April 29, 2024
ফিচার ৩সাক্ষাৎকার

নিজেকে সেক্স অবজেক্ট ভাবলে, একদিন বলতে ইচ্ছে হবে ‘আমি বাঁচতে চাই’

জেসিকা ভ্যালেন্টি একজন মার্কিন নারীবাদী লেখক, অ্যাক্টিভিস্ট। ‘ফেমিনিস্টিং’ নামের জনপ্রিয় ব্লগসাইটের সহপ্রতিষ্ঠাতা। ২০০৪ সালে ভ্যালেন্টি ‘ফেমিনিস্টিং’ প্রতিষ্ঠা করেন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল নারীদেরকে নারীবাদী চিন্তা ও লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত করা। তার ওয়েবসাইটটি যথেষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণ ও সুনাম অর্জন করে। যার ফলশ্রুতিতে ভ্যালেন্টিকে অনলাইন নারীবাদী আন্দোলনের পথিকৃতের কৃতিত্ব দেওয়া হয়।  

তার প্রথম স্মৃতিকথার বই ‘সেক্স অবজেক্ট; অ্যা মেমোয়্যার’ প্রকাশ হয় ২০১৬ সালে। বইতে কুইন্সে তার শৈশব এবং নিউ ইয়র্ক সিটিতে তার যৌবনকালের স্মৃতিচারণে পাঠকদের নাড়া দিয়েছেন। একজন মা এবং খ্যাতিমান নারীবাদী লেখক হিসেবে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো খোলাসা করেছেন। তার বইতে বাস্তব জীবনের সেক্সিজম এবং মানসিক ব্যাপারগুলোর মেলবন্ধনের একটা ধারণাও পাওয়া যায়। তার অন্যান্য বইগুলো হলো- ফুল ফ্রন্টাল ফেমিনিজম(২০০৭), পিউরিটি মিথ(২০০৯) হোয়াই হ্যাভ কিডস (২০১২)। 

‘সেক্স অবজেক্ট’ এ ভ্যালেন্টি তার নিজের জীবনের যৌন অভিজ্ঞতা (ভাল এবং খারাপ উভয়) প্রকাশ করেছেন এবং হয়রানির মোকাবিলা, মাদক গ্রহণ, গর্ভপাত করা সম্পর্কেও লিখেছেন। প্রসবকালীন সময়ে বিবাহিত বন্ধুর আগমন এবং প্রায় মৃত্যু পথযাত্রার বেদনাদায়ক  দিনগুলোর কথাও তুলে এনেছেন। তার নিজের মাতৃত্ব কেমন ছিল, বিবাহিত জীবনের যন্ত্রণার বিববরণ এবং শৈশবে তার সৎ মা ও দাদীর দ্বারা নির্যাতনের সন্ধানও পাওয়া যায় বইতে।

ভ্যালেন্টি কখনো শৈল্পিকভাবে, কখনও বা হাস্যকরভাবে  এমন এক সংস্কৃতির কথা তুলে এনেছেন, যেখানে নারীদের মূল্য দেওয়া হয়  ‘যৌন আবেদনময়ী’ হিসেবে নয়, বরং তাদেরকে নিজেদের ঘৃণা করতে বাধ্য করা হয় যে কেন তারা যৌনমিলনে লিপ্ত হয়েছে বলে। ‘সেক্স অবজেক্ট’ বইটি আরো আলাদা মনে হবে কারণ এতে দৈনন্দিন জীবনে ইন্টারনেটের সাথে যৌনতার এক আধুনিক সম্পর্ককেও অনুসন্ধান করা হয়। ভ্যালেন্টি আওয়াজ তোলেন সে সকল ঘৃণাপোষণকারী মন্তব্য ও অনলাইন ট্রলের বিরুদ্ধে যা একজন মিসোজেনিস্ট প্রতিদিন করে থাকেন। তিনি দেখান এই কুৎসিত মন্তব্য কিভাবে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে এবং তা শেষ হয় নারীদেরকে ‘সেক্স অবজেক্ট’ অর্থাৎ যৌনবস্তু ভেবে। এমন হাজারো মেসেজ যা তিনি সোশ্যাল মিডিয়াসহ নানাভাবে পেয়েছেন, সেসবও তুলে দিয়েছেন বইয়ে।

জেসিকা ভ্যালেন্টের এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন ক্যাটিও রেইললি, ২০১৬ সালে সেক্স অবজেক্ট বইটি প্রকাশের আগ মুহুর্তে। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন সাদিয়া মেহজাবিন ।।

 

আপনার কখন মনে হয়েছে, আপনার জীবনের এই স্মৃতিকথা নিয়ে লেখার প্রয়োজনীয়তা আছে? এই সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলুন

এটি কোনো ঘটা করে নেওয়া সিদ্ধান্ত ছিল না, হুট করেই হয়ে গেছে। আমি মূলত ঝোঁকের বশে লেখা শুরু করেছিলাম, ‘ইট মি’ নামক একটি ফুড কলাম নিয়ে যেখানে পরবর্তীতে আমার পরিবার এবং আমার যৌবনকালে কথা চলে আসে যা আমার আশার বাইরে ছিল। এভাবে লেখালেখি করা আমি খুব উপভোগ করছিলাম; এটা একটি নতুন লেখার ধরণ হয়ে উঠছিল আমার কাছে। আমার জানার বাইরেই এটি প্রচুর সাড়া পেয়েছিল; আমি একদম আমার নিজের মত করে লিখতে ভালোবাসি। তাই এটি এমন ছিল না ‘ওহ আমার এই বইটা লিখতে হবে’ বরং আরো বেশি ছিল ‘আচ্ছা আমার এই বইটির তো অর্ধেকের বেশি লেখা হয়ে গিয়েছে’।

কোন দৃষ্টিকোণ থেকে আপনার মনে হয় ‘সেক্স অবজেক্ট’ সামাজিক পরিবর্তনের বাহন হয়ে উঠবে?

আমি এর আগেও নারীবাদী বিভিন্ন তত্ত্ব নিয়ে লিখেছি, তাই আমার মনে হয়নি বিশেষ করে এই বইটিতে এর প্রয়োজন আছে। আমি শুধু চেয়েছিলাম, বইটি নিজের মত করে দাঁড়াক। এই মুহূর্তে, আমরা এমন এক সময়ে আছি যেখানে নারীরা তাদের গল্প বলছেন, নিজেরাই প্রথম বক্তা হচ্ছেন; যেখানে রাজনৈতিক ভিত্তিকে আরো মজবুত করতে তাদের অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করছেন। এবং আমি শুধু আমার বই বা কলামেই এটি উল্লেখ করছি না, আমি টুইটারেও তা বলছি যেখানে লাখ সংখ্যক মানুষ #ইয়েসঅলউইমেন বলছে।

আপনি বলেছিলেন, নারীরা যখন নিজেদের গল্প বলে তা আপনাকে মুগ্ধ করে।

এটি আসলেই বেশ মনমুগ্ধকর। দীর্ঘ সময় ধরে, এখানে পুরুষদের গল্প এবং অভিজ্ঞতাকে বেশ দৃষ্টি দেওয়া হচ্ছে; যা পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী ধ্রুব ধরে নেওয়া হয় যেখানে নারীদের গল্পগুলো বেশ স্বতস্ফূর্ত ও প্রয়োজনীয়। ধরুন সেক্স নিয়ে যদি কোনো নারী লেখে তাহলে ধরে নেওয়া হয় সে লোকের মনোযোগ চাচ্ছে; কিন্তু সেই লেখা যদি ফিলিপ রথ লেখেন তাহলে তাকে আপনারা সাহসী এবং অসাধারণ বলবেন। সত্যিই! এখন এমন বিষয়গুলো আমাকে ভাবায় এবং আমার মনে হয় এসব বিষয়ে লেখা ও কাজ দুইটিই জরুরি। এই প্রক্রিয়ায় এটা উত্তেজনাকর, সাথে ভয়ানকও এবং আপনি জানেন এক অনিবার্য যুদ্ধের জন্যে আপনি প্রস্তুত হচ্ছেন। এ বইটি এখনো বাজারজাত হয়নি কিন্তু লোকে এখনই বইয়ের প্রচ্ছদের ছবি নিয়ে লিখছে, ‘জেসিকা ভ্যালেন্টি ভাবছে সে একজন আবেদনময়ী সেক্স অবজেক্ট! কে এই মহিলা?’ এবং আমি জানি এমনটাই হতে চলেছে।

আপনার কি মনে হয়, অনলাইনে যেসব নারী এবং নারীবাদীরা হয়রানীর শিকার হচ্ছেন, মেসেজ পাচ্ছেন, কর্তৃপক্ষের এ বিষয়টি নজরে এসেছে? এই ব্যাপারে কী করা যায় বলে আপনি ভাবছেন?

আমি এই বিষয়ে প্রথম কলাম লিখি ২০০৬ সালে। তার মানে আমরা এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি প্রায় দশ বছর যাবৎ। কিন্তু মনে হচ্ছে, এ বিষয়টি এখনো নতুন আমাদের কাছে। লোকেরা বুঝতে শুরু করেছে, এটি একটি জরুরি বিষয়। প্রায় মনে হয় এটি একটি অগ্নিচুলা এবং আপনি টিকে থাকতে না পারলে বেড়িয়ে যান। তবে ব্যাপারটা হচ্ছে, এটি একটি অনলাইন মাধ্যম এবং এখানে কিছু একটা করা যেতে পারে। ধরুন, ইউটিউব! এর একটি এলগরিদম আছে, ফাংশন আছে এবং কপিরাইটও আছে; তাই তারা চাইলে কপিরাইট আইনের সাহায্য নিতে পারে। যদি সোশ্যাল মিডিয়ার সাইটগুলো তাদের যথেষ্ট স্মার্টনেস দেখায়, আমার মনে হয় অনলাইনের ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো বন্ধ হতে পারে। আমার মনে হচ্ছে না তারা আদৌ এর বিরুদ্ধে কোনো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে।

বইয়ের সমাপ্তি আপনাকে অনলাইনে ক্রমান্বয়ে হয়রানির প্রতিবাদ দিয়ে, সে সম্পর্কে আমাদেরকে বিস্তারিত কিছু বলুন

আমার লেখা সব বই একটি লক্ষ্য নিয়ে ছিল; তরুণ নারীদের নারীবাদ নিয়ে একটি তাৎক্ষনিক পরিচয় দেওয়া ছিল মূল লক্ষ্য। তাই হুট করে এমন কিছু লেখা বেশ মজার কেননা এর কোনো নির্দিষ্ট টার্গেট নেই। ঠিক তখনই আমার মনে হয়েছে আমার উচিত হবে না একটি নড়বড়ে ধনুক দিয়ে বইটি শেষ করা। আমি সকলকে দেখাতে চেয়েছিলাম অনলাইনে হয়রানি আর আমাদেরকে পণ্যের মত করে দেখা একটি নিত্যদিনের ব্যাপার ও আলাপ হয়ে উঠছে যার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ করা উচিত।

আপনার বইটি পড়ে আমি বেশ আনন্দ পেয়েছি; বিশেষ করে আপনার অকালানুক্রমিক গঠনটি ভালো লেগেছে। শুরু করেছেন, সাতাশ বছর বয়সে গর্ভপাত দিয়ে এরপর চলে গেলেন আপনার যৌবনের সে সময়ে, আবার ফিরে এসেছেন দ্বিতীয় গর্ভপাতের স্মৃতিতে। যেসবের স্মৃতি ছিল একই ক্লিনিকের সাথে। শেষ পর্যন্ত এই গঠনটি ধরে রেখেছেন। আপনি কীভাবে এত সুন্দর করে সব কিছু গুছিয়েছেন?

সব মিলিয়ে এটি একটি জটিল সিদ্ধান্ত ছিল। আমার ভাবনার একটি অংশ জুড়ে ছিল যে প্যারাগ্রাফ লেখার চেয়ে বরং আমি সোজাসাপ্টা একটি অধ্যায় লিখব। কিন্তু আমি যখন সেভাবে শুরু করলাম তখন আমার তা তেমন খাঁটি মনে হলো না। পরে আমি অনুভব করলাম, আমার লেখা প্রত্যেকটি অধ্যায় আলাদা এবং তাদের নিজেদের মত করে দাঁড় করানো উচিত। কিন্তু আমি জানতাম, আমি গর্ভপাতের বিষয়টি দিয়ে শুরু করতে চাই। তবে সত্য হচ্ছে আমি চেয়েছিলাম দ্বিতীয় গর্ভপাতের ঘটনাটি দিয়ে শেষ করতে। এই সিদ্ধান্ত আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কেননা যেমন এটা আমার দুঃখের মূল, তেমন আমার বেঁচে থাকার তাগিদও। যখন আপনি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে বেড়ে না উঠে নিজেকে বস্তু ভাবা শুরু করবেন, তখন আপনার এক সময় বলতে ইচ্ছা করবে ‘আমি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন চাই, আমি বাঁচতে চাই, নিজের জন্যে সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটা নিতে চাই’; আমার বইতে আমি এসবকে খুব প্রাধান্য দিয়েছি।

আপনার বইটি লেখার প্রক্রিয়া কী ছিল? আপনার অভিভাবক কলাম এবং আপনার ব্যস্ততা ; আমি জানি আপনি খুব ব্যস্ত থাকেন।

আমি ঘুমাই না [মুখে হাসি]। আমার কোনো নির্দিষ্ট রুটিন নেই। আমি সেসব লোকের তালিকায় নই যারা ভোর ছয়টায় ওঠে এবং দশ পৃষ্ঠা লেখে। আমার জীবন খুব আমোদে ভরা। আমার একটি চাকরি আছে এবং পাঁচ বছর বয়সী সন্তান আছে। আমি যখন বইটি লেখা শুরু করি তখন আমার মেয়ের বয়স তিন বছর; তাই যখনই সময় পেতাম, লিখতাম। আমার স্বামীও মিডিয়াতে কাজ করে এবং সে বেশ পরিশ্রমী। আমরা খুব দ্রুত সময়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমাদের ফোকাস কোথায় এবং আমরা কাজ ও পরিবারকে কীভাবে গুছাবো। তাই আমরা খুব একটা সামাজিক অনুষ্ঠানে যাই না। তাই বন্ধুদের সাথে বছরে এক দুইবার দেখা হয়; নাহয় এসব কখনোই সম্ভব হতো না। সবকিছুকে সহজ মনে করেন যারা তাদেরকে আমার খুব অপছন্দ; কেননা আসলে কাজের পাশাপাশি একটা বই লেখা বেশ কঠিন। সাথে আপনার পরিবার আছে এবং আপনি আপনার কাজে সফল হতে চান; এটা বেশ কঠিন।

বইটি নিয়ে আপনার আপনজনদের প্রতিক্রিয়া কেমন?

আমার মনে হয় তারা বোঝে এমন বড় পরিসরে কাজ করার মানে। তাই তারা স্বাভাবিক এবং স্বতস্ফূর্ত ছিল। বিশেষ করে সবই ঠিক ছিল। আমার পরিবার বেশ সহযোগী এবং এ বিষয়টি আমার মায়ের কাছেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমার স্বামী ও আমার মধ্যে বেশ আলোচনা হয় আমার মেয়েকে নিয়ে; তার জন্যে সবচেয়ে ভালো কী হবে; পনেরো বছর বয়সে এই বইটি পড়তে তার কেমন লাগবে! তাই আমার মিশ্র অনুভুতি ছিল যখন তাকে নিয়ে লিখছিলাম। কিন্তু আমি জানি তাকে নিয়ে কিছু বিষয় লেখা বেশ জটিল ছিল কেননা এরপর আমার দ্বিতীয় গর্ভপাত হয়।

বেশ! তাহলে এরপর কী নিয়ে লিখছেন?

আমার মাথায় বেশ কিছু ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে পরবর্তী বই নিয়ে। কিন্তু তাও খুব পাকাপোক্ত নয়। দি গার্ডিয়ান-এ হিলারি ক্লিন্টনকে নিয়ে এখন লিখতে বেশ ভালো লাগছে। সত্যি কথা বলতে আগামীর নির্বাচন আমার লেখার বেশ অংশ নিয়ে নেবে।

কোন স্মৃতিকথা লেখক বা কলাম লেখক আপনাকে বেশি অনুপ্রাণিত করেন?

রোক্সান গে প্রথম ব্যক্তি, যিনি এখন মাথায় আসছেন। আমার মনে হয় তার কাজগুলো বেশ গতিশীল, যেখানে লোকে নিজেদের গল্প থেকে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে নারীবাদী কলাম লিখতে। রোক্সান সত্যি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আমার ‘লিন্ডি ওয়েস্টের’ কাজও বেশ ভালো লাগে। আসলে ভালো লাগে যখন দেখি, নারীরা নিজেদের মত করে বাঁচতে শিখছেন, নিজেদের কথা লিখছেন নিজেদের মত করে। মিডিয়া অথবা অন্যরা আপনাকে কোন গণ্ডির ভেতর ফেলছে, তা কখনোই জরুরি না। তারা তাদের স্বার্থের জন্যে করে। এবং বিশেষভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশাল এক পরিসর হচ্ছে যা দশ বছর আগেও ছিল না, যেটি ইন্টারনেটের আরেকটি ভালো দিক।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *