নারীর বেশি বয়সে বিয়ে নিয়ে সমাজের এত আপত্তি কেন?
নাবিলা ওরিয়ানা ।। ২০১৯ সালে গুলতেকিন খানের আফতাব খানের সাথে বিয়ের পর অনলাইনে একটি ওয়াজের ভিডিও চোখে পড়ে আমার। সেখানে একজন শায়েখ জুম্মার খুৎবায় মুসল্লিদের জিজ্ঞেস করছেন, “গুলতেকিন খান একজন মাঝবয়সী নারী। কিছুদিন আগে তিনি বিয়ে করেছেন। এটা কি ভালো, নাকি খারাপ?” উত্তরে মুসল্লিদের সবাই একসাথে চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “খারাপ!”। সবার এ উত্তর শুনে সেই শায়েখ বললেন, “অবশ্যই এটা ভালো! বয়স্ক কোনো নারী বা পুরুষ যদি বৈধভাবে বিয়ে করে তার স্বামী বা স্ত্রীর সাথে থাকে, তাহলে সেটা কীভাবে খারাপ হলো? ইসলাম বরং এটাকে উৎসাহিত করে।”
অর্থাৎ এ থেকে স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে ধর্ম বয়স্ক নারীদের বিয়ের ব্যাপারে সমর্থন দিলেও আমাদের কালচার এ ব্যাপারে ছাড় দেয়নি। বয়স্ক পুরুষদের বিয়ে করা নিয়ে আমাদের সমাজে কারো মাঝে তেমন একটা আপত্তি দেখা যায় না। বেশি বয়সে বিয়ে করলে অথবা স্ত্রী মারা যাবার পর দ্বিতীয় বিয়ে করলে যে পুরুষেরা একেবারেই ঠাট্টা-বিদ্রুপের শিকার হন না, তা নয়। তবে পুরুষদের বেলায় মানুষ যেভাবে সেটাকে মেনে নেন, নারীদের ক্ষেত্রে ঠিক সেটা ঘটতে দেখা যায় না।
গুলতেকিন খান বিয়ে করার পর ফেসবুকেও তাকে নিয়ে নানা নেতিবাচক মন্তব্য করতে ছাড়ে নি মানুষ। “লজ্জাশরম নেই এদের? আগে হলে মানা যেতো, এখন এই বয়সে কেন?”, “এরাই এরকম হলে এদের ছেলেমেয়েরা কী শিখবে?” “দু-তিনটা বাচ্চা থাকা সত্ত্বেও কেন আবার বিয়ে করতে হলো? খুব কি দরকার ছিল?”, “উনাকে শ্রদ্ধা করতাম, এই খবর শুনে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে” – এরকম নানান কমেন্ট দিয়ে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল তার বিয়ে নিয়ে খবরের মন্তব্য বিভাগ।
হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় বিয়ে হয় ৫৬ বছর বয়সে, গুলতেকিন খানের উনষাটে। তফাৎ তেমন বেশি না। তবু গুলতেকিন খানকে যেরকম নানা কথা শুনতে হয়েছে এ বয়সে দ্বিতীয় বিয়ে করা নিয়ে, হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে কিন্তু তেমনটি ঘটে নি।
বেশি বয়সে কোনো ডিভোর্সি, বিধবা কিংবা অবিবাহিত নারী যদি বিয়ে করেন, তবে তা নিয়ে কেন আমাদের এতো মাথাব্যাথা? অনেকেই ধর্মের দোহাই দিয়ে থাকেন, যদিও সেটা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। নবী মুহাম্মদ (স.) এর প্রথম স্ত্রী খাদিজা (রা.) এর বয়স ছিলো চল্লিশ বছর যখন তিনি পঁচিশ বছর বয়সী মুহাম্মদ (স.)-কে বিয়ে করেন। এবং এর আগেও তিনি দু’বার বিয়ে করেছিলেন। একথা এদেশের সব মুসলিমেরই জানা আছে। সুতরাং ইসলামের দোহাই দিয়ে এসব যুক্তিকে দাঁড় করানো হাস্যকর। তাহলে এরপরও কেন আমরা একটু বেশি বয়সী নারীদের বিয়ে নিয়ে আপত্তি করি?
শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের উদ্দেশ্য বাদে যেকোনো ধরণের যৌনসম্পর্ক বা পাবলিক ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশনকে খারাপ চোখে দেখা হয় এই উপমহাদেশে। যারা তরুণ, তাদের ক্ষেত্রে আমরা তা মেনে নেই শুধুমাত্র সন্তান জন্মদানের খাতিরে। তবে যখন সন্তান উৎপাদনের দরকার বা সময় শেষ হয়ে আসে, তখন বিয়ে করার মানে শুধু শারীরিক বা মানসিক চাহিদা মেটানো। তাই যেহেতু আমাদের সমাজে “নারীদের কাজই সন্তান উৎপাদন করা” – এরকম ভাবা হয়ে থাকে যে সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা তাদের শুধুমাত্র তরুণ বয়সে থাকে, সে কারণে আমরা ধরেই নেই যে নারীদের বিয়ে করার সময় একটি নির্দিষ্ট বয়সের পরিসীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ। পুরুষদের ক্ষেত্রে সেরকমটা না হওয়ার কারণে তারা বেশি বয়সে বিয়ে করলেও মানুষ সেটা নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামায় না। “দুই-তিনটা সন্তান থাকার পরেও কেন উনি বিয়ে করলেন” – মন্তব্যটি থেকে মানুষের এই মানসিকতাই প্রকাশ পায়।
আমাদের এ উপমহাদেশের সমাজে বয়স্ক নারীদের ক্ষেত্রে এক ধরণের মাতৃস্থানীয় ইমেজ আরোপ করা হয়ে থাকে। যেসব নারীরা আমাদের কাছে মায়ের বয়সী, তারা কোনোভাবে সেক্সুয়ালি অ্যাকটিভ থাকবে – এটা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। সে কারণে আমরা আর তাদের বিয়ে করাও মেনে নিতে পারি না। সে কারণে খাদিজা (রা.)-এর বয়সের কথা আমাদের মুখস্ত থাকলেও রিয়েল লাইফে তার মতো বয়সের নারীদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখলে আমরা সেটাকে মেনে নিতে পারি না।
এখনকার সময়ে মেয়েরা তাদের মানসিক বা শারীরিক চাহিদা প্রকাশ করছে ও তা পূরণ করতে এগিয়ে আসছে – এটি হজম করা আমাদের দেশের মানুষের জন্যে এখনও কষ্টকর। তার কারণ আমরা আমাদের কালচার দ্বারা ব্রেইনওয়াশড। কোনো নারী যখনই স্বাধীনভাবে চলতে চাইবে অথবা নিজের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো নিজে নিতে চাইবে, তখনই তাকে তার জন্যে লজ্জা দেয়া হবে – এমনটা আমরা সবসময় দেখে বড় হয়েছে। আমাদের আগের প্রজন্মের মানুষেরা হয়তো বা নানান কিছু নিয়ে এরকম বিরূপ ধারণা পোষণ করতেন। তবে আমাদের দায়িত্ব আগের প্রজন্মের ভুলগুলি বুঝে নিজেদের এরকম নেগেটিভ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]