May 15, 2024
জীবনের গল্পফিচার ৩

আফ্রিকার সেক্সিস্ট আইনের বিরুদ্ধে অ্যাগনেস সিথোলের লড়াই

দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাগনেস সিথোলে, হয়ে উঠেছিলেন হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ নারীর জন্য একটি দৃষ্টান্ত, একজন হিরো। ৭২ বছর বয়সে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাড়ি বিক্রি বন্ধ করার জন্য তিনি তার স্বামীকে আদালতে নিয়ে যান এবং তারই ফলাফল হিসেবে শতবছরের পুরোনো বর্ণবাদ যুগের বৈষম্যমূলক আইন সংশোধন করা হয়। অ্যাগনেস সিথোলে’কে নিয়ে সম্প্রতি বিবিসি’তে প্রকাশিত ফিচারটি ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য ভাবানুবাদ করেছেন পূরবী চৌধুরী।।

অ্যাগনেস আগেই বুঝতে পেরেছিল যে তার বিয়েটা বেশ কঠিন হবে। ১৯৭২ সালে তিনি তার হাইস্কুলের প্রিয় বন্ধু গিডিওনকে বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু অন্ধ বিশ্বাস থেকে বের হতেই তিনি খুব দ্রুতই নিজেকে খুঁজে পেলেন চরম বিশ্বাসঘাতকতার ভেতরে।

অ্যাগনেস বলেন, “গিডিওন সবসময় গোপনে বিভিন্ন ধরণের সম্পর্কে থাকত, যা আমার উপর তেমন প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু একসময় সে আমাদের সব সম্পত্তি বিক্রি করা শুরু করলো, সময়টা ছিল ২০১৬ থেকে ২০১৭ সাল এর মধ্যে। এ বিষয়ে তার একটাই উত্তর ছিল, তা হলো, সবকিছু তার, বাড়ি-সম্পত্তি, সেখানে আমার কিছু নেই”। অ্যাগনেস যখন দেখলেন তার বসবাসের অবলম্বনটি হারাতে যাচ্ছে তখন তিনি তার স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। সময়টা ছিল ২০১৯, অ্যাগনেস তার প্রজন্মের একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ নারী, যিনি একেবারেই অভূতপূর্ব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

‘‘এই সময়ে আমার বয়স ৭২- আমি কোথায় যেতে চাচ্ছিলাম এবং কোথা থেকে শুরু করবো, এই প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল। সুতরাং আমার একটাই পথ ছিল, তা হলো যুদ্ধ করা অথবা নিজেকে এই বয়সে রাস্তায় দাঁড়ানো অবস্থায় পাওয়া’’। তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করি প্রয়োজন আমাকে সাহসী করে তুলেছিল, হয়তো প্রয়োজন না থাকলে আমিও কাজটা করতাম না”।

অ্যাগনেসের এমন সময়ে বিয়ে হয়েছিল যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুদের শাসন চলছিল এবং কৃষ্ণাঙ্গদের “আউট অফ কমিউনিটি অফ প্রপার্টি” এর নিয়ম অনুযায়ী বিয়ে হত যেখানে পুরুষদের সব সম্পত্তির অধিকার থাকবে এমন আইন ছিল।

“আগেও নারীদের কোনো বিকল্প পন্থাই দেয়া হয়নি সেটা আইন অনুযায়ী অর্থাৎ (আউট অফ কমিউনিটি অফ প্রপার্টি) বিয়ে করলেও বা বিয়ে না করলেও” অ্যাগনেস ব্যাখ্যা করে।

বৈবাহিক সম্পত্তি আইন ১৯৮৮ এর সংশোধনে বলা হয় কৃষ্ণাঙ্গ দম্পতির বৈবাহিক অবস্থা একই সম্প্রদায়ের অর্থাৎ ইন কমিউনিটিতে পরিবর্তিত হয় যেখানে নারী-পুরুষ সমান সম্পত্তির অধিকার অনুমতি দেওয়া হয়। যদিও বিষয়টা স্বয়ংক্রিয় ছিল না। এক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের তাদের স্বামীর সম্মতি থাকতে হবে, আবেদনের জন্য অর্থপ্রদান করতে হবে এবং এটি দু’বছরের মধ্যে জমা দিতে হবে। “আমরা জানি আইন বদলায় এবং এটা সবার প্রয়োজনে বদলায়”- অ্যাগনেস বলে, একটু ভাবে, কিছুক্ষণ পর আবার বলে, ‘‘আমি যখন বুঝলাম আইন আমাকে ঠকাচ্ছে তখন এটাও বুঝলাম যে আমাকেই এটার জন্য যুদ্ধটা করতে হবে’’।

অ্যাগনেসের জন্মস্থান ভ্রাইহেইড (Vryheid), যা উত্তরের কোয়াজুলু-নাটাল(KwaZulu-Natal) নামের একটি ছোট কয়লা-খনির শহর। তার বাবা দক্ষিণ আফ্রিকান রেলওয়ের ট্রেইন পরিস্কার করতো এবং তার শ্বেতাঙ্গ বসদের জন্য চা বানাতো। আর মা রান্নাঘরের যাবতীয় কাজ করতেন এবং ধনী শ্বেতাঙ্গ পরিবারের জন্য রান্না করতেন।

“আমি জন্মেছিলাম হতদ্ররিদ্র পরিবারে এবং আমার বাবা মা ছিলেন শ্রমিক। তারা আমাদের জন্য ভাল উদাহরণ হয়েছিলেন”- বলে অ্যাগনেস। “আমরা প্রতি সাপ্তাহিক বন্ধে চার্চে যেতাম। যখন আমি বড় হলাম, খেয়াল করলাম ক্যাথলিকরা ডিভোর্সে সম্মতি দেয় না, এমনকি যেখানে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না সেখানেও।” তিনি আরো বলেন,  ‘‘আমিও আবারো বিয়ে করতে চাচ্ছিলাম না এবং বাচ্চাদের বড় করার ক্ষেত্রে বাসায় বাবামা দুজনকে একসাথে চাচ্ছিলাম”।

এতসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, অ্যাগনেস দেখেছিলেন তার বাবামা একসাথে জীবনযাপন করছিলেন সন্তানদের জীবন সমৃদ্ধ করতে এবং এসব সংগ্রাম দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তার জীবনমান উন্নয়ন করবেন। গিডিওনকে বিয়ে করার আগে তিনি সে নার্স হবার ট্রেনিং নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তার বাড়ি থেকে কাপড় বিক্রির কাজ শুরু করেন এবং আরো অনেক চাকরিই তিনি নিয়েছিলেন যাতে সব চাহিদা পূরণ হয়।

“খুব দ্রুতই আমি নিজেকে এমন জায়গায় পেলাম যেখানে কেবল আমিই ছিলাম, কারণ আমার স্বামী আমাদের জীবনে আসা যাওয়ার মধ্যে ছিল।” অ্যাগনেস বলেন, ‘‘আমাদের দুজনের চার সন্তান ছিল। আমি কাজ থেকে বাড়ি ফিরে আবার কাপড় সেলাই করা এবং কেনাবেচা শুরু করতাম। আমি অনেকগুলো কাজ একসাথে করছিলাম কারণ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমার বাচ্চারা স্কুলে যাবে”। আমি খুব কর্মতৎপর মানুষ”।

প্রায় নয় বছর আগে অ্যাগনেসের জন্য বিয়েটা ছিল একটা নিম্নগামী সর্পিল পথ। একদিন সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফেরার পর অ্যাগনেস দেখলেন তার স্বামী কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই আলাদা রুমে থাকা শুরু করেছেন। তারা একই ছাদের নিচে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে জীবনযাপন শুরু করলেন। “আমরা প্রায়ই একজন আরেকজনের সাথে ধাক্কা খেতাম, করিডরে, সিঁড়িতে, গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় কিন্তু কোনো কথা হতোনা”। অ্যাগনেস স্মৃতিচারণ করলেন। বললেন, ‘বাড়ি বিক্রি করার পরিকল্পনা গিডিওন তাকে কখনোই বলেনি এবং তিনি অবাক হতেন যখন দেখতেন যে কেনার জন্য বাড়িটা দেখতে হরহামেশা লোকজন বাসায় আসছে। যখন উপলব্ধি করলেন যে তার থাকার বাসস্থান হারাতে যাচ্ছেন তখন এই মর্মে আর্থিক অপব্যবহারের একটা আদেশ জারির ব্যবস্থা করলেন যেখানে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল যে তারা পরিবার গঠন এবং এর খরচে সমানভাবে অবদান রেখেছেন, এটা ২০১৯ এর প্রথমদিকের ঘটনা।

দু’বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকার সাংবিধানিক আদালত আগের উচ্চ আদালতের রায়টি নিশ্চিত করে জানান যে চলমান আইনগুলো কৃষ্ণাঙ্গ দম্পতি এবং বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের জন্য বৈষম্যপূর্ণ। এখানে বলা হয়েছিল ১৯৮৮ এর আগে সম্পন্ন হওয়া সব বিয়ে “ইন কমিউনিটি অফ প্রপার্টি” আইনে পরিবর্তিত হবে এবং নারীদের সম্পত্তিতে সমান অধিকার দেওয়া হবে।

অ্যাগনেস এবং তার ছোট মেয়ে অনলাইনের মাধ্যমে রায়টি তাদের শোবার ঘর থেকে দেখছিলেন। প্রথম অবস্থায় অ্যাগনেস বুঝে উঠতে পারেননি যে তিনি কেসটি জিতবেন যতক্ষণ না তার আইনজীবী তাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন।

অ্যাগনেস বলেন, “আমি আইনি পরিভাষাগুলো বুঝতে পারছিলাম না, পুরো সময়টা আমরা কোনো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমার পেটের ভেতর বিষয়টা অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করছিল, আমি ভীত ছিলাম কিন্তু আমার বিশ্বাসও ছিল। আনন্দের কান্না পেয়েছিল। কারণ এটা ছিল আমার মতো বিবাহিত হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ নারীর অধিকার সংরক্ষণের জন্য নবসূচনা।”

অ্যাগনেস বলে, তার এই লড়াই করার চ্যালেঞ্জগুলো পেয়েছিলেন তার নিজের জীবনে মুখোমুখি হওয়া অভিজ্ঞতা থেকে। অ্যাগনেস আরো বলেন, ‘‘আমি জানি আমি কে, আমি কীভাবে এগুতে চাই এবং আমি যেকোনো উপায়েই আত্মনির্ভরশীল হতে চাই, এটাই আমার চরিত্র। যেটা অবশ্যই আমাদের সংস্কৃতি এবং আমার প্রজন্মের মহিলাদের থেকে আলাদা। এক্ষেত্রে এই কেসটিতে জিতে যাওয়া ছিল আমার জন্য সর্বোচ্চ পাওয়া যা আগে কখনো ঘটেনি”।

অ্যাগনেস গিডিওন’কে ক্ষমা করে দিতে পেরেছিলেন কারণ এই কেস চলাকালীন সময়ে গিডিওন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মারা যাবার দু’দিন আগে গিডিওন তার স্ত্রী ও দুই কন্যার কাছে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন ।

পরে জানা যায়, অ্যাগনেস তার স্বামীর করা উইলে তার নাম নেই এবং তাদের বাড়িও অন্য কারো নামে ছিল। যদিও কোর্ট গিডিওনের ইচ্ছা পূরণ করতে দেয়নি, তার করা উইল বাতিল করে দেয়। অ্যাগনেস বলেন, “আমরা তাকে ক্ষমা করেছিলাম এবং আমি শান্তিতে আছি। আমি কোনোকিছুর জন্য দুঃখিত নই কারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এটাই যে আমি আমার বৈবাহিক জীবন পূর্ণ করেছি । আমি তার কিছুই চাইনি কিন্তু সে আমার সবকিছু নিতে চেয়েছিল, এমনকি সেটাও যা আমার একবারেই নিজস্ব ছিল এবং কাজ করে অর্জন করেছিলাম। এটা আমি কখনোই পছন্দ করতে পারিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *