ধর্ম ও রীতির নামে নারী-নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো একাকী রোকেয়া
পূরবী চৌধুরী ।।
বেগম রোকেয়ার যখন জন্ম নেন, সেই সময় মেয়েদের স্বাভাবিক লেখাপড়া করার কোনো সুযোগ ছিলনা, এ তো আমরা কম বেশি সবাই জানি। বাড়িতে ধর্মশিক্ষার কিছুটা ব্যবস্থা হয়তো প্রভাবশালী পরিবারে ছিল। কিন্তু মেয়েরা স্কুলে যাবে, একথা চিন্তারও বাইরে। তো সেই সময়, সেই ১৮৮০ সালে, রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার বাড়িতে জন্ম নিলেন রোকেয়া, তাঁর আবার পড়ালেখার প্রতি ভীষণ আগ্রহ শৈশব থেকে। ফলে নিয়ম ভেঙ্গেই বাংলায় লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় রোকেয়ার ভাইয়ের কাছে। যদিও বাবা জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ আলী হায়দার সাবের নারীশিক্ষার ঘোর বিরোধী ছিলেন, তাই বাড়িতে আরবী শিক্ষা কোরান পড়ার পাশাপাশি ও ফারসি শেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু সেটাও কোরান পড়তে পারা অবধি সীমাবদ্ধ ছিল। জমিদার পুত্ররা অর্থাৎ রোকেয়ার ভাইয়েরা তখন কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তেন, তাই ছোট ভাই যখন বাড়ি আসতেন তখন তাঁর কাছে উর্দু এবং বাংলা শিখতেন। বেগম রোকেয়ার বড় বোন অল্প বয়সে বিধবা হয়ে বাড়ি চলে আসলে সেও তাঁকে এই পড়ালেখায় বেশ সাহায্য করেছিলেন। বেগম রোকেয়া তাঁর লেখায় তাঁর জীবনের শিক্ষাপ্রাপ্তির পেছনে ভাই ও বোনের অবদানের কথা লিখে গেছেন।
জমিদার পরিবারে জন্মালেও কঠোর পর্দা প্রথার কারণে বোনরা সবাই প্রায় শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিতই থেকে যায়। কিন্তু বেগম রোকেয়ার জ্ঞানতৃষ্ণা কোনো বাধাতেই থেমে থাকেনি বা থামিয়ে রাখতে পারেননি, তাই তাঁর মা তাঁর জন্য বাড়িতে একজন শিক্ষিকা রেখে দিয়েছিলেন। শুরু হলো বেগম রোকেয়ার জ্ঞান আহরণ, বাংলা ভাষার প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা। নানা রকমের বিভিন্ন দেশের বই পড়া শুরু হলো, ইংরেজির উপরও দখল ছিল ভালো, যদিও বাংলাভাষাতেই পড়তে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তিনি।
বেগম রোকেয়া সময়ের নারীরা প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তার একটা বড় কারণ সামাজিক বিধিনিষেধ তো বটেই, সেই সাথে নারীদের নিজেদের সচেতনতার অভাবও তাদের অগ্রযাত্রায় বড় বাধা ছিল। এমন কি সেই সময় নারীরা একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে নিজেদের উন্নয়নের জন্য প্রাপ্ত সুযোগ নিতেও ভয় পেতেন। কারণ নারীদের লেখাপড়া সে সময় অকল্পনীয় ছিল। এই সংকীর্ণ সামাজিক মনোভাব এবং নারীর নিজস্ব উদাসীনতা নারীর চিন্তাচেতনাকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছিল। সেই সময় ধর্মও সামাজিক বিধিনিষেধ এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল যে প্রায় সবাই নারী শিক্ষার বিপক্ষেই ছিলেন। মোটামুটি সেই সময়কার নারীরাও এমন ভাবনাই পোষণ করতেন যে নারীদের বিচরণ হবে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে এবং তাদের নিজস্ব কোনো মতামত থাকবে না।
বেগম রোকেয়া ছিলেন জমিদার কন্যা এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের, তবু তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণের অনুমতি ছিল না। তাহলে সাধারণ নারীদের সামাজিক অবস্থান কতটা শোচনীয় ছিল, তা নিশ্চয়ই আন্দাজ করা যায়। বেগম রোকেয়া সেই সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে নারীদের জন্য কণ্ঠস্বর হয়েছিলেন, তাদের এই পরিস্থিতি থেকে তুলে আনতে চেয়েছিলেন। অবরোধ-বাসিনীতে তিনি লিখেছেন- বহুদিন অবরোধে থেকে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি, তাই অবরোধের বিরুদ্ধে বলবার মতো আমাদের কিছুই নাই কারণ যারা মাছের কাজ করেন তাদের পচা মাছের গন্ধ ভালো না খারাপ জিজ্ঞাসা করলে তারা কোনো উত্তর খুঁজে পাবেন না। সেই সময় নারীদের পর্দা কেবল পুরুষের কারণে ছিল না, অপরিচিত মেয়েদের সামনেও পর্দা করতে হতো। ধর্মের এসব কঠোর বিধিনিষেধ কেবল নারীদের প্রতিপালনের জন্যই ছিল এবং প্রতিনিয়ত তারাই শোষণ, নিপীড়ন এবং প্রবঞ্চনার শিকার হচ্ছিলেন।
অবরোধবাসিনীতে তিনি সেইসময়ে নারীর সার্বিক অবস্থান বর্ণনায় অনেক ঘটনাই উল্লেখ করেছেন। যেখানে মেয়েদের ৫ বছর বয়স থেকেই পর্দা করতে হতো। সেই পর্দাতে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে চোখে দেখার পর্যন্ত ব্যবস্থা ছিল না। যারা যত বেশি পর্দা করতেন, যারা কখনোই জনসম্মুখে আসেন নাই, যাদেরকে কখনোই কেউ দেখেন নাই, তারাই শরীফ বলে বিবেচিত হতো। একবার এক হাজী সাহেব ট্রেন যাত্রায় বেগম সাহেবাদের নিয়ে গেছেন, সেখানে সে তাদেরকে পর্যন্ত ওয়েটিং রুমে বসানোর প্রয়োজন মনে করেন নাই, মোটা মোটা কাপড়ের বোরকা পরার পরও তাদের স্টেশনের প্লাটফর্মে উবু হয়ে বসতে বললেন এবং তাদের উপর একটা মোটা শতরঞ্জি দিয়ে ঢেকে দিলেন। বাইরে থেকে দেখে তাদের মালামালের বস্তা মনে হচ্ছিল এবং সেখানে একজন পুরুষ তত্বাবধায়ক রেখে তিনি কাজে গিয়েছিলেন। এক বাড়িতে আগুন লাগার পর সেখানে থাকা গৃহিনী বাঁচার জন্য বাইরে আসার চেষ্টা করে দেখলেন বাইরে পুরুষরা আগুন নেভাচ্ছেন, তিনি আর বের হলেন না, আগুনে পুড়ে মারা গেলেন।
মেয়েদের লেখাপড়া তো দূরের বিষয়, তাদের খারাপ লাগা, ভালো লাগা এবং বেঁচে থাকার অধিকারই ছিল না। পুরুষের সম্মুখে আসা এবং বাইরে যাওয়া রীতিমতো নিষিদ্ধ ছিল। মহিলাদের পর্দা করার ব্যাপারে রোকেয়া বলেছেন, এটি মহিলারদের ঘরে বন্দি রেখে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া একটি মৃত্যুকূপ, এর দোহাই দিয়েই নারীদের ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে কারণ এটি অবশ্য পালন করতে হবে এমন একটি ইসলামিক বিধিবিধান। সম্পত্তিতে অধিকার থাকলেও সেগুলো আসলে ঘুরে ফিরে পুরুষরাই নিয়ন্ত্রণ করতো তা সে দূর সম্পর্কের পুরুষমানুষ হলেও, কারণ সম্পত্তি দেখেশুনে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান বুদ্ধি প্রাপ্তি থেকে নারীকে সবসময় দূর রাখা হতো। বিয়ে শাদীতে মত প্রকাশের কোনো অধিকার তাদের ছিলনা।
বেগম রোকেয়া কর্তৃক স্থাপিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে যে মেয়েরা পড়তো তারা পর্দা করেই স্কুলে আসতো, তাদের জন্য একটি চারিদিকে বন্ধ মোটর বাস ছিল সেটাতে তাদের যাতায়াত করানো হতো। এই বাসে মেয়েরা অসুস্থ হয়ে পড়তো এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে ছোট মেয়েরা ভয় পেতো। পরবর্তিতে মোটর বাসে দুইদিকে খড়খড়ি নামিয়ে কাপড়ের পর্দা দেয়া হয়েছিল। এই বিষয়ে স্কুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছিল যে দুই পাশের কাপড় বাতাসে উড়ে মেয়েরা বেপর্দা হচ্ছে, পরবর্তীতে গাড়ির এমন পর্দা পরিবর্তন করা নাহলে স্কুলের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে স্কুল বন্ধ করে দেয়া হবে, এমন হুমকিও পেয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। এই অবরোধবাসিনীদের হয়ে দুঃখভারাক্রান্ত মনে লিখেছিলেন-
“ক্যান আসিলাম হায়! এ পোড়া সংসারে, ক্যান জন্ম লভিলাম পর্দা-নশীন ঘরে”।
[রোকেয়া রচনাবলী ৪১৪ পৃষ্ঠা, বাংলা একাডেমী (অবরোধবাসিনী)]
বেগম রোকেয়া তাঁর মতিচূর গ্রন্থে ওই সময়ে নারীদের অবস্থানের সাথে দাসীদের তুলনা করেছেন। পৃথিবীতে দাস প্রথা বহু আগে উঠে গিয়েছিল কিন্তু নারীরা কেন দাস হয়ে রইল, এই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন তখনকার অবরোধবাসিনী নারীদের উদ্দেশ্যে। পুরুষ ও নারীর একই রকম মানব শরীর থাকবার পরও পুরুষরা উন্নতি করে উপরে উঠে গেল আর অপর অংশ অর্থাৎ নারীরা তাদের সঙ্গে একইভাবে উন্নতি করতে পারলো না বলে পুরুষের সহচরী বা সহধর্মিনী না হয়ে দাসী হয়ে রইলো (সহচরী বলতে এখানে পুরুষের মতো সমধিকারের মানুষ বুঝিয়েছেন)। এর মূল কারণ তিনি বলেছেন নারীদের উপযুক্ত সুযোগ না পাওয়া। এই কারণেও নারীরা নানা বিষয়ে অক্ষম হওয়া শুরু করলো ফলে পুরুষদের তাদের প্রতি সাহায্য সহানুভুতি বাড়তে থাকলো এবং নারীরা ক্রমশ অক্ষম ও অকর্মণ্য হতে লাগলো। উনি লিখেছিলেন- “এদেশের ভিক্ষুদের সহিত আমাদের বেশ তুলনা হইতে পারে। একদিকে ধনাঢ্য দানবীরগণ ধর্ম্মোদ্দেশ্যে যতই দান করিতেছেন, অন্যদিকে ততই ভিক্ষুসংখ্যা বাড়িতেছে! ক্রমে ভিক্ষাবৃত্তি অলসদের একটা উপজীবিকা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এখন আর তাহারা ভিক্ষা গ্রহণ করাটা লজ্জাজনক বোধ করেনা”। [রোকেয়া রচনাবলী, পৃষ্ঠা ১২ (মতিচূর-১ম খণ্ড)] নারীরাও পুরুষদের অনুগ্রহে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হতে মনও দাসে পরিণত হয় এবং এটা বহুযুগের ফলাফল। ফলে নারীরা আরো বেশি অবজ্ঞার শিকার হতে শুরু করলো, যেমন মেয়েরা বোধবুদ্ধিহীন, যুক্তিজ্ঞানহীন হিসেবে পরিচিত হতে থাকলো। শুধু তাই নয়, আবার “অতিরঞ্জন এবং মিথ্যাবচন এসব রমনীর জিহবার অলংকার” এই কথাগুলোও বেশ শোনা যেত। “আমাদের যখন স্বাধীনতা ও অধীনতাজ্ঞান বা উন্নতি ও অবনতি যে প্রভেদ তাহা বুঝিবার সামর্থ্যটুকু থাকিল না, তখন কাজেই তাঁহারা ভূস্বামী, গৃহস্বামী প্রভৃতি হইতে হইতে ক্রমে আমাদের “স্বামী” হইয়া উঠিলেন। আর আমরা ক্রমশঃ তাঁহাদের গৃহপালিত পশু পক্ষীর অন্তর্গত অথবা মূল্যবান সম্পত্তি বিশেষ হইয়া পড়িয়াছি”।[রোকেয়া রচনাবলী, পৃষ্ঠা ১২ (মতিচূর-১ম খণ্ড)]
বেগম রোকেয়া অলংকারকে দাসত্বের নিদর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বালা, চুড়ি, মল, নথ, গলার হার প্রায় সব অলংকারেরই নিজস্ব ব্যাখ্যা রয়েছে। গো-স্বামী আগে বলদের নাক ছিদ্র করে নাকদড়ি পরিয়ে আটকে রাখতো আর স্বামীরা নারীদের নোলক পরিয়েছেন। এখানে আর একটি অবাক করা বিষয় হলো যার শরীরে দাসত্বের চিহ্ন বেশি সেই সমাজে ততোধিক মান্যাগণ্যা। আবার দরিদ্র নারীরা কাঁচের চুড়ি পরে হলেও সেই দাসী জীবন সার্থক করত। বিধবারা আবার এসব অলংকারে সাজতে পারেন না, তাতে তারা দুঃখিত হন। কারণ তারা এই দাসত্বের চিহ্নে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন এবং এটা নেশার মতো তাদের দীর্ঘদিনের ভাবনাচিন্তায় আটকে গেছে। [সূত্র: রোকেয়া রচনাবলী, পৃষ্ঠা ১৪ (মতিচূর-১ম খণ্ড)]
আগে প্রায়ই পুরুষদের বলতে শোনা যেত যে এই কাজটি না পারলে আমি চুড়ি পরবো। আগে বীরদের উদ্দেশ্যে বলা হতো যে তোমরা নারীদের পোশাক পর না। মানে হেরে যাওয়া আর নারীদের পোশাক পরা সমান। সেটা পরাজয় এবং দাসত্বের নিদর্শন। শুধু তাই নয় তখনকার বেগম নারীদের এমন পোষাক এবং অলংকার পরে থাকাকে তিনি তাদের জড় পদার্থের সাথে তুলনা করেছেন। নারীদের এমন অবস্থা থেকে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন। নারীদের পুরুষের মতোই শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়াসহ স্বাবলম্বী হবার আহবান জানিয়েছিলেন রোকেয়া, কারণ নারীদের শিক্ষার কথা শুনলেই সেই সময়ে শিক্ষার কুফলের কথাই সবাই তুলে ধরতো। তখন অশিক্ষিত নারীদের কোনো দোষ যতটা না চোখে পড়তো তার চাইতে বেশি চোখে পড়তো শিক্ষিত নারীর দোষ, যা মূলত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তার শিক্ষার উপর গিয়ে ঠেকতো। সেই সময় যে ধর্ম বা বর্ণের লোকেরা বেশি শিক্ষিত ছিল বা শিক্ষাগ্রহণের পক্ষপাতি ছিল, শিক্ষাগ্রহণ করা মানেই তাদের অণুকরণ করা বোঝাতো। তাই বেগম রোকেয়া বলেছেন যে শিক্ষা মানে ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বুদ্ধি দিয়েছেন তার সঠিক অনুশীলন করা, কাউকে অনুকরণ করা নয়। সে সময় মেয়েদের জন্য শিক্ষাগ্রহণে সংযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক বাধা ছিল যার মূল ধর্মকেন্দ্রীক। কিন্তু তখন এতটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় ছিল যে প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান এবং স্ত্রী হয়েও বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে তিনি পুরোটা দাঁড়াতে পারেন নি। কিন্তু নানা গল্পের ছলে তুলে আনার চেষ্টা করেছিলেন সামাজিক প্রেক্ষিতগুলো এবং সেগুলো সকলকে জানাতে চেয়েছেন। যখনই পর্দা নিয়ে লিখেছেন তখন পুরুষদের রোষানলের পাশাপাশি মহিলাদের বিরোধিতার সম্মুখীনও হয়েছেন। তবে তিনি সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তিনি বলেছিলেন আমরা একই ঈশ্বরের বিভিন্ন প্রণালীতে উপাসনা করি আর ভারতবর্ষে এত ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর বাস, এত বৈচিত্রময় দেশ পৃথিবীর কোথাও আর নেই।
রোকেয়া বলেছেন, নারীদের নিজেদের উন্নয়ন কেবল তাদের জন্যই না, বরং সমাজের জন্যও নারীদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন ছিল। কারণ মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী যারা একইভাবে পুরুষের মতো কাজে অংশ নিতে পারছেন না। দৈব কোন ঘটনায় মেয়েদের পরিবর্তন ঘটবে না, যতদিন না সে নিজে উঠে দাঁড়াবে এবং এ ব্যাপারে পুরুষের উপর নির্ভরতা বাদ দিতে হবে। নিজের উন্নয়নের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। শিক্ষার প্রসঙ্গ আসায় সবাই বলতো নারীরা শিক্ষাগ্রহণ করে কী করবে কারণ তারা তো টাকা রোজগার করবে না। এটা একটা বড় কারণ ছিল, যেহেতু নারীরা বাইরে যেতে পারেন না তাই তারা কোনো কাজে যুক্ত হতে পারবেন না। এমন বিষয়ে রোকেয়া বলেছিলেন – ঘরের কাজ সঠিকভাবে করতে হলেও শিক্ষা প্রাপ্তি জরুরি। ছোটবেলা থেকে মেয়েদের ধর্ম শিক্ষা দেয়া হতো, সেই ধর্মগ্রন্থ তিনি বুঝে পড়তে বলেছিলেন, তোতাপাখির মতো মুখস্ত বলা নয়, তাহলে হয়তো ধর্মের নামের এসব বিধিনিষেধ এবং প্রবঞ্চনা বন্ধ হতো।
বেগম রোকেয়া সমাজ পরিবর্তনে কাজ করে গেছেন, যে সমাজ মূলত নারীদের পুরুষের নিচে অবস্থান তৈরি করেছিল। লিঙ্গবৈষম্যের সমাজে পর্দা নারীর উপরে পুরুষের চাপিয়ে দেয়া একটা পিতৃতান্ত্রিক নিয়ম যা কিনা আবার ধর্মবেষ্টিত আচার। পর্দা মেয়েদেরকে দুর্বল মন মানসিকতা সৃষ্টিতে সহায়তা করে, নারীদের অবাধ চলাফেরায় বাধা তৈরি করে। তিনি শুধু এসব বিষয় সনাক্তই করেনি এগুলো ভাঙ্গতেও চেয়েছিলেন। নারীদের শিক্ষা, সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা, কর্মসংস্থান ও আইনগত অধিকারের প্রতিও আলোকপাত করেছিলেন বেগম রোকেয়া। তাঁর সেই সময়ের নারীবাদী পদচারণা এখনকার সময়কেও অনেকাংশে প্রভাবিত করে।
প্রায় ১০০ বছর আগে বেগম রোকেয়া এমন একটা সমাজব্যবস্থার কথা বলেছিলেন যেখানে নারীরা পুরুষের মতো সমঅধিকার পাবে। সামাজিক বিধিনিষেধে আটকে তাদের মেধাকে যাচাই না করে কারো মুখাপেক্ষী বা দাস হয়ে বাঁচবে না। সুলতানার স্বপ্ন (Sultana’s Dream) নামক একটি রূপকধর্মী রচনায় তিনি সামাজিক বিধিনিষেধ, পর্দা ভুলে একটা কাল্পনিক স্বাধীন জীবনের কথা ভেবেছেন যেখানে মেয়েদের উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা অস্থায়ী নয় বরং জরুরি যেখানে তিনি বিজ্ঞান ভাবনাও যুক্ত করেছিলেন। শিক্ষাগ্রহণ করতে গিয়ে নিজের পরিবারে পিতার অনেক বাধার সম্মুখীন হলেও বেগম রোকেয়ার স্বামী ছিলেন বেশ উদার মনের মানুষ এবং তিনি রোকেয়াকে নানা সময়ে উৎসাহিত করেছেন। কেবল মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি, নারী উন্নয়নেও নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন রোকেয়া। ১৯১৭ সালে প্রায় ৫০ জন নারীর উপস্থিতিতে বার্ষিক সম্মেলন করে যুগান্তকারী উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন। নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনেরও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
১০০ বছর আগে এই ভারতবর্ষে নারীবাদী আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তিনি, নারীদের জন্য সোচ্চার হয়েছিলেন। ধর্মের নামে চলা নানা ভয়ংকর সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছিলেন। নারীদের জেগে উঠতে বলেছিলেন কারণ এটা তাদের সত্য জীবন না যা তারা ধর্ম ও সামাজিক ছায়ায় যাপন করে আসছেন। অন্ধ বিশ্বাস এবং ভাবনা থেকে বের হতে বলেছেন তিনি, সেটার জন্য জ্ঞানচর্চা করতে বলেছিলেন। আর অধিকার আদায়ের জন্য স্বনির্ভর হতে বলেছেন। আলোকবর্ত্তিকা তিনি জ্বালিয়েছিলেন নারীদের মাথা উঁচু করে সসম্মানে বাঁচার জন্য। ১৯৩২ সালের ডিসেম্বর মাসে মাত্র ৫২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই মহীয়সী নারী, বাংলা ভাষাভাষী নারীদের পথপ্রদর্শক বেগম রোকেয়া।