ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিজম: অধিকারের কোনো বিভাজন নেই
ফাতেমা তুজ জোহরা ।।
নারীবাদী তত্ত্বের দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান দাবি হলো লিঙ্গ বৈষম্যহীন একটি সমাজ। কিন্তু আসলেই আমরা এখন কতোটা বৈষম্যহীন সমাজে বাস করছি? বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ এর সংকটের সময় প্রকৃতি ও মানুষের হাহাকার দেখে খুব সহজেই অনুমেয়, সমতা এখনো বহু বহু দূর। এই সংকটে খুব তীব্রভাবেই প্রকাশ পেয়েছে যে লিঙ্গ বৈষম্যের পাশাপাশি জাতিগত বৈষম্য, বর্ণ বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষাগত বৈষম্যসহ আরো নানা ধরণের বৈষম্যের কারণে সমতা অর্জন করতে আমরা এখনো সক্ষম নই।
এই যে নানা ধরনের বৈষম্যের কথা বলছি, এইসব অসমতার ভিতরেও কিন্তু আরেক ধরনের অসমতা রয়েছে। চলুন, একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। ধরুন, আমেরিকায় একজন পুরুষ ঘন্টায় ১০ ডলার করে উপার্জন করেন। একই সময় পরিশ্রম করে একজন শ্বেতাঙ্গ নারী হয়তো ৮ ডলার উপার্জন করেন। ঐ একই সময় পরিশ্রম করে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী উপার্জন করেন ৫ ডলার। কেন?
কারণ, একজন শ্বেতাঙ্গ নারী তার নারী পরিচয়ের জন্য লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হলেও জাতিগত পরিচয়ের জন্য বৈষম্যের শিকার হন না। আবার একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী একই সাথে তার নারী পরিচয় এবং তার গায়ের রঙের কারণে বৈষম্যের শিকার হন। পাশাপাশি একজন লেসবিয়ান নারী তার নারীপরিচয়ের সাথে সাথে যৌন পরিচয়ের জন্যেও বৈষম্যের শিকার হন।
নারী হবার সাথে সাথে জাতিগত, বর্ণগত, গোষ্ঠিগত, ধর্ম, শিক্ষাগত ও যৌনতা পরিচয়ে পার্থক্যসহ নানারকম কারণেও একজন নারী অন্য নারীর চাইতে আরো বেশি বৈষম্য ও অসমতার শিকার হতে পারেন। এই ধরনের অসমতা নিয়ে আলোচনা করা হয় ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিজম বা আন্তঃবিভাজন নারীবাদ তত্ত্বে।
নারীবাদী আন্দোলনে যেমন নারীর অধিকার, লিঙ্গ সমতার কথা বলা হয়, আন্তঃবিভাজন নারীবাদেও নারীর অধিকারের কথাই বলা হয়, তবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও যৌন পরিচয়ের ভিত্তিতে একজন নারী কীভাবে অন্য নারীর চেয়েও অনেক বেশি বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হন, সে বিষয়ে মূলত আলোকপাত করা হয়।
নারীবাদী আন্দোলনের ভিতর অন্যরকম বৈচিত্র্যময় আন্দোলন হলো ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিজম। বহু বছর ধরেই বিভিন্ন নারীবাদীরা কিন্তু ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিজম নিয়ে কথা বলে আসছেন। ১৯৮৯ সালে নাগরিক অধিকার আইনজীবী কিম্বার্লে ক্রেনশ ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিজম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। তিনি যখন আইনের ছাত্র, তখনই লক্ষ্য করেন কীভাবে আলাদা আলাদা বর্ণের এবং গোত্রের নারীরা অন্য নারীদের তুলনায় বেশি পরিমাণ লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। একটি মামলায় তিনি লক্ষ্য করেন, নারীরা মামলা হেরে যায় নারী বলে বা কালো মানুষ বলে নয়, বরং কালো নারী বলে।
ক্রেনশ দাবি করেন শুধু তিনিই নন, আন্তঃবিভাজন নারীবাদ শব্দটির অর্থ প্রকাশে ভূমিকা রয়েছে ১৯ শতকের ব্ল্যাক লিবারেশন অ্যাক্টিভিস্ট আনা জে. কুপার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কর্মী জীবন্ত কিংবদন্তি অ্যাঞ্জেলা ডেভিসেরও।
ক্রেনশের ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিজম নিয়ে আলোচনার উপর ভিত্তি করে আধুনিক নারীবাদীরা কিন্তু অনেকটা এগিয়ে গেছেন। এখন ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিজম বলতে শুধুই আমরা লিঙ্গ এবং জাতিগত বিভাজন বুঝিনা, বরং ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিজম লিঙ্গ, জাতি, বর্ণ, শ্রেণি, বয়স, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, শারীরিক বা মানসিক সক্ষমতা, যৌন পরিচয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে অসমতা নির্দেশ করে।
নারীবাদ আন্দোলনে আন্তঃবিভাজন নারীবাদ অন্য একটি মাত্রা যোগ করে। আমরা সাধারণ নারীদের চিৎকার শুনতে পাই। কিন্তু সেই প্রান্তিক নারীটির কী হবে? যে নারী তো বটেই, তবে নারী হবার সাথে সাথে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করে বলেই হয়তো বা শহুরে কোনো নারীর চাইতেও কম অধিকার ভোগ করছে। বা সেই নারীটির চিৎকার কি আমরা শুনতে পাই, যে হয়তো লেসবিয়ান হবার কারণে অন্য নারীর তুলনায় সমাজে অনেক বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে? বা সেই হিন্দু নারীটির চিৎকার কি আমরা শুনতে পাই, যে ধর্ষিত হয় শুধুমাত্র ধর্ম পরিচয়ের কারণে?
আন্তঃবিভাজন নারীবাদ শুধুমাত্র শহুরে নারী নয়, বরং একজন কৃষ্ণাঙ্গ, একজন লেসবিয়ান, একজন পাহাড়ি আদিবাসী, একজন অশিক্ষিত গ্রামের নারী – সবার অধিকারের জন্য সমভাবে আন্দোলনের কথা বলে। অর্থাৎ একজন শ্বেতাঙ্গ নারী সমাজে ঠিক যা যা অধিকার ভোগ করবেন, একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীও ঠিক সেই অধিকার ভোগ করার দাবি রাখেন। আবার একজন ধর্মীয় পরিচয়ে সংখ্যালঘু নারীও যেন সমঅধিকার ভোগ করেন।
আন্তঃবিভাজন নারীবাদ বা ইন্টারসেকশনাল ফেমিনিজম নারীবাদের চতুর্থ ঢেউয়ের সাথে বেশি জনপ্রিয় এবং আলোচনায় এসেছে। শুধুমাত্র গায়ের রঙ বা অন্য জাতির হওয়ার কারণে একজন নারীকে অন্যান্য নারীর তুলনায় অনেক বেশি অসমতার শিকার হতে হয়। বিশেষ করে যারা লেসবিয়ান, তাদের উপর যে কোনো অত্যাচার-অবিচারের সুরাহা পাওয়া যায় না কেবলমাত্র তাদের যৌন পরিচয় ভিন্ন বলে। অথচ তারাও নারী এবং নারী হিসেবে সমাজে সকল বিষয়ে সম অধিকার তার প্রাপ্য।
আন্তঃবিভাজন নারীবাদ নিয়ে ব্রাজিলিয়ান বিখ্যাত নারী অধিকার অ্যাক্টিভিস্ট ভেলদেচির নাসিমেন্তো দারুণ কিছু কথা বলেন। নাসিমেন্তো প্রায় ৪০ বছর ধরে ব্রাজিলে নারীদের সমঅধিকারের জন্য লড়াই করছেন। তার মতে, ‘‘কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের অধিকারের কথা বলার জন্য তাদেরকে সামনে আসতে হবে। তাদের হয়ে অন্য কেউ অধিকারের কথা বললে চলবে না। ব্রাজিলে কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা বরাবরই তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করে আসছে। নারীবাদী আন্দোলন থেকে শুরু করে বর্ণবাদী আন্দোলনসহ অন্যান্য সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের সরব ভূমিকা ছিলো। কাজেই এই কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের পক্ষে কোনো শ্বেতাঙ্গ নারীবাদী বা কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ কথা বলুক, আমরা তা চাইনা। বরং আমরা চাই সমস্যা সমাধানে কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা এগিয়ে আসুক’’।
কতো চমৎকারভাবে নাসিমেন্তো তার কথার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন আন্তঃবিভাজন নারীবাদ আন্দোলনেও যে নারীটি তার গায়ের রঙের অন্য নারীর তুলনায় বেশি অসমতার শিকার হচ্ছে, তাকে তার নিজের অধিকারের জন্য নিজেকেই সামনে আসতে হবে।
গুয়াতেমালার আদিবাসী নারী মানবাধিকার কর্মী সোনিয়া মারিবেল সোনটে হেরেরা আন্তঃবিভাজন নিয়ে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশ করেছেন। হেরেরার বয়স তখন মাত্র ১০, শহরের স্কুলে সে সময় তিনি পড়াশুনা করার সুযোগ পান, যেটা অনেক আদিবাসীই পায় না। কিন্তু সেই স্কুলে তাকে বাধ্য হয়ে নিজের ভাষা ছেড়ে ফ্রেঞ্চ শিখতে হয় যেটা একজন আদিবাসীর পক্ষে বেশ কষ্টসাধ্য এবং অন্যায্য। আবার সেই ভাষাটি ছিল উপনিবেশিক ভাষা। পড়াশুনা শেষে হেরেরা যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন তখন তাকে শুনতে হয়েছে যেহেতু তিনি আদিবাসী কাজেই তিনি শুধুমাত্র গৃহকর্মেই নিপুণ। তার জন্য গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করাই শ্রেয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র আদিবাসী হবার কারণেই তার অন্য সব যোগ্যতাকে খাটো করে দেখা হয়। আদিবাসী নারী মানে শুধুই গৃহকর্মী। শুধুমাত্র তার আদিবাসী পরিচয়ের কারণে তাকে জীবনের লম্বা সময় জাতিগত বৈষম্য এবং লিঙ্গ বৈষম্য, দুটোরই শিকার হতে হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে এ রকম অসমতার কারণে অনেক সম্প্রদায় হুমকির মুখে। আবার আশার কথা এই যে এই সম্প্রদায়গুলো তাদের মতো করে তাদের জায়গা থেকে সবাই একসাথে এসব বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে। একে অপরের সাথে একাত্মতা নিয়ে দাঁড়ানো এবং আন্তঃবিভাজন বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলা আসলে প্রতিবাদের শুরু।
ক্রেনশের দারুণ একটা কথা আছে, “কেউ যদি অন্য কারো আন্তঃবিভাজনজনিত পার্থক্যকে তার দুর্বলতা বা সমস্যা হিসেবে দেখে, তাহলে সমস্যাটা আসলে তার দেখার মধ্যেই”।
আসলেই তাই। একেক জন তার মতো করে একেক রকম হবে। কেউ কালো, কারো ধর্ম পরিচয় ভিন্ন, কেউ দেখতে খাটো, কেউ বা আদিবাসী। সেটা কারো দুর্বলতা বা সমস্যা নয়। এটা শুধুমাত্র মানুষে মানুষে একটা গৌণ পার্থক্য। এসব কোনো পার্থক্যই মানুষকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।