April 29, 2024
জীবনের গল্পফিচার ৩

এক দিনের স্বাধীনতা!

জাহারা আলম ।। আমি ধনবাড়ী ফুটবল একাডেমিতে ফুটবল খেলি। এই একাডেমিটি নিজেরা করি নামক এক এনজিও দ্বারা পরিচালিত হয়। আমরা প্র্যাকটিস শেষে ড্রেসিং রুমে গেলাম, সেখানে এনজিওর এক আন্টি (এনজিওকর্মী) এসে বললো, “কালকে তোমাদের সাথে কথা বলতে নিজেরা করি’র মূল্যায়ন টিম আসবে, যাদের কাজ হলো এনজিওর বিভিন্ন কেন্দ্রের তথ্য উপরমহলে পৌঁছে দেওয়া। আর কালকে তোমরা বাড়ি থেকেই জার্সি, বুট পরে আসবা।”

পরের দিন কথামতো খেলোয়াড়ি পোশাক পরে বাড়ি থেকে বের হলাম। বাজারের রাস্তাটা দিয়ে না গিয়ে স্কুলের পেছনের রাস্তা দিয়ে মেইন রোডে উঠলাম। আসলে পুরুষশাসিত সমাজে বাস করে বাজারের পুরুষগুলোর সামনে দিয়ে যাওয়া ভয়াবহ ব্যাপার বলে মনে করে আমার পরিবার। অটোতে ওঠার পর কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। অটোতে যারা ছিলেন তারা আমার দিকে তাকালো না পর্যন্ত। তার কারণটা হলো করোনার সময় আমি চুল কেটে ফেলেছিলাম, চুল ছোট থাকায় ক্যাপ পরেছি, আর মুখে মাস্ক পরেছি। বুঝতে দেরি হয়নি তারা আমাকে ছেলে ভাবছে।

এমনিতে যখন মেয়েদের সাধারণ পোশাক পরে যেতাম তখন মহিলারাও অন্য রকম দৃষ্টিতে দেখত। যেমন – মেয়েটির জামাকাপড় ঠিক আছে কিনা, মাথায় কাপড় দিয়েছে কিনা! আর পুরুষদের তো কথাই নেই, পারলে কিভাবে গিলে খাওয়া যায় তার চেষ্টা করতো।

কিন্তু আজকে দেখলাম একই রাস্তায় একই রকম যানবাহনে অন্য এক দুনিয়া! অটো থেকে নামার পর রাস্তায় একই অবস্থা। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যে ছেলেরা আজেবাজে মন্তব্য করতো, তারা তাকিয়েও দেখলো না। মনে আনন্দের জোয়ার বইছিলো শুধু একদিন নির্দ্বিধায় পথ চলতে পারায়। তাহলে ছেলেরা কত খুশি থাকে, সারাজীবন কোনো দ্বিধাদন্দ্ব ছাড়া রাস্তায় চলে!

আমার স্কুলের বান্ধবীরা মাঝেমধ্যেই বলাবলি করতো, “আমি ছেলে হলে এইটা করতাম, ঐটা করতাম।” তবে আমি বলতাম, আমি ছেলে হলে যা করতাম, মেয়ে হয়ে তাই-ই করি। শুধু তফাত একটাই, ছেলেরা অনেক সহজে তাদের কাজগুলো করতে পারে আর মেয়েদের অনেকগুণ কষ্টে সেই কাজগুলো করতে হয়।

ওখানে যাওয়ার পর দেখলাম দুইজন গবেষক এসেছেন। তারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র। তাদের প্রশ্নগুলো ছিল – সমাজ সম্পর্কে আমাদের ধারণা কী? ইভটিজিং করলে প্রতিবাদ করি কি না? তারা সামাজিক উন্নয়ন সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো করছিলেন।

এইসব প্রশ্নের আশি শতাংশ উত্তর আমিই দিয়েছিলাম। তারা আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া নারী-পুরুষ বৈষম্যমূলক ঘটনাও জানতে চেয়েছিলেন। আমি বললাম একটার কথা-

একদিন সন্ধ্যার পর আমি আর মা মিলে আসছি। মিলে আসার পর দেখি বাবা একটা লোকের সাথে কথা বলছে। আমি বাবার কাছে যাওয়ার পর লোকটি বললো, “আপনার মেয়ের কি মাথায় কোনো সমস্যা আছে? চুল কেটে দিছেন যে!”

বাবা বললো – নাহ,মাথায় উকুন হইছিল, তাই চুল কেটে ফেলেছে।

ব্যাটা আমারে বলতাছে, তোমার কি এই বয়সে চুল কাটা ঠিক হইছে? তোমার বাবা যে মানুষ, তোমার কোটিপতির ঘর থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসবো, আর তুমি চুল কাইটা ফালাছ?

ব্যাটার মুখ ছাগলের জাবর কাটার মতো চলতেই লাগলো। আমি সুন্দর করে বললাম, আমি আমার নিজের ইচ্ছায় চুল কাটছি। কে কী বললো আর কী বললো না, তাতে আমার যায় আসে না। কত অনার্স -মাস্টার্স করা আপুরা চুল কাটে।

এগুলো বলার পর মনে মনে হাসলাম, ব্যাটা কত বড় চাপাবাজ, আমার বাবা ক্ষুদ্র মিল ব্যাবসায়ী আর বলে কোটিপতির কথা।

আমার কথা শুনে সে বাবাকে বললো- এখানে আর থাকতে পারতাছি না। আদরের মেয়ে তো, এর জন্য আপনার কপাল অনেক দুঃখ আছে, অনেক দুঃখ আছে।

এগুলো বলে, প্লাগের কাছ থেকে কিছু একটা নিয়ে চলে গেল। আমি বাবাকে বললাম লোকটা কে? এখানে কেনো এসেছিল? বাবা বললো, ইটের ভাটায় মাটি কাটে, ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছিলো চার্জ দিতে এসেছিল। লোকটা বলছিল, আমাদের দূরসম্পর্কেরর আত্মীয় হয়।আমি তো তাকে চিনি নাই। কি চাটুবাজ লোকটা! বলছিল, তার আত্মীয় স্বজন নাকি কোটিপতি, বোনকেও নাকি কোটিপতির কাছে বিয়ে দিছে।

সোলায়মান ভাই আসলো। ভাইয়া বললো, কিছুদিন আগে আগে ঐ বাড়িতে চোর এসেছিলো, সেই চোর এই লোকটার মতো কথা বলে বাড়িতে ঢুকেছিলো,পরে সুযোগ বুঝে চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে। আমি বাবাকে বললাম, ব্যাটার আত্মীয় স্বজন কোটিপতি তারপরও তাকে মাটি কাটার কাজ করতে হয়!

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা গবেষক আমাকে বললো “আপনি বলতেন লোকটাকে- আপনার চুলও তো ছোট, তাতে আমি তো কিছু বলছি না, আপনি কেন বলছেন?” আপনার জন্য আপনার বাবার দুঃখ হবে কি হবে না তা নির্ভর করে আপনার বাবার ওপর, আপনার বাবা আপনাকে কিভাবে দেখেন তার ওপর।

তারা আমাদের একটি ম্যাচ দেখলেন। তারপর আমরা যে যার মতো বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।

আমরা যে জায়গায় প্র্যাকটিস করি সে জায়গাটার নাম পাইস্কা। পাইস্কা থেকে ধনবাড়ী আসলাম। যতক্ষণ অটোতে ছিলাম তখনও তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলাম।

ধনবাড়ী থেকে বাড়ি ফেরার জন্য বাসস্ট্যান্ডে অটোর অপেক্ষা করতেছিলাম। সিএনজিতে উঠতে বাবা নিষেধ করতো কারণ সিএনজিতে প্রায় প্রায়ই দুর্ঘটনা হয়। তখন মনে হলো, এই জায়গায় একদিন দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। সেদিন আমার এক বড় ভাইয়ার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছিলো। তাই প্র্যাকটিস থেকে তাড়াতাড়ি ফেরার জন্য জার্সি পরেই আসতেছিলাম। ঠিক একই জায়গায় অটোর জন্য অপেক্ষা করতেছিলাম। শুধু একটাই পার্থক্য তখন আমার চুল বড় ছিল। বাসস্ট্যান্ডের অটোয়ালারা আমাকে দেখে হাসাহাসি করতেছিল। তখন মনে হলো পরিবেশটা অন্য জগতে চলে গেছে, যেখানে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে।

তখন একজন হেসে বললো, ঐ অটোতে বসো, ঐটা আমার অটো। যখন ঐ দিকের অটো পাবো তোমাকে বলে দেবো তখন চলে যেও।

আমি লোকটার অটোতে বসার একটু পরে বাড়ি ফেরার জন্য একটা অটো পেলাম। সে অটোতে ছিলো কালো বোরকাধারী মহিলা। আমি ওঠার পরে আমাকে দেখে আলাপ শুরু হলো। তাদের কথাগুলো শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, আমাদের বাড়ির পথটুকু এতো বড় হয়ে গেল কিভাবে? শেষ হতেই চাইছিল না!

সেই দিনের দাঁড়িয়ে থাকা আর আজকের দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। আজকের সমাজটা আমাকে ছেলে ভেবে যে স্বাধীনতা দিয়েছিলো এটার পুরাই বিপরীত ছিলো। সেই দিন তাদের কাছে মেয়ে হয়ে খেলোয়াড়ি পোশাক পরাটা অপরাধ ছিল।

বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষারত ছিলাম তখন এক অটোয়ালা বললো, কোথায় যাবা?

আমি বললাম নল্যা।

সে বলল, যাও সামনে গিয়ে বসো।

তখন আমি ইতোস্তত বোধ করে বললাম, সামনে বসবো? ড্রাইভারের সিটের সাথে!

পরে আমি গিয়ে পেছনের সিটে বসে পরলাম।

পরে মনে হয় লোকটা আমার কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পেরেছিল। একটু শুনতে পেলাম লোকটা বলছিলো – এইটা মেয়ে!

তারপর ব্যাপারটার জন্য একটু হাসলাম। মাস্ক পরে ছিলাম, কেউ বোঝেনি।

কি আজব! এক জাতি আরেক জাতিকে পিষে মারে!

নল্যা এসে নামার পর প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। তাই হয়তো কেউ চিনতে পারেনি, না হয় তারাও আমাকে ছেলে ভাবছে!

আমি আগে যে স্কুলে সে পড়তাম সেই স্কুলের এক স্যার সামনে পড়ায় তাকে সালাম দিলাম। তিনি আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন।

এই একদিনে বুঝলাম স্বাধীনতার আসল মানে কি! একবুক স্বাধীন নিঃশ্বাস নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *