December 23, 2024
কলামফিচার ২

নারীমুক্তির জন্য আমাদের চাই একটি বিপ্লব

সুমাইয়া সেতু ।। সারা বিশ্বের কোথাও না কোথায় প্রতিদিন নারীরা লাঞ্ছনা, পরাধীনতা, শাসন-শোষণ এবং দরিদ্রতার শিকার হচ্ছে।  লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ও নানা মাত্রার সহিংসতার সম্মুখীন হচ্ছে তারা। আর নারীর এই পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ হলো পুঁজিবাদী আগ্রাসন। সারাবিশ্বে পুঁজিবাদ একটা বড় অংশে মিডিয়া ও নারীবাদীদেরকেও নিয়ন্ত্রন করে। যারা নারীর মুক্তির নামে বামপন্থী বা গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করে আস্থা অর্জন করে সাধারণ মানুষের। তারা পুঁজিবাদের সকল কর্মকাণ্ডের সমালোচনাও করে, কিছু সংকটের মোকাবেলাও করে কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে এই সংকটের কোন স্থায়ী সমাধানের কথা তারা বলে না। এমন অনেক নারীবাদী সংগঠক রয়েছে যারা মুখে নারীদের শিক্ষার কথা বলে, অধিকারের কথা বলে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে দাসত্ব করে পুঁজিবাদের। যেমন সাম্রাজ্যবাদীর মোড়কে নারীবাদীর মুখোশ পরে থাকা হিলারি ক্লিনটন এর মতো নারীরা নিজ দেশে অধিকারের জন্যে রাজপথে হাটলেও সারা বিশ্বের নারীদের প্রতি চালায় পুঁজিবাদী আগ্রাসন। নারীদের এই নানামাত্রিক সংকট সমাধানের জন্যে সকলেই একটা বিষয়ের দিকে আলোকপাত করেছে। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি যে পুঁজিবাদের কারণে এতো সংকট সেই পুঁজিবাদ ও নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলে। কিন্তু সেটি তারা বলে তাদের নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবেই। সারা বিশ্বের শ্রম বাজারের দিকে যদি আমরা তাকাই দেখবো, কম বেতনের জন্য নারীদেরকেই সবচেয়ে বেশি কাজ করতে হচ্ছে দেশে দেশে।

পুঁজিবাদের অধীনে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম উপায় হিসেবে দেখানো হয় শ্রম বাজারে নারীদের প্রবেশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে, বর্তমানে মাত্র ৫০ শতাংশ নারী বৈশ্বিক কর্মশক্তিতে অংশগ্রহণ করে ৮০ শতাংশ পুরুষের সাথে। পুঁজিবাদীদের কাছে, এই বেকার নারীদের একটি বড় অংশ “অব্যবহৃত সম্পদের” প্রতিনিধিত্ব করে। যদি শ্রমবাজারে পুরুষ এবং নারী অভিন্ন ভূমিকা পালন করতো, তবে দেশজ উৎপাদনের পরিমান অনেক বৃদ্ধি পেত। কিন্তু এই বাস্তবতার পাশাপাশি পুঁজিবাদ যেটা স্বীকার করে না সেটা হলো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সকল মানুষের জন্যে কাজের সুযোগ এখনো করা যায় নি। বিশেষ করে নারীদের পর্যাপ্ত কর্মক্ষেত্র নেই কোনো রাষ্ট্রে। আবার যেসব চাকরি পাওয়া যাচ্ছে সেসব চাকরিতে ক্রমবর্ধমানভাবে কম মজুরি দেয়া হচ্ছে নারীদের। নারীরা ঐতিহাসিকভাবে সর্বনিম্ন বেতনের পদে নিযুক্ত হয়। গৃহস্থলী বা সেবামূলক পেশায় নেই নারীদের মজুরী প্রথা। অথচ এই কাজেই সবচেয়ে বেশি সময় এবং পরিশ্রম করছে নারীরা। সারা বিশ্বেই এই ভয়াবহ সংকট বিরাজ করছে। অনেক দেশে নারীদের যোগ্যতা অনুযায়ী সমান বেতন দেওয়ার  আইনত বিধান থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। নারীরা বাধ্য হয়ে বেশি কাজ করে এবং কম মজুরি নিতে হয় তাদের সামাজিক বাস্তবতার কারণে। আবার সারা দিন বাইরের কাজ করার পরেও তাদের করতে হয় দ্বিতীয় শিফটে ঘরের কাজ। তাদেরকেই সামলাতে হয় পরিবার, সন্তান এবং অন্যান্য বিষয়, যেটা তাদের শরীরের জন্যে একটা অতিরিক্ত চাপের হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু পুঁজিবাদ এই অতিরিক্ত শ্রমের কোনো মূল্য দিতে নারাজ। আজকাল নারী আন্দোলনের ফলে কিছু পুরুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে গৃহস্থলীর কাজে। তবে সেই সংখ্যা মোটেও অনেক নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘরের কাজ সামলাতে হয় নারীকে।

যেখানে সমাজতান্ত্রিক মতবাদ বারবার বলে আসছে নারীকে অগ্রসর করতে হলে স্ব-বৈতনিক মাতৃত্বকালীন ছুটি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পূর্ণ প্রজনন অধিকার নিশ্চিত করতে হবে সেখানে পুঁজিবাদী শাসক শ্রেণি এইসব বিষয় নিশ্চিত করতে চায় না। তারা নারীকে দিয়ে গৃহস্থালীর কাজ করাতে চায় এবং তাদের চাহিদা পূরণের হাতিয়ারে পরিণত করতে চায়। আর এই অধিকার নিশ্চিত করতে হলে গোটা সমাজের কাঠামো পরিবর্তন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এইসব আলোচনা তুললেই পুঁজিবাদীরা কিছু সফল নারীকে তাদের ব্যান্ড অ্যাম্বাসেডর বানিয়ে প্রমাণ করতে চায় এই উপর মহলের পদে থাকা নারীরাই সারা বিশ্বের নারীমুক্তির প্রতীক। অথচ বড় বড় প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে থাকা এই নারীরাও পুঁজিবাদীদেরই হাতের পুতুল। তারা লিঙ্গ বিবেচনায় নারী হলেও প্রতিনিধিত্ব করে পুরুষতন্ত্রের। তাই এই অপপ্রচার করে আসলে প্রকৃত অর্থে নারীমুক্তির পথ দেখানো সম্ভব নয়।

আমরা দেখতে পাই সমাজে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির অন্যতম উপায় হিসেবে তাদেরকে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে, এই বিষয়ে পুঁজিবাদের ব্যাপক উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়। এর পেছনের কারণ যদি আমরা লক্ষ্য করি, দেখতে পাবো, উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার জন্যে নারীর প্রয়োজন হয় অর্থের আর পুঁজিবাদ তখন হাজির হয় সহজ শর্তের নামে ঋণ নিয়ে। এই ঋণের বোঝা  টানতে গিয়ে  নারী সর্বস্ব হারায় দিনশেষে। মূলত নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির নামে পুঁজিবাদীরা করে ঋণ ব্যবসা, উচ্চ সুদে তারা এই টাকা দেয় যা পরিশোধ করার সামর্থ্য থাকে না সকলের। গরীব মানুষ আরো গরীব হতে শুরু করে। এই ক্ষুদ্রঋণের সুযোগে ধনী দেশগুলো গরীব দেশের উপরে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ পায়। আমরা যদি ভেবে দেখি দরিদ্র নারীরা কেন তাদের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে না? উত্তর আসবে যে নারীরা কাজ করে না, বা তাদের অংশগ্রহণ নেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। প্রকৃত অর্থে বিষয়টা এমন নয়, বরং ধনী দেশগুলোর আগ্রাসনের কারণেই দরিদ্র‍্যতার গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছে নারীরা। সারাবিশ্বের অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করে নারীর অগ্রযাত্রা, তাই প্রকৃত মুক্তির জন্যে এই বিষয়গুলো অতীব জরুরি ভুমিকা পালন করে। কখনো কখনো আমরা দেখতে পাই শ্রমিক শ্রেণি এইসব অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। আবার তাদের মধ্য থেকেই একটা শ্রেণি মনে করে দিনশেষে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই সমাধান নিহিত রয়েছে, তারা পুঁজিবাদীদের প্রপাগান্ডার কাছে মাথা নত করে বিপ্লবী ধারা বাদ দিয়ে সংস্কারের পথে হাঁটতে চায় এবং নব্য উদারবাদী নীতির প্রতি ঝুঁকে পড়ে। শুধুমাত্র চলাফেরার বা ছোট ছোট স্বাধীনতা অর্জনই নয় এই সংকটের শেষ সমাধান নিহিত রয়েছে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাছে, পুঁজিবাদ কখনোই শ্রমিক শ্রেণির চূড়ান্ত মুক্তি অর্জন করতে সাহায্য করবে না।

নারীর শ্রমকে শোষণ করে পুঁজিবাদ, যা কিনা নারী নিপীড়নের একটি চূড়ান্ত ধাপ। পুঁজিবাদী বাজার সম্প্রসারণ নীতি এবং অতিমুনাফাখোরি ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের দিকে ধাবিত হয়। এইসব বিশ্লেষণ করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা যা মানুষের প্রয়োজনের ভিত্তিতে  নতুন সমাজের কথা বলে। সংকটের মূলকে চিহ্নিত করে এবং শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির কথা বলে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য শোষণ ও নিপীড়নের উপর নির্ভর করে। সব মানুষকে সমতা দেওয়ার  কথা বললেও সত্যিকার অর্থে নারীর অসম অবস্থানের প্রধান কারণ এই ব্যবস্থা। এই সংকট সমাধান করতে হলে আমাদের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে বিকল্প ভাবতে হবে। পুঁজিবাদের অধীনে ভুক্তভোগী সকল শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের একটি গণআন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে আমাদের শাসক শোষকদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে হবে এবং এমন একটি সমাজ নির্মান করতে হবে যে সমাজ সব মানুষের প্রয়োজন মেটাতে পারে।

আমাদের দরকার একটি বিপ্লব। এমন সমাজ গঠন করা দরকার যেই সমাজটি সামগ্রিকভাবে শ্রমিক শ্রেণি দ্বারা পরিচালিত হবে, নারীরা সমান অংশীদার হিসেবে অংশগ্রহণ করবে সর্বক্ষেত্রে। এই ব্যবস্থার অধীনে শিশুর সেবা, স্বাস্থ্যসেবা, বাসস্থান, শিক্ষা এবং মাতৃত্বকালীন ছুটি সকল মানুষের অপরিহার্য অধিকার হিসাবে বিবেচিত হবে। এই আন্দোলন গড়ে তোলার অংশ হল শাসক শ্রেণির দ্বারা উত্থাপিত ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে লড়াই করা, যাতে সমাজে আমাদের অবস্থান বুঝতে পারা যায় এবং সংগ্রাম গড়ে তোলা যায়। পুঁজিবাদীরা চায় আমরা যাতে বিপ্লবকে আমাদের মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখি, বিশ্বাস করি যে শ্রেণি সংগ্রামের প্রয়োজন নেই। সমস্ত মানুষকে অবশ্যই এই ভ্রম ঝেড়ে ফেলতে হবে এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। তবেই আসবে নারীর প্রকৃত মুক্তি।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *