November 21, 2024
অনুবাদসাহিত্যফিচার ৩

গহনা ও নারীবাদ

গহনা ও নারীবাদ বেশ পুরোনো আলাপ। গহনার সাথে সম্পর্ক রয়েছে নারীর, সেই সাথে নারীবাদেরও। “বেয়ন্ড দ্য বাউন্ডারিজ” ম্যাগাজিনে শিখা এস লাম্বা-এর গহনা ও নারীবাদ সম্পর্কিত আর্টিকেলটি ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন ফাতেমা তুজ জোহরা ।। 

ফ্যাশন এবং নারীবাদ – দুটোই একে অন্যের সাথে সম্পর্কিত, এবং দুটো জিনিসেরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক অর্থ সমাজে প্রচলিত রয়েছে। আবার এই উভয়েই একে অন্যকে বেশ প্রভাবিত করে। যুগের সাথে সাথে ফ্যাশন এবং নারীবাদ, উভয়েই ক্রমাগত নানারকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।

গহনা শিল্প ফ্যাশন জগতের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। গহনা শিল্পের রয়েছে বহু পুরোনো ইতিহাস, পাশাপাশি নারী ও নারীবাদের সাথেও গহনার রয়েছে এক অন্যরকম সম্পর্ক।

যুগে যুগে ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে গহনা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রোমান, মিশরীয় বা ভারতের রাজা-রানী, ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট ধরনের গহনা পরতেন। গহনা ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব করতো সে সময়। সমাজে ক্ষমতাধরের অবস্থান এবং পুরুষত্ব জাহির করার মাধ্যমও ছিল এই গহনা। আর যেহেতু সে সময় বহু নারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতেন, তাই গহনার সাথে নারীকে মেলাবার চেষ্টা না করাই উচিত।

প্রাচীন যুগে গহনা এবং রত্ন খুঁজতে যুদ্ধও হতো। আর তাই এইসব দামি গহনা একসময় প্রজন্মের পর প্রজন্মে হস্তান্তর হতে হতে সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গিয়েছিল। সে সময়ের বিখ্যাত দুই ক্ষমতাধর নারী – ক্লিওপেট্রা ও রানী এলিজাবেথ ছাড়া পৃথিবীর বেশিরভাগ ক্ষমতাধর অবস্থানে ছিল পুরুষেরা; সেইসব পুরুষেরা গহনা পরতেন।

নারীবাদের প্রেক্ষিতে সবচেয়ে বিতর্কিত গহনাগুলির মধ্যে একটি ছিলো “এনগেজমেন্ট রিং” বা বাগদানের আংটি। প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসে আঙুলে আংটি পরা নিয়ে বেশ জনপ্রিয় রোমান্টিক গল্প প্রচলিত ছিল। গল্পটি হলো সে সময় মিশরে বিশ্বাস করা হতো বাম হাতের আঙুলের শিরা সরাসরি হৃৎপিন্ডের সাথে যুক্ত। এ গল্পটি আজও ভীষণ জনপ্রিয়।

গল্পের চিন্তাটি যতোই রোমান্টিক হোক, আসলে বাগদানের আংটি নারীরাই পরতেন বেশি। অর্থাৎ পুরুষেরা তাদের পছন্দের নারীর আঙুলে আংটি পরিয়ে দেয়ার মানে দাঁড়ায় এই নারীকে সেই পুরুষ বেছে নিয়েছেন এবং এই নারীর বিয়ের বাজারে আর কোনো কাজ নেই।

সত্যি বলতে ২০ শতকের দিকেই পুরুষেরা বিয়ের চিহ্ন হিসেবে হাতে ব্যান্ড পরতে শুরু করেছিল। এমনকি এখনো নারীর তুলনায় পুরুষদের মধ্যে বিয়ের প্রতীক হিসেবে কোনো গহনা পরার খুব বেশি প্রচলন নেই। অনেক নারীই এখন জোর দিচ্ছেন হয় বাগদান বা বিয়ের কোনো চিহ্ন বহন করবেন না, নয়তো নারী যদি কোনো চিহ্ন বহন করেন তাহলে পুরুষটিকেও সেই চিহ্ন বহন করতে হবে। নারীরা যখন প্রচলিত এই বাগদানের দামি হীরার আংটি পরার বিরোধিতা করেন, তখন সেটিকে নারীবাদ আন্দোলনের একটি চিহ্ন হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে।

“ঐতিহ্যবাহী গহনা” শব্দটির মূলেও রয়েছে বিতর্ক এবং নারীবাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। নারীরাই এখন তাদের বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন। এখনো অনেক সমাজেই নারীকে বিয়ের চিহ্ন হিসেবে গহনা পরতে হয়। হিন্দু ধর্মে নারীদের বিয়ের পর মঙ্গলসূত্র এবং শাখা ব্যবহার করতে হয় বৈবাহিক অবস্থা বোঝাতে। এখনকার সময়ে নারীবাদীরা এ ধরনের গহনাকে দাসত্বের চিহ্ন হিসেবে চিহ্নিত করছেন। বৈবাহিক অবস্থা বোঝাতে যে গহনা নারীকে ব্যবহার করতে হয় তা মোটেই নারীর জন্য স্বাধীনতা বয়ে আনে না। যেহেতু পুরুষকে নিজের বৈবাহিক অবস্থার প্রতীক হিসেবে কোনো আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র ব্যবহার করতে হয় না, কাজেই নারীরাও এখন নারীবাদ আন্দোলনের অংশ হিসেবে সেই পথই বেছে নিচ্ছেন।

তবে গহনা কিন্তু নারীবাদের কথা প্রকাশের একটি মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে। আক্ষরিক অর্থে আপনি যা বোঝাতে চাইছেন, গহনার মাধ্যমে তা সহজেই বলে দেয়া যায়। অনেক ব্র্যান্ড আছে যারা গহনাতে নানারকম বার্তা ডিজাইন করেন নারীর ক্ষমতায়নকে প্রকাশ করতে। এই গহনাগুলোকে অনেকে নারীবাদী গহনাও বলেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো, গত মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরে “দুষ্টু নারী” লেখা গহনা প্রচুর বিক্রি হয়েছে। এই ধরনের ব্র্যান্ডগুলো তাদের বিক্রিত গহনা থেকে লাভের কিছু অংশ বিভিন্ন ধরনের সংস্থা যেমন “প্ল্যান্ড প্যারেন্টহুড”-এ দান করে।

আসলে সত্যিকার অর্থে নিজেকে প্রকাশ করার স্বাধীনতা ও অধিকার না থাকলে আর কিসের নারীবাদ, তাই না?

নারীকে তার প্রতিটি পছন্দ-অপছন্দ দিয়ে সে নারীবাদী কি না তা বিচার করা যায় না বা উচিতও না। ফ্যাশন শিল্পের অন্য সমস্ত ক্ষেত্রের মতো গহনা শিল্পেও নারীবাদের ছোঁয়া এবং অস্তিত্ব রয়েছে। নারীর তার ব্যক্তিত্ব ও রুচি প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। বডি পিয়ার্সিং থেকে শুরু করে বাগদান বা বিয়ের চিহ্ন, যে কোনো ব্যাপারেই আসলে নারীর পছন্দই প্রধান।

অনেক নারীই আছেন যারা গহনা পরেন পছন্দ করে; এ কারণে নয় যে গহনা ঐতিহ্যের ধারক বা সমাজ তার কাছ থেকে প্রত্যাশা করছে বা দাবি করছে। আমাদের একজন ক্লায়েন্ট সেদিন বলছিলেন যে গহনা আসলে বৈষম্যের জিনিস নয় কারণ এটা দিয়ে আপনি শরীরের আকার লুকাতে পারবেন না আবার কিছু ঢাকতেও পারবেন না, গহনা কেবল আপনার ব্যক্তিত্বকে আরেকটু প্রখর করে তোলে।

গহনার একটি আলাদা দ্যুতি রয়েছে। এট আপনার ব্যক্তিত্বে আত্মবিশ্বাস যোগ করতে পারে, গ্ল্যামার বাড়াতে পারে, আবেগ প্রকাশে সাহায্য করতে পারে আবার আপনার নিজেকে প্রকাশ করতেও সাহায্য করতে পারে। আপনি ঐতিহ্য রক্ষা করতে গহনা পরছেন নাকি নিজের ইচ্ছার জন্য গহনা পরছেন এটা সত্যিকার অর্থে কোনো ব্যাপার নয়। আপনার পছন্দ এবং ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করা আপনার অধিকার। আপনি ঝাড়বাতিমার্কা কানের দুল পরেন বা অনেক বড় নেকলেস পরেন, গহনা পরা বা না পরা আপনার স্বাধীনতা এবং এটি প্রকাশ করার অধিকার আপনার রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *