May 15, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ৩

সমকাম বিদ্বেষ: এক মানসিক ও সামাজিক ব্যাধি

ফাতেমা তুজ জোহরা ।। 

মানুষ এই মহাবিশ্বের একট অতি ক্ষুদ্রতম অংশ। ঠিক অন্যান্য প্রাণী যেমন প্রকৃতির অংশ, মানুষও তার বেশি কিছু নয়। প্রকৃতির সাথে মানুষের আন্তঃসম্পর্কই মানবপ্রজাতির বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। ধীরে ধীরে মানুষ উন্নত হয়েছে, জীবন যাপনে এসেছে পরিবর্তন, তৈরি হয়েছে সমাজ। সমাজ তৈরির মূল লক্ষ্য ছিলো একে অন্যের বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে হাতে হাত রেখে পথে এগিয়ে চলা।

মানুষ সমাজবদ্ধ হলো, নানা নিয়ম শৃঙ্খলায় নিজেদের বেঁধে ফেললো। ধীরে ধীরে সমাজে যুক্ত হলো দলাদলি, সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুর খেলা। হারিয়ে গেলো সহানুভুতি, যুক্ত হলো অধিকাংশের মতের অমিল হলেই বিচার ব্যবস্থা।

জাজমেন্টাল এই সামাজিক ব্যবস্থায় আজ কথা বলবো হোমোফোবিয়া নিয়ে। বিষয়টি সাধারণের জন্য কিছুটা জটিল তো বটেই, সেইসাথে আতঙ্কের, বিদ্বেষের এবং ঘৃণার। যে সমাজে ট্রান্সজেন্ডার সন্তানকেই ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়, সেখানে হোমোসেক্সুয়াল বিষয়টি অনেক বেশি অশ্রদ্ধা এবং ঘৃণার। সামাজিক এবং ধর্মীয় বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই হোমোসেক্সুয়ালদের প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষ কাজ করে। কিন্তু কেন এই বিদ্বেষ আর কেন মানুষ স্বাভাবিক একটি প্রবৃত্তিকে এতো অস্বাভাবিকভাবে দেখে, কীভাবে এর সমাধান হতে পারে, মানুষ আরেকটু সচেতন কি আদৌ হতে চায়, এ সব কিছু নিয়েই আজকের লেখা সাজানো হয়েছে।

হোমোফোবিয়া কী?

খুব সহজ ভাষায়, হোমোফোবিয়া হলো সমকামী মানুষদের প্রতি ভয়, আতঙ্ক, ঘৃণা বা বিদ্বেষ। অর্থাৎ, সমকামী মানুষদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবকেই হোমোফোবিয়া বলে। বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ, সামাজিক প্রভাব, শিক্ষার অভাব, সচেতনতার অভাব, সহানুভুতির অভাব, অন্যকে নিজের পাল্লায় মেপে চলার মন মানসিকতা ইত্যাদি থেকেই হোমোফোবিয়ার সৃষ্টি। সামাজিক বৈষম্যের কারণে সাধারণত এলজিবিটি (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার) সম্প্রদায় এ ধরণের আচরণের শিকার হন।

হোমোফোবিয়া শব্দের প্রথম ব্যবহার

হোমোফোবিয়া শব্দটি খুব অল্প দিন হলো প্রচলিত হয়েছে। প্রাচীন গ্রীক পন্ডিতেরা এ শব্দের ব্যবহার করলেও প্রচলিত অর্থে এই শব্দের প্রচলন শুরু হয় ১৯৬০ এর পরে। হোমোসেক্সুয়াল ও ফোবিয়া, এই দুই শব্দের একসাথে মিশ্রণ হিসেবে একে প্রথম সামনে নিয়ে আসেন সাইকোলজিস্ট জর্জ ওয়েনবার্গ। স্ক্রু নামক একট ম্যাগাজিনে ১৯৬৯ সালের ২৩ মে প্রথম এই শব্দটি ছাপা হয়। তবে বিভিন্ন ধর্মে সমকামীদের নিয়ে নেতিবাচক কথা ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে বলে এই শব্দটির ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে।

হোমোফোবিয়া কত ধরনের হতে পারে

ব্যক্তিগত, সামাজিক, ধর্মীয়, ইত্যাদি আঙ্গিকে দেখলে বেশ কয়েক ধরনের হোমোফোবিয়া বা সমকামভীতি রয়েছে।

ইন্টারনালাইজড হোমোফোবিয়া

এই ধরনের হোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি আসলে নিজের যৌন পরিচয় নিয়ে অস্বস্তিতে ভোগেন। পুরো পৃথিবী জুড়েই এলজিবিটিদের প্রতি যে অমানবিক ও অবিবেচক আচরণ করা হয়, তার প্রেক্ষিতেই সমলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট ব্যক্তি নিজের যৌন পরিচয় নিয়ে দারুণভাবে ইনফেরিয়রিটিতে ভোগেন। তার নিজের কাছেই নিজের যৌন পরিচয় ঘৃণা এবং আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সর্বোপরি নিজের যৌন পরিচয় নিজেই মেনে নিতে পারেন না। এই ধরনের হোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণ সমাজে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের প্রতি অসম আচরণ। এছাড়া সমলিঙ্গে আকৃষ্ট ব্যক্তির যৌনশিক্ষা ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশও তাকে ইন্টারনালাইজড  হোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত হতে অনেক সময় বাধ্য করে।

প্রাতিষ্ঠানিক ও ধর্মীয়ভিত্তিক হোমোফোবিয়া

এটা স্বীকার্য যে বেশিরভাগ ধর্মীয় শিক্ষাতেই সমকামের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়। সমকাম অপরাধ এবং পাপ; যে পাপের কোনো ক্ষমা নেই। এমন শিক্ষাই বেশিরভাগ ধর্মে দেয়া হয় বিধায় বিশ্বজুড়ে একটা বিশাল জনসংখ্যা ধর্মভিত্তিক হোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত। যেহেতু ধর্মে বলা হয়েছে সমকামিতা পাপ কাজেই সমকামী ব্যক্তির প্রতি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের প্রচন্ড বিদ্বেষ কাজ করে। এখানে উদাহরণ হিসেবে আফগানিস্তান দেশটির কথা উল্লেখ করা যায়। সেখানে তালিবানদের আইনে সমকামের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

সামাজিক হোমোফোবিয়া

একজন সমকামী মানুষ যখন বুঝতে পারেন যে তিনি সমকামী, তখন সামাজিকভাবে তার যৌন পরিচয় চিহ্নিত হবার ভয়কে সামাজিক হোমোফোবিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যারা সমাজে সমকাম বিদ্বেষ নিয়ে আলোচনা করেন তারা যে শুধুই বিদ্বেষ থেকেই তাদের মানসিক অবস্থান জানান দেন তা নয়, সমকামী ব্যক্তিদের সামাজিকভাবে হেয় করাও তাদের উদ্দেশ্য থাকে। বেশিরভাগ সমকাম বিদ্বেষী ব্যক্তি সমকামিদের বিরুদ্ধে তার মনোভাব ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে দারুণ রকম উগ্রপন্থা অবলম্বন করেন। তাদের ধারণা যৌন সম্পর্ক কেবলমাত্র বিপরীত লিঙ্গের সাথেই হবে, সমকাম এক ধরণের মানসিক ব্যাধি। কিন্তু আসলে, সমকাম কোনো মানসিক রোগ নয় বরং সমকামীদের প্রতি এই যে উগ্র বিদ্বেষ ও আতঙ্ক, এটিই এক ধরনের মানসিক রোগ।

এলজিবিটি সম্প্রদায়ের উপর হোমোফোবিয়ার প্রভাব

আমাদের সমাজে এখনো এলজিবিটি সম্প্রদায়কে স্বাভাবিক চোখে দেখা হয় না। কেউ যদি নিজেকে সমকামী হিসেবে পরিচয় দেয় তো দেখা যায় যে তার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় এমন কি পরিবারও তাকে ত্যাগ করে। শুধুমাত্র ত্যাগ করেই অনেকে ক্ষান্ত হন না। এলজিবিটি সম্প্রদায়ের অনেকেই শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন শুধুমাত্র সমাজে মানুষের মস্তিষ্কে হোমোফোবিয়া বাসের কারণে।

স্বঘোষিত সমকামী ব্যক্তির আর্থিক আয়ের উপর তার যৌন পরিচয়ের প্রভাব পড়ে। যেহেতু সমাজে বিভিন্ন দিক থেকে সে মানসিক আঘাত পেতেই থাকে, এ থেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে অনেকেই নিজেকে দায়ী করে আত্মহত্যার দিকেও ঝুঁকে পড়েন। আত্মহত্যা না করলেও বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারে ভুগতে থাকেন শুধুমাত্র সামাজিকভাবে স্বীকৃতি না পাওয়ার কারণে।

শারীরিক-মানসিক-আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত যে কোনো মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিঘ্নিত হবে এটাই সত্যি। এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানুষ সমাজের আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতোই, কিন্তু সামাজিক হোমোফোবিয়ার প্রভাব তাদের ব্যক্তিগত এবং যৌন সম্পর্কের উপরেও পড়ে। বিশেষত পুরুষদের উপরেই এই প্রভাব বেশি পড়ে। সমকামী পুরুষদের “পৌরুষত্বের” উপর আঘাত হানা হয়। “অদৃশ্য” পৌরুষত্বের উপর আঘাত সমকামী পুরুষদেরও মানসিকভাবে ভেঙে ফেলে। এছাড়া বিভিন্ন রকম সামাজিক বুলিয়িং এবং হ্যারাসমেন্টের শিকার তো প্রতিনিয়তই হতে হয়।

এলজিবিটি সম্প্রদায়ের জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি হল ঘরহারা হয়ে যাওয়া। যে কারণে ডিপ্রেশন এবং তা থেকে থেকে আত্মহত্যা প্রবণতা তাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।

হোমোফোবিয়ার নেতিবাচক প্রভাব থেকে এলজিবিটি সম্প্রদায় কীভাবে বাঁচতে পারে?

আমাদের সমাজে এলজিবিটি সম্প্রদায়কে মেনে নেয়ার প্রবণতা একেবারে নেই বলেই তাদের মানসিক ক্ষরণের মাত্রা বেশি। হোমোফোবিয়ার যে নেতিবাচক প্রভাব এলজিবিটি সম্প্রদায়ের উপর পড়ে, তা থেকে তাদের বাঁচাতে সবচেয়ে কার্যকর হলো তাদের বন্ধু ও পরিবারের সহায়তা। একজন সমকামী ব্যক্তির পরিবার যদি তাকে মানসিক সাপোর্ট দেয়, তার পাশে থাকে তাহলে হোমোফোবিয়ার প্রভাব অনেকটাই দূর হতে পারে।

এক্ষেত্রে সমকামী ব্যক্তির বাবা-মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। বাবা-মা একজন সন্তানের জীবনে প্রথম শিক্ষক। সন্তানের সাথে সমকাম বিষয়ে খোলাখুলি আলাপ এখন সময়ের দাবি। আপনি যদি জানেন আপনার সন্তান সমকামী তবে তাকে সেই মানসিক সাপোর্ট দেয়াটা আপনার দায়িত্ব। আপনার সন্তান কোনোভাবে বুলিয়িং-এর শিকার হচ্ছে কি না, কোনোরকম মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে কি না, তার কাউন্সেলিং প্রয়োজন কি না এসব বিষয়ই খেয়াল রাখতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে সমকামিতা প্রাণী চরিত্রের স্বাভাবিক একটি বৈশিষ্ট্য।

সেই সাথে প্রাতিষ্ঠানিক সচেতনতা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র টিনেজারদের জন্য নয়। বরং শিশুকাল থেকেই যৌন শিক্ষা, যৌন সচেতনতা এবং সহানুভুতিশীল ব্যবহারের শিক্ষা প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে থাকা প্রয়োজন।

সমকামী হোক, ট্রান্সজেন্ডার হোক, বাইসেক্সুয়াল হোক, প্রত্যেকেই মানুষ। মানুষ হিসেবে সামাজিক সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার অধিকার প্রতিটি মানুষের রয়েছে। হোমোফোবিয়া এক ধরনের সামাজিক ব্যধি। সংখ্যায় বেশি মানুষ সমকামী নয় বলেই সমকামিতা-বিদ্বেষ বা আতঙ্ক কাম্য নয়। হোমোফোবিয়াকে সমাজ থেকে নির্মূল করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে সামাজিক শিক্ষা ও সচেতনতা। আর সেই সাথে, মানুষ হিসেবে নিজেকে আরেকটু সহানুভুতিশীল করে তোলা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *