনে প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়ার সময় থেকেই  শুরু হয় অসমতা। কেঁদে ফেলা পুরুষসুলভ নয়, আবেগ অনুভূতির প্রকাশ পুরুষসুলভ নয়, কিন্তু কর্তৃত্ব করা, দখল করা, গায়ের জোরে ছিনিয়ে নেওয়া পুরুষসুলভ – এইসব ধারণাগুলো দিয়ে নির্মাণ করে দেয়া হয় শিশুর মস্তিষ্ক, আর তা আমরা সকলেই জানি এবং বুঝি। অথচ উত্তরণের পদক্ষেপ নেই না।

এই সমাজ-সংস্কৃতিতে বড় হয়ে পুরুষের পক্ষে নিজেদের কঠোর ও ক্ষমতাশালী মানুষ ভাবা এবং খাদ্য-খাদকের সম্পর্কে বিশ্বাসী হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজ নিজের সন্তানকে কর্তৃত্ব, আধিপত্য, সহিংসতার শিক্ষা দিয়ে, কাল পথে নেমে ধর্ষকের ফাঁসি চাওয়া নিশ্চয়ই ন্যায়সঙ্গত নয়। তার চেয়ে বরং আমরা সচেতন হই, লিঙ্গ সমতায় বিশ্বাসী হই এবং টক্সিক মাসকুলিনিটির জালে জড়িয়ে পড়া থেকে পুরুষকে রক্ষা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *