November 2, 2024
কলামফিচার ৩

জাতিসংঘের মানবাধিকারের ঘোষণা কি আসলেই সার্বজনীন?

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। ইংরেজিতে দলিলটার নাম ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অফ হিউম্যান রাইটস। বাংলায় সবখানে লেখে ‘সার্বজনীন’। জাতিসংঘের সার্বজনীন এই মানবাধিকারের ঘোষণা – এটা গৃহীত হয়েছিল ১৯৪৮ সনের ডিসেম্বরের দশ তারিখে। সেই হিসাবে এই ঘোষণাটার বয়স হয়ে গেল তিয়াত্তর বছর। তিয়াত্তর বছরের পুরনো এই দলিলটি কি আসলেই সকলের মানবাধিকারের ঘোষণার একটি দলিল? এই প্রশ্নটা বহু বছর ধরেই অনেকে করেছেন। বিশ্বের বহু দেশে যখন সমাজতন্ত্র কায়েম ছিল তখন প্রশ্ন তোলা হতো এই দলিলটির শ্রেণী চরিত্র নিয়ে। এখনো সেই প্রশ্ন একটি বৈধ প্রশ্ন রয়ে গেছে। এই দলিলটিকে তৃতীয় দুনিয়া বা অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর সাবেক উপনিবেশগুলির দৃষ্টি থেকেও প্রশ্ন করা হয়েছে। কিন্তু এইসব আলোচনা এখন অনেকটাই আড়ালে চলে গেছে, কেননা এখন মোটামুটি প্রায় সব দেশই বাজার অর্থনীতি গ্রহণ করেছে এবং সেই দৃষ্টিতে দেখলে মানবাধিকার বলতে যা বুঝায় এই ঘোষণা তো সেগুলিকেই তুলে ধরে আরকি। কিন্তু যে প্রশ্নটা আগেও আলোচনায় ছিল, এখন প্রতিদিন আরও প্রাসঙ্গিক হচ্ছে সেটা হচ্ছে যে, সত্তর বছরের এই বুড়ো দলিলটিতে কি নারীর অধিকার অন্তর্ভুক্ত আছে? এই লেখাটায় অধীনের সবিনয় নিবেদন হচ্ছে, মানবাধিকার বলতে কেবল পুরুষের অধিকার ধরে নিয়েই এই দলিলটি তৈরি করা হয়েছে এবং এখনো এই দলিলটি পুরুষের অধিকারের দলিল হিসাবেই বিদ্যমান আছে। নারীকে এই দলিলে পুরুষের অধীন, ঘর দেখাশুনা করার, সন্তান উৎপাদন ও প্রতিপালন করার একটি প্রাণী হিসাবেই দেখা হয়েছে। নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য থাকবে সেই নিয়মটাকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়ে এই দলিল রচনা করা হয়েছে।

কেন বলছি যে এই ঘোষণায় মানবাধিকার বলতে মূলত পুরুষের অধিকারকেই বুঝানো হয়েছে এটা কীভাবে বুঝবেন? ঘোষণাটির একদম প্রথম অনুচ্ছেদ বা আর্টিকেল যেটা, আর্টিকেল ১, সেটার শুরু হয়েছে যে মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নে সকল মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন ও সমান। এইটা তো ভাল কথা, সকল মানুষ বা সকল হিউম্যান বিইং স্বাধীন ও সমান, ভাল কথা। কিন্তু এই অনুচ্ছেদটি শেষ কয়েছে যে বাক্যটি দিয়ে সেখানে আবার বলা হচ্ছে যে সকল মানুষেরই রয়েছে পরস্পরের মধ্যে এটা স্পিরিট অফ ব্রাদারহুড-এর যুক্তি, বুদ্ধি ও চেতনা। ‘স্পিরিট অফ ব্রাদারহুড’ কেন? পুরো ঘোষণায় তিরিশটা অনুচ্ছেদ রয়েছে, পড়ে দেখলে দেখতে পাবেন হিউম্যান বিইং বা মানুষ কথাগুলির সর্বনাম হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে পুংলিঙ্গ ’ম্যান’। ম্যান কথাটার বাংলা করলে হয় পুরুষ এবং সেইটাই এর প্রকৃত অর্থ। তাইলে কি কেবল পুরুষই মানুষ, নারীরা পুর্নাঙ্গ মানুষ নয়? এর জবাবে অনেকেই বলেন যে না, ম্যান একটা জিনেরিক বা সামগ্রিক শব্দ হিসাবে সমগ্র মানবজাতির জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে, এই ম্যান মানে কেবল পুরুষ নয়, নারীও এর অন্তর্ভুক্ত ইত্যাদি। এই কথাটা ঠিক নয়। ঠিক নয় কেননা এই দলিলেই আবার অন্যান্য জায়গায় নারীরই জন্যে উওম্যান শব্দটি ব্যাবহার করা হয়েছে এবং বৈষম্য দূরীকরণের জায়গাটিতে লৈঙ্গিক বৈষম্যের কথাও বলা আছে। এর মানে জিনেরিক অর্থে ম্যান শব্দটি নারী ও পুরুষের জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে সেই কথাটা চট করে ঠিক বলে মেনে নেওয়া যায় না। বরং এই কথাটাই স্পষ্ট হয় যে মানবাধিকার প্রশ্নটা মূলত পুরুষের অধিকার এই ধারনাটাই এই ঘোষণার ভিত্তিমূল।

আর এই ঘোষণায় সমাজে নারীর অবস্থান কী হিসাবে দেখা হয়েছে? অনুচ্ছেদ নাম্বার পঁচিশে দেখবেন বিধবা ও শিশুদের জন্যে বিশেষ নিরাপত্তা ও সহায়তার কথা বলা হয়েছে। এর মানে কী? এর মানে হচ্ছে যে এই ঘোষণাটি প্রণয়নের সময় ধরেই নেওয়া হয়েছে যে নারী তার জীবনধারণের জন্যে তার স্বামীর উপরই নির্ভর করবে, একজন শিশুকে যেমন নির্ভর করতে হয় তার পিতা বা মাতার উপর। পঁচিশ নম্বর অনুচ্ছেদের প্রথম উপ-অনুচ্ছেদে নারীর বৈধব্যকে যুক্ত করা হয়েছে বেকারত্ব, অসুস্থতা, পঙ্গুত্ব, বার্ধক্য এবং অন্য প্রকার উপার্জনহীনতার সাথে। অর্থাৎ একজন নারী যদি বিধবা হন, সে বেকার, অসুস্থ, পঙ্গু এইরকম কাতারে সাহায্যের হকদার হবেন। এর সাথে আপনি অনুচ্ছেদ নাম্বার ষোল মিলিয়ে পড়েন। অনুচ্ছেদ ষোলতে তিনটা উপ অনুচ্ছেদ আছে যেগুলি পরিবার গঠন ও বিচ্ছেদ সম্পর্কিত। এখানে দেখবেন যে বিবাহ ও পরিবার অর্থ ধরেই নেওয়া হয়েছে নারী ও পুরুষের মধ্যে বিবাহ এবং নারী ও পুরুষ মিলিয়ে বিবাহ। বিবাহ যে সমলিঙ্গের মধ্যেও হতে পারে এই ধারনাটাই অনুপস্থিত। এর সাথে অনুচ্ছেদ নাম্বার পঁচিশ মিলিয়ে দেখলে কী অর্থ দাঁড়ায়? অর্থ দাঁড়ায় যে নারী পুরুষ বিবাহ করে পরিবার গঠন করবে (অনুচ্ছেদ ১৬) আর স্বামীটি যদি মরে যায় তাইলে বিধবা নারীটি হয়ে যায় অসহায়। অর্থাৎ, পরিবারের ভরণপোষণ- এটা হচ্ছে পুরুষের কাজ। তাইলে নারীর কাজ কী? বাচ্চা জন্ম দেওয়া ও পালন করা। নাকি?

না, বৈষম্য নিরোধের জন্যে দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে যেসব ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে সেখানে লৈঙ্গিক বৈষম্যের জন্যেও একটি শব্দ অন্তর্ভুক্ত আছে। কিন্তু ঐটুকুই। এর পরে আবার সপ্তম অনুচ্ছেদে, যেখানে আইনের চোখে সকলের সাম্যের কথা বলা হয়েছে, সেখানে কিন্তু নারী ও পুরুষের সাম্যের কথাটা স্পষ্ট করে বলা হয়নি।

এইগুলি তো হচ্ছে মুল দলিলটি থেকে উদাহরণ। আপনি যদি ঐতিহাসিক ও সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেন তাইলে এই ঘোষণাটির এইরকম পৌরুষ চারিত্র্য কী করে হয়েছে, কেন হয়েছে সেই ব্যাখ্যাটা পেয়ে যাবেন। এই ঘোষণাটা প্রণীত ও গৃহীত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই। সেই সময় পর্যন্ত নারীবাদের প্রথম তরঙ্গের প্রভাবই প্রবল ছিল। নারীবাদের প্রথম তরঙ্গ পর্যন্ত ধারনাটা ছিল যে নারীকে যদি রাজনীতিতে ও সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া হয় তাইলেই নারীর মুক্তি চলে আসবে। নারীবাদের প্রথম তরঙ্গের মুল দাবিটাই ছিল ভোটাধিকার আর সেই সাথে শিক্ষা ও আনুষঙ্গিক কিছু সুযোগের সাম্য। সেসময় কম্যুনিস্ট নারী নেত্রীরা, বিশেষ করে ক্লারা জেটকিন ভোটাধিকার আন্দোলনের সাথে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করতে অস্বীকার করেন। কেন? কারণ তাঁরা ঠিকই চিহ্নিত করেছিলেন যে নারীর প্রতি বৈষম্য এটা একটা সর্বব্যাপী প্রপঞ্চ এবং, সহজ করে বললে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া কেবল ভোটাধিকার দিয়ে নারীর মুক্তি হবে না। পরবর্তীতে ষাটের দশক থেকেই দ্বিতীয় তরঙ্গ যখন শুরু হয়ে তখন রেডিক্যাল নারীবাদীরা চিহ্নিত করলেন যে পেট্রিয়ার্কি বা পিতৃতন্ত্র না ভাঙলে নারীর মুক্তি ঘটবে না। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরাও অনেকটা কম্যুনিস্টদের কাছাকাছিই চিন্তা করছিলেন সেসময়। কিন্তু ততদিনে তো এই ঘোষণাটা গৃহীতই হয়ে গেছে আর সেখানে ঐ প্রথম তরঙ্গের ধারনাটাই খানিকটা প্রতিফলিত হয়েছে- বৈষম্যের মূল জায়গাটায় আর হাত দেওয়া হয়নি।

প্রথম তরঙ্গের চেতনাটা ধারণ করে এখনকার লিবারেল নারীবাদীরা। কারা এই লিবারেল নারীবাদী? ফেসবুকের সাবেক প্রধান নির্বাহী শেরিল স্যান্ডবার্গ ২০১৮ সনে একটা বই লিখেছেন, নাম ‘লিন ইন’। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে যে বড় বড় কোম্পানিগুলির বোর্ডে যদি নারীর সংখ্যা বাড়ে, বা সংসদে যদি আরও বেশি সংখ্যায় নারীকে নিয়ে আসা যায়, বা রাজনৈতিক ক্ষমতায় যদি আরও বেশি সংখ্যক নারী অধিষ্ঠিত হয়ে তাইলেই নারীর প্রতি বৈষম্য দূর হয়ে যাবে। এই ধারনাটা যারা পোষণ করে এরা হচ্ছে লিবারেল নারীবাদী। এরা পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে আঘাতের গুরুত্ব দেন না, শ্রমজীবী নারীরা যে শ্রম শোষণের শিকার হয় সেটাকে গুরুত্ব দেন না, বর্ণবাদের কারণে নারীরা যে আলাদাভাবে নির্যাতিত হয়, আদিবাসী নারীরা যে ভিন্ন মাত্রার বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয় সেগুলি আর লিবারেল নারীবাদীদের কাছে গুরুত্ব পায় না। আপনি যদি মিলিয়ে দেখেন, তাইলে দেখবেন যে নারী প্রসঙ্গে এই সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণায় যতটুকুই অধিকারের কথা বলা আছে সেইটুকু ঐ লিবারেল নারীবাদীদের লাইনেই- নারী প্রতি যে সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বৈষম্য বিদ্যমান আছে এবং যে কারণে এইসব বৈষম্য হয় সেইগুলি নিয়ে আর দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। এর একটা উদাহরণ হচ্ছে, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ধর্ম ও সাংস্কৃতিক আচরণের উছিলা দেখিয়ে নারীর প্রতি যেসব বৈষম্য হয় সেগুলি নিয়ে কিছুই সেখানে বলা হয়নি।

তবে কি মানবাধিকারের এই ঘোষণাটি একদম মূল্যহীন? বা এইটাকে কি একটা বড় অর্জন নয়? নিশ্চয়ই এই ঘোষণাটি মানুষের ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ – একটা বড় অর্জনও বটে। কিন্তু এইটাও আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে সময় অনেকখানি এগিয়ে গেছে। নারীর সংগ্রামের ফলে বিশ্বব্যাপী কিছু কিছু অর্জন হয়েছে। কিন্তু এই দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যদিয়ে আমরা যেটা জেনেছি যে নারীর অধিকারকে যদি মানবাধিকার হিসাবে বিবেচনা করা না হয় তাইলে সমাজে এই বৈষম্যটা কমবে না। বৈষম্যটা যেখানে হয় সেখানেই যদি বৈষম্যটা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা না হয়, আর সেই বৈষম্যের কারণগুলি যদি ঠিকমত চিহ্নিত করা না হয় তাইলে বৈষম্য দূর হবে না। আপনি যখন একটা সার্বজনীন বা বিশ্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা তৈরি করবেন, তখন তো বৈষম্যের ক্ষেত্রগুলি সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। এই যে দীর্ঘ সংগ্রাম থেকে আমাদের অভিজ্ঞতা সেটা তো আমাদের অধিকারের সংগ্রামে প্রতিফলিত হওয়া দরকার। নাকি?

তিয়াত্তর বছর আগে যে দলিলটাকে একটা যুগান্তকারী দলিল হিসাবে দেখা হতো, আজকেও সেটাকে আমরা একই নজরে দেখব? নাকি যেসব অসম্পূর্ণতা দেখতে পাচ্ছি, যেসব সীমাবদ্ধতা দেখতে পাচ্ছি সেগুলি চিহ্নিত করে এটাকে প্রাসঙ্গিক করার উদ্যোগ নেব? নারী অধিকারের আন্দোলন আজকে আমরা যেসব অধিকারকে সার্বজনীন বা বিশ্বজনীন হিসাবে চিহ্নিত করছি সেইগুলি যদি আমি এই দলিলে দেখতে না পাই তাইলেও কি সেটাকে সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা নামে চিহ্নিত করবো? না। নারীর দৃষ্টিতে এবং একজন নারী অধিকার কর্মীর দৃষ্টিতে বা একজন নারীবাদীর দৃষ্টিতে এই দলিল সার্বজনীন নয়। এইটাই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে অধীনের সবিনয় নিবেদন।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *