পুরুষের প্রতি দায়িত্বের ভার: চাপে থাকা ক্ষমতাবান
আমিনা সুলতানা সানজানা ।। আজ বিশ্ব পুরুষ দিবস। প্রতি বছর ১৯ নভেম্বর এই দিবসটি পালন করা হয়। এবারের পুরুষ দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ” নারী পুরুষের আরও ভালো সম্পর্ক।”
প্রথমেই জানাই সকল পুরুষকে এই দিনের শুভেচ্ছা। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে যেমন আমরা নারীদের ক্ষমতায়ন, অধিকার, সমতা, নিরাপত্তা নিয়ে সোচ্চার; নেট ঘেঁটে পুরুষ দিবস নিয়ে তেমন কিছু পাইনি। এর মূল কারণ হিসেবে মনে করা হয় পুরুষ এসবের ঊর্ধ্বে। ক্ষমতা, অধিকার, সমতা ও নিরাপত্তার বিষয়ে পুরুষ নারীর থেকে এগিয়ে। কিন্তু পুরুষ কি পুরুষ থেকে নিরাপদ? জমিজমা, বিষয় সম্পত্তি, টেন্ডারবাজি, রাজনৈতিক মামলাগুলো কিন্তু সে কথা বলে না। পুরুষরা পুরুষ দ্বারা অনেক বেশি নির্যাতনের শিকার হয়। অনেক ক্ষেত্রে নারী থেকেও নিরাপদ কি পুরুষ? আমার এক উকিল বন্ধু একদিন হাসতে হাসতে বলছিল ডিভোর্স যে কারণেই হোক নারী মক্কেলরা যৌতুক, নারী নির্যাতন আর পরকীয়া উল্লেখ করবেই। সে নারী মক্কেলের কথা বললেও বিষয়টা আমরা মোটামুটি সবাই জানি এতে মামলা শক্ত হয়। যে পক্ষ মামলা করে তার জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা শক্ত হয়। ভুয়া মামলাও তাই প্রচুর হয়। সেক্ষেত্রে আসলে বিষয়টা নারী পুরুষে সীমাবদ্ধ না। সামগ্রিক নির্যাতনের শিকার এই সকল মানুষ।
আমার মতে আমাদের উপমহাদেশে একটা পুরুষের প্রতি প্রথম অবিচার করা হয় শিশুকালেই তাকে সামাজিকভাবে সংসারের দায়িত্ব নেয়ার যে বিষয়টি চাপিয়ে দেয়া হয় তখন থেকেই। এটা যেমন তার জন্য একটি চাপ তেমনি এই বিষয়টিই পুরুষকে স্বেচ্ছাচারী হতে শেখায়। ‘ আমার ছেলে আমার বংশের প্রদীপ’ টাইপ কথা বলে একটি পুরুষের উপর সুকৌশলে চাপিয়ে দেয়া হয় একটি পরিবারের দায়িত্ব। তোমাকে বড় হয়ে বাবা মাকে দেখতে হবে, তোমার বউ ও স্ত্রীর দায়িত্ব নিতে হবে- এটাই আশা করে আমাদের পরিবার এবং সমাজ পুরুষদের কাছ থেকে। একই সাথে পরিবারের মেয়েটি যতই মেধাবী হোক, সে যতই পরিবারে সাহায্য করুক তার প্রথম দায়িত্ব মনে করা হয় বিয়ের পর স্বামী ও তার সংসার সামলানো।
ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু সেটা শ’তে দুটিও না। অন্য কোথাও যাবেন কেন, আইনেই এই অসমতা তৈরি করা আছে। বাবার পৈতৃক সম্পত্তি ছেলে মেয়েদের বণ্টনের নিয়ম মুসলিম আইনে ২ : ১। অর্থাৎ রুটি যদি তিনটি থাকে ছেলে খাবে দুইটি আর মেয়ে খাবে একটি। এ যেন সেই মিনা কার্টুনের প্রথম পর্বের মতো, যেখানে দেখানো হয় মিনার ভাই রাজুকে ডিম থেকে শুরু করে সব খাবার বেশি দেয়া হয় আর মিনাকে কম। আফসোস মিনা কার্টুনে সমতা ফিরিয়ে আনতে পারলেও আইনে তা ফিরে আসেনি।
অন্যান্য ধর্মের কথা নাই বা বললাম! বাংলাদেশের মুসলিম আইনের আরেকটা ভয়াবহ বিষয় আছে তা হচ্ছে যদি কোনো ছেলে সন্তান না থাকে তবে ভদ্রলোকের সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ পাবে স্ত্রী এবং বাকি সাত ভাগের অর্ধেক পাবে তার কন্যারা বাকি অর্ধেক পাবে তার ভাই অথবা ভাইদের পুত্র সন্তানেরা। এখন এটা কেমন আইন আমি আসলে বুঝি না। ছেলে পেটে নয় মাস ছিল, মেয়ে কি সাড়ে চার মাসে বের হয়ে গেছে? এই আইনের ভিত্তি কী, জানি না। এই আইনের অপব্যবহার করে অনেক পরিবারের কন্যারা তার বাবার মৃত্যুর পর একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। বিভিন্ন ধরণের ভয়ভীতি দেখিয়ে বাকি সম্পত্তি চাচা, চাচাতো ভাইয়েরা নিয়ে যাওয়ার মামলা লাখো। একটু খবর নিলেই জানতে পারবেন।
মূল বিষয়ে ফিরে আসি। দেখা যাচ্ছে পুরুষদের সামাজিকভাবে যেমন পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে চাপ দেয়া আছে তেমনি তাদের জন্য সম্পত্তির সুবিধাও দেয়া আছে। যেটা তাদের মধ্যে এক রকম শ্রেষ্ঠত্বের জন্ম দেয়। নিজেকে নারী থেকে সেরা ভাবতে শেখায়। যেখানে থেকে, অনেক পুরুষের পক্ষেই সম্ভব না নারীকে তার সমান ভাবা। যদি আপনি নারী পুরুষের সম্পর্ক সুন্দর করতে চান তবে এই ধরনের আইন বাতিল করা সময়ের দাবি। ছেলে হোক বা মেয়ে হোক দুজনকেই পরিবারের দায়িত্ব নিতে শিখতে হবে ছোট থেকেই। বাড়ির কাজে সাহায্য করা থেকে বাইরের কাজে অংশগ্রহণ- সব সমান ভাবে চিন্তা করা উচিৎ। অনেক মা ছেলেদের কাজ করতে দিতে চান না। কষ্ট লাগে এই যুগেও এসব চিন্তাধারার পরিবর্তন হয়নি।
অনেককে দেখেছি ছোট্ট ছেলে বাবুটিকে বলতে “তুমি না ছেলে, ছি ছি ছেলেরা কি কাঁদে?” কান্না একটি আবেগ, সেটি দেখানো যাবে না, তাতে যদি সে ছোট হয়ে যায়! কি আজব সব কথা! এসব ফালতু ভাবনায় একটি ছেলের সুকুমার বৃত্তিগুলো নষ্ট হয়ে যায়, সে নিজেকে কঠিন ভাবতে শেখে। তার কষ্টগুলো সহজে বলতে পারে না। ভেতরে ভেতরে কি কষ্ট পায় না? মানুষ তো, কষ্ট পাওয়াই স্বাভাবিক। হয়তো এই কারণে পুরুষদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের সংখ্যাও বেশি।
একই আদর যত্ন, একই স্কুল পাঠ্যপুস্তক পড়িয়ে বড় করে দুজনকে দুই পথ দেখানো আসলেই কতটা আধুনিক চিন্তাধারার মধ্যে পড়ে, একবার ভেবে দেখবেন!
আবার এমনটিও আমাদের সমাজে কম দেখা যায় না, যেহেতু স্বামী স্ত্রীর দায়িত্ব নিতে বাধ্য তাই কোনো কোনো স্ত্রীর আকাশ ছোঁয়া চাহিদা পূরণ করতে করতে স্বামী বেচারা হাবুডুবু খায়। টাকা কোথা থেকে আসবে, কীভাবে আসবে তার চিন্তা না করেই স্ত্রী আবদার করতে থাকেন! একজন মানুষ যখন নিজে আয় করেন তখন কিন্তু এই বিষয়গুলো বোঝেন। অন্যের কাছ থেকে পেতে পেতে অনেকেই বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন যে জিনিসটা আসবে কীভাবে!
কয়েক বছর আগে বড় ছেলে নামক একটি নাটক খুব সাড়া ফেলেছিল। আমিও কেঁদেছি দেখে। দেখানো হয় পরিবারের দায়িত্বের কথা ভেবে ছেলেটি তার প্রেমিকাকে না করে দিতে বাধ্য হয়। একটি ছেলে যে কিনা তার প্রেমিকার প্রতি দায়বদ্ধ ছিল, শুধু পরিবারের দায়িত্বের তাগিদে সে তা প্রত্যাখ্যান করে।
এমন হাজার হাজার বড় ছেলের কথা মনে পড়ছে আমার, যাদের ত্যাগ আমি দেখেছি পরিবারের জন্য। আমার নিজের বড় ভাইও আছে এই দলে। অথচ ওই পরিবারে সম্ভাবনাময় মেয়েও ছিল। যাদের বিয়ে দিয়ে নিজের পরিবারের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়া হয়েছিল।
পুরুষের প্রতি দায়িত্বের এই প্রত্যাশা কোনো কোনো পুরুষকে যেমন চাপে রেখেছে, তেমনি কোনো কোনো পুরুষকে ভাবতে শিখিয়েছে ক্ষমতাবান। তাই এই প্রত্যাশা বলি, সামাজিক পারিবারিক চাপ বলি বা ক্ষমতার অধিকারীই বলি না কেন, আগে এই অসমতা ভাঙতে হবে। তখন সমাজে নারী পুরুষ বৈষম্য এমনিতেই কমে যাবে। সম্পর্কেও উন্নয়ন হবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]