December 26, 2024
সাহিত্যগল্পফিচার ৩

অন্তর্গত

ক্যামেলিয়া আলম ।। ভেজা চুল নিয়েই বসার ঘরটায় পা দেয় নীলা। চুল থেকে টপটপ পানি ঝরতে থাকে। রিনা অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে দুইজন নিয়ে। দ্রুত গিয়ে সামনের বেতের চেয়ারটা টেনে বসে। মধ্যদুপুর। এ সময় কেইসগুলো সাধারণত শোনে না। সকালেই কেইসের পাট চুকিয়ে দুপুর থেকে বাসায় থাকে। অবশ্য প্রজেক্ট এরিয়াগুলোতে যখন সরেজমিনে যেতে হয়, তখন ফিরতে ফিরতে কখনও বিকেল, রাত বা মধ্যরাতও হয়ে যায়। এনজিও’র কাজ করতে করতে সাহস একটু করে বেড়েছে। একলা চলতে ফিরতে তেমন আর সমস্যা হয় না। মাহীন আর শিবু থাকে ঢাকায়। মাহীনের অফিস আর শিবুর স্কুল নিয়ে টানা হেচড়া করতে না চাওয়ায় ওদের ঢাকায় রেখেই প্রজেক্টের কাজগুলো করতে এখানে আসা। উইকেন্ডে ঢাকায় ফেরা আর আবার এই শহরতলিতে ফিরে আসা এখন অভ্যস্ততার জীবনে পরিণত হয়েছে।

নীলা বসতেই রীনার সাথে বসা দুইজন উঠে দাঁড়াতে গেলে নীলা বাধা দিয়ে বসায়। একজন ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে বসা রীনা। নীলা রীনার দিকে তাকাতেই রীনা বলে, আপা, এই মেয়েটা মামলা করেছে, এখন তার পাশে থাকা জরুরি। কেইসটা জটিল।

নীলা মেয়েটার দিকে আড়চোখে একবার তাঁকিয়ে দেখে। মেয়েটা ওর টেবিলে রাখা নীল সিরামিকের জাহাজ খুঁটিয়ে দেখছে। নায়াগ্রা ভ্রমণে গিয়ে এনে দিয়েছিলো ওর ভাগনি। সাদামাটা কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় শিপের চারপাশ জুড়ে রেলিং ঘেষে প্রায় ৩৭টা ছোট মাথা। সিরামিকস এর এক সাধারণ জিনিষ, কিন্তু নায়াগ্রায় জাহাজ ভ্রমণের স্মৃতি যোগ হয়ে তা মূল্যবান হয়ে গেছে। মেয়েটার চোখগুলোর নড়াচড়া দেখে বোঝে মাথা গুণছে সে। নীলার মুখে স্মিতহাসির চিলতে রেখা দেখা যায়। মায়া লাগে মেয়েটিকে। মাথা থেকে দূর করতে চায় ভাবনাটা। নিরপেক্ষতা নিয়ে দেখতে হয় কেইসগুলো। মিথ্যা মামলা করছে কিনা বা কাউকে ফাসাতে এই মামলা কিনা তা খুব সতর্কভাবে আগে অবজারভ করতে হয়। খুব সূক্ষ্মভাবে বুঝে নিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থায় যেতে হয়। নীলার কাজ মূলত কেইস স্টাডি করে রিপোর্ট জমা দেয়া। ঘটনার সত্যতা থাকলে পরবর্তীতে এনজিও থেকে মেয়েটিকে প্রটেকশন আর আইনি লড়াইয়ে সহায়তা দেয়া হয়। এখন এই মায়া লাগাটা এক ধরনের নন প্রফেশনাল অবস্থান। যা একদম ঠিক না। তাই কিছুটা গলাখাকারি দিয়েই নিজেকে সংযত করে নীলা। শব্দে মেয়েটার মনোযোগ ছিন্ন হয়। চোখ তুলে তাকায় নীলার দিকে।

নীলা এবার মেয়েটির কাছে জানতে চায়, বল, কী বলবে? নীলার চোখ আর মন এবার সংযত। সূক্ষ্ম অনুধাবনের জন্য এবার সতর্ক।

মেয়েটির ঠোঁট কাঁপে। কিন্তু কিছু বলে না। চোখ নামিয়ে বসে থাকে নিশ্চুপ হয়ে।

ওর পাশে বসা ছেলেটা বিরক্তিতে একটু নড়েচড়ে বসে। পা নাড়াতে থাকে। উসখুস করে বলে, কন না ক্যান? ম্যালা দেরি হইছে আইতেই, বাড়িত যাইতে হবে না?

মেয়েটা তবুও নির্বাক। কুঁকড়ে বসে আছে।

নীলা এবার মোলায়েম গলায় বলে, তুমি সব খুলে বল, এখানে তো আর কেউ নেই। কোর্টে অনেক লোকের সামনে কথাগুলো বলতে হবে তোমার। তোমার কথা তুমি না বললে তোমার পক্ষে বিচার করবে কী করে? ভিন্নপক্ষ তো জিতে যাবে!

মেয়েটি কেঁপে উঠে বলে মনে হয় নীলার। তবু চুপ করে থাকে। ঘরে ফ্যানের ঘটঘট শব্দ এবার বেশ জোড়ালো ভাবে কানে লাগে। বাইরে এক ডাহুক ডেকে ওঠে। থেমে থেমে পাখির ডাকাডাকি ছাড়া নিঃশব্দ দুপুরে গুমোট গরমে আর কোন শব্দ পায় না কেউ। বেশ কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে বোঝে নীলা মেয়েটির সাথে একা কথা বলতে হবে। আর আরেকটা ব্যাপারে কিছুটা নিশ্চিত হয়, মেয়েটা সত্যিই ভিকটিম। ভিকটিম মাত্রই তার বাস্তবতাকে সবার সামনে আনতে থাকে আড়ষ্টতা। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ধর্ষণের কেইসগুলো নিয়ে ডিল করতে করতে ভাবে, মানুষের এই বিকৃত বোধের শেষ কোথায়! একেকটা কেইসে উঠে আসে একেক রকম বিকৃতি।

নীলা স্বাভাবিক গলায় বলে, আমি ওর সাথে আগামীকাল কথা বলবো। এখন সংক্ষেপে তুমি বল, বলে পাশে বসা ছেলেটার দিকে তাকায়। যা জানতে পারে, মেয়েটির স্বামী থাকে ভারতে। প্রায় ৯ বছর। এর মাঝে মেয়েটি গর্ভবতী হবার পর জানাজানি হয় মাস তিনেক আগে সে ধর্ষণের শিকার হয় এলাকার বেলাল নামক এক ব্যক্তিকে দিয়ে। তিনি প্রভাবশালী। সে কারণে মেয়েটি ঘটনা ঘটার পরপরই ভয়ে চুপ করেছিল। এমনকি পরিবারের কাউকে জানতে দেয়নি। গর্ভবতী হওয়ায় বিষয়টি আর ঢেকে রাখা যায় নি। পরিবারে সবাই তাকে ভুল বুঝলেও ভাসুরের ছেলে হিসেবে পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য নিয়ে আসে ছেলেটি। চাচীকে দিয়ে মামলা করিয়ে বাকি সহায়তার জন্য এনজিও’তে আসে। কারণ মামলা করার পর তাদের পরিবারে নিরাপত্তা নিয়ে ঝামেলা হতে পারে। সেজন্য এক ধরণের নিরাপত্তার জন্যই চাচীর সাথে আসা। সব বলা শেষ করে ছেলেটা চাচীর দিকে তাকায়, রুক্ষ্মভাবেই বলে, যদিও জানি না আসলে কার দোষ?

নীলা মেয়েটির দিকে তাকায়। মেয়েটি অপলক হয়ে নীচের দিকে মুখ করা। আগের মতোই নির্বাক। নাহ! মেয়েটির সাথে কথা বলতেই হবে। ওর ভেতরের কথাগুলো টেনে বের করতে হবে। নীলা বুঝতে পারে, এমন এক ঘটনায় পরিবার আর সমাজের কত বড় ঝড় যাচ্ছে ওর মাথার উপর দিয়ে। মেয়েটার চোখও শুকনা। কেমন যেন ছেড়ে দিয়ে বসা। যেন আর কিছুই বলার নেই, করার নেই, কেবল দিন যাপন করা ছাড়া। চারপাশ দেখা ছাড়া। এখন নিয়তি তাকে যেখানে নেয় স্রোতে ভাসতে ভাসতে সেও যাবে।

পরের দিন মেয়েটা একাই আসে। গোলাপী বড় ছাপার এক শাড়ি কুচি দিয়ে পরা। চুলগুলো খরখরে, মুখটা লাবণ্যে ভরা। রোদের তাপেও মুখ তামাটে হয়নি, কেবল গালগুলোয় লাল আভা জমা। চেনা ঘরে বসার মতোই নিজেই চেয়ার টেনে নিয়ে সাবলীলভাবে বসে। গতকালের চেয়ে বেশ সপ্রতিভ। কেবল ড্যাবড্যাবে বড় বড় চোখগুলোর নীচটুকু ভেতরে বসা। দীর্ঘদিন না ঘুমালে বা বহুক্ষণ কাঁদলে যেমন হয়। মেয়েটার সামনে চা নাস্তা দেয়া হলে চায়ের কাপটা নিজেই টেনে নিয়ে মুখে তোলে। ছোট এক রেকর্ডার রাখা সামনের টেবিলটায়। নীলা সপ্রতিভভাবে জানতে চায় ওর খোঁজখবর। সাধারণ টুকটাক কিছু কথার পরে কাজের কথায় সন্তর্পণে আসার আগে টেবিল থেকে রেকর্ডারটা হাতে নিয়ে বলে, তোমার সাথে আমার কথাগুলো আমি রেকর্ড করবো এখানে। কারণ রিপোর্ট করতে গেলে অনেক কথা ভুলেও যেতে পারি। তাই রেকর্ডটা থাকলে কাজের সুবিধা হয়। তোমার কোন আপত্তি নাই তো?

মেয়েটা কিছুই বলে না। রেকর্ডারের দিকে তাকিয়ে চুমুক দিতে থাকে চায়ের কাপে। নীলা অভ্যস্ত হাতে রেকর্ডার অন করে রেখে মামুলি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করে আলাপ –

বাড়িতে কে কে আছে তোমার?

আমার দুই মেয়ে আর আমি, বড় মেয়ের বিয়ে হইছে তিন বছর আগে। সে মাঝেমধ্যে আসে।

সেদিন ভাসুরের ছেলে যে এলো

আমার শ্বশুরবাড়ি বাজারের কাছে। তারা একসাথে থাকে

তুমি মেয়ে নিয়ে আলাদা কেন থাকো? দুই মেয়ে নিয়ে নিরাপদ একা থাকা?

আমার স্বামীর ভিটা। তাই ছাড়ি না। সরলেই দখল হয়ে যাবে সব

শ্বশুর শাশুড়ি ক্যান থাকে না?

তাদের বড় ঘর। বাজারের কাছে। এতোদূর আসবে না। আর ছেলের ঘরে থাকবে না।

স্বামী ভারতে থাকে। কতদিন পরপর আসে?

সে আসে না নয় বছর ধরে। ফোন দিয়া মেয়েদের সাথে কথা কয়।

তোমার সাথে কথা হয় না?

মেয়েটা চুপ হয়ে ভাবে কিছুক্ষণ –

মেয়েরা কথা বলতে বলতে ফোনের টাকা শেষ হয়ে যায়।

স্বামীর সাথে এই নয় বছরে শেষ কবে কথা বলছো?

শেষ বলছি গত কাল আর ঘটনা জানাজানির দুইদিন পরে।

তোমার স্বামী শুনে কী বলে?

মেয়েটার ঠোঁটে এক চিলতে ফ্যাকাসে হাসি দেখা যায়। বিষাদের না কষ্টের – ঠিক বোঝা যায় না

ঘটনা জানাজানির পরে তার সাথে যখন কথা হইছিল, সে আমারে মামলা করতে কইছে। আমার মাইয়াগুলোরে সাবধানে রাখতে কইছে। পরে…

ঢোক গিলে থেমে যায়।

পরে আমার ননদের সাথে কথা কইয়া আমারে ফোন দিয়া কইছে, বেশ্যা মাগী, তুই আমার মাইয়াগো ছুইবি না। তোর লগে আমার আর সম্পর্ক থাকবো না। মাইয়াগো তার বাপের বাড়ি নিয়া গেছে।

বুঝলাম না, মেয়েদের তোমার শ্বশুড় শাশুড়ি নিয়ে গেছে?

না, আমার মেয়ে দুইটা আমার সাথে রাগ করে আমার ননদের বাড়িতে চলে গেছে। তারা কয়, আমারে গলায় দড়ি দিতে। নাইলে বাপের ভিটায় আসবে না।

তুমি কি এখন একলা থাকো?

হুম, বলে গলার ঘাম মোছে শাড়ির আঁচল দিয়ে। এরপর গাল চুলকায়। ইতিউতি তাকায়।

পানি খাবে?

হুম

ঢকঢক করে পানি খায়। নীলা স্পষ্ট করে এবার জানতে চায়।

তুমি বল কী হয়েছিল সেদিন

সইন্ধা ছিল

বলে থামে, হঠাৎ কেমন নিস্তব্ধ লাগে চারপাশ। এরপর খড়খড়ে গলায় আচমকা কথা শুরু করে –

লাকড়ি ঘরের ভিতরে চাইলের বস্তা থাকে। দিনে খেয়াল করি নাই রাইতে ভাত রানতে গিয়ে দেখি চাইল শেষ। চাইল আনতে লাকড়ি ঘরে ঢুকছি, পিছে পিছে কেউ আসতেছে তা আন্ধারে দেখি নাই। চাইল ভরতাছি গামলায়। এমন সময় পিছন থিকা বিল্লাল জাপটায় ধরে। চমকায় উইঠা গা ঝাড়া দেওনের পরেও ছাড়ে নাই।

বলে মাথা হঠাৎ নামিয়ে ফেলে। চিবুক ছুয়ে যাচ্ছে বুকের উপর। নীলা অপলক চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ওকে

তোমার অমতে হয়?

হ হ, আমি চাই নাই, আমি চাই নাই, কিন্তু শক্তিতে পারি নাই তাই মাইনা নিছি

তুমি কাউকে ডাকার চেষ্টা করনি?

না আপা, এ তো শরমের, আর ডাকলে তো আমার মাইয়াগো ধরবো

তোমার স্বামী প্রায় ৯ বছর নাই। তুমি কখনও চাওনি কেউ জীবনে আসুক তোমার

চাইছি আপা, চাইছি, কিন্তু এমনে চাই নাই। আপা, আমি জানি আমারে কেউ বিশ্বাস করবে না, আমার পেটের মেয়েরাই করে নাই, আপনিও করবেন না।

তোমার স্বামী নয় বছর আসে না, সে বিয়ে করেছে কিনা জানো কিছু?

জানি না আপা, মাইয়ারা জানে করে নাই, আমিও তা জানি

তুমি শুরুতেই কেন জানাও নি? ধর্ষণের কেইসে তো মেডিকেল রিপোর্টটা খুব ইমারজেন্সি

নীলা ভাবনায় পড়ে যায়। কেইসটা জটিল। মেয়েটা মিথ্যা বলছে কিনা তাও নিশ্চিত না। পরস্পরের সম্মতিতে কিছু হয়েছে কিনা, পরে সামাজিক প্রেশারে ধর্ষণের নাটক সাজাচ্ছে কিনা! এক গোলকধাঁধার কেইস। টু বি অর নট টু বি’র দোদুল্যমানতা চলতে থাকে নীলার মাথায়। মেয়েটা চলে যাবার সময় আবার ঘুরে তাকায়

একগাদা কথা হড়হড় করে বলে। মেয়েটা একঘরে এখন সমাজে। সবাই এড়িয়ে চলে। নিজের মেয়েরাও গালাগালি করে। বড় মেয়েকে ওর শ্বশুড়বাড়ির লোকেরা ভীষণ লাঞ্জনা করে। কেউ বিশ্বাস করে না। আর সবচেয়ে বড় কথা, স্বামী নামক এক সুতার বন্ধনী দিয়ে এতোদিন সমাজে সে আর তার মেয়েরা কিছুটা নিরাপদে ছিলো। এখন সেই নিরাপত্তাটুকুতেও চিড় লাগতে যাচ্ছে। মামলায় জিততে না পারলে অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে মেয়েটা। পেটে আসা অনাকাঙিক্ষত সন্তানের জন্যও তার দুশ্চিন্তা। স্বামীর সংসার জোড়া না লাগলে নবাগতকে খাওয়াবে কোথা থেকে। ২৫ বছর কাটিয়ে দেয়া ভিটেমাটিতেও থাকার অধিকারও সে হারাতে যাচ্ছে। চেনা জানা পথ, বারান্দা, ঘাটপাড়টুকু এক নিমিষেই স্বপ্ন হয়ে যাবে। কী ভয়ংকর এক রিয়েলিটি!

ভাবতে থাকে নীলা। কিন্তু ভেবেও কূল পায় না। এই কেইসে জিতার মতো কোনো প্রমাণই তো নেই। আবার মেয়েটাও সব সত্যি বলছে কিনা! পরিস্থিতির চাপে নিজেকে রক্ষা করতে মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরতে বাধ্য হচ্ছে কিনা! দীর্ঘ নয় বছর স্বামী নেই। শারীরিক ইচ্ছা কি জাগে নি কখনও? আর কি অদ্ভুত এই সমাজ কাঠামো। ওর স্বামী নয় বছর বউ ছেড়ে থাকছে। সে কি সন্ন্যাস জীবন নিয়ে চলছে? মনে তো হয় না। কিন্তু ওর স্বামীর প্রতি কারও কোনো কথা নেই, ক্ষোভ নেই। বাপের ভিটায় থাকছে আর মাস গেলে টাকা পাঠাচ্ছে বলে বাবার নিজের জীবন নিজের মতো চালাবার বাস্তবতাকে সানন্দে মেনে নিচ্ছে মেয়েরা। কেবল মায়েদেরই ইচ্ছে, অনিচ্ছে, অধিকার থাকতে নেই। কি বিচিত্র মনোস্তত্ব!

মেয়েটা কেইসে হারলে পরিবার হারাবে, ভিটেমাটি হারাবে, নিজের বাবার সংসারে কেউ ঠাঁই দেবে না, একঘরে হয়ে বেঁচে থাকতে হবে আর সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার এরপর অন্যান্যদের দিয়ে মেয়েটা বারেবারে ভিকটিম হবে। তবু নীলার ভেতরে অস্বস্তি হতে থাকে। যদি মেয়েটা নিজেকে বাঁচাতে, সমাজে টিকে থাকতে মিথ্যা কথা বলে , মেয়েটার সম্মতিতে যদি ঘটনা ঘটার পর মেয়েটা ভয়ে এই মামলা করে, তাতে শাস্তি হতে পারে নিরপরাধ এক লোকের। সেক্ষেত্রে তার ১৪ বছরের জেলও হয়ে যেতে পারে। কী করবে ভাবতে পারে না নীলা। শুধু মেয়েটার শেষ আঁকুতির কণ্ঠটা মনে আসছে বারেবারে –

আপা, বিশ্বাস করেন, আমি চাই নাই, সত্যিই চাই নাই। আমার উপর জোড় খাটাইছে, আমার তাতে কোন সায় ছিল না, ইচ্ছা ছিল না। আপনি আমারে একবার বিশ্বাস করেন। কেউ বিশ্বাস করে না। আপনি আমারে করেন। আমি চাই নাই, কিছুতেই চাই নাই। আমার ঘিন্না লাগছে, গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু মরতে তো ডরাই আপা। আমি মরতে পারি নাই।

রাতের খাবার খেয়ে নীলা ঘরোয়া পোষাক পরে নেয়। টপস আর প্লাজো পরে ঘুমায় খুব স্বাচ্ছন্দ্যে। তাই রাতে সেই পোশাকটাই গায়ে জড়ায়। মীনাবু থালা বাসনগুলো ধুচ্ছে। নীলা বেডরুমে দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে বিছানায় আয়েশ করে শোয়। ওর শোয়াটা অন্যরকম। মাথায় এক বালিশ আর পায়ের নীচে এক বালিশ নিয়ে হাতগুলো বুকের উপর রেখে কিছুক্ষণ চিৎ হয়ে শুয়ে পা নাচায়ে কোন বই পড়বে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলে পায়ের নীচের বালিশটা বুকে জড়িয়ে ডান কাত হয়ে শুবে। প্রতিদিন একই অভ্যাস। আজ পড়তে ইচ্ছে করছে না। নতুন মেয়েটার কথা মনে এলো তখন। ভাবতে থাকে। একটা মেয়েকে রাষ্ট্র সেইফ করবে কী করে? আইন কানুন সবই তো আছে, শুধু মানুষগুলোর কাছে সেইসব লজিক্যাল টার্মের মূল্য নেই। নিজের কথা ভাবতে থাকে নীলা। ও এই অবস্থায় পড়লে মাহীনকে কতটা বোঝানো যেতো? শহর ছেড়ে গ্রামে এসে থাকছে, দুই মাসে তিন মাসে ঢাকায় যাওয়া হয় ২/৪ দিনের জন্য। মাহীন বিশ্বাস করতো কি নীলাকে? হয়তো করতো, হয়তো বা না। কিন্তু মেয়েটা যদি মিথ্যা বলে! আবারও কিন্তু আসে নীলার মাঝে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে দুলতে একটু তন্দ্রার মতো আসে। হঠাৎ ঘুমের মাঝে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় নীলার। কাশতে কাশতে জেগে যায়। মাথার পাশে রাখা ইনহেলার স্প্রে করে। কাশির দমক কিছুটা কমে। উঠে কুলি করে, পানি খেয়ে এসে পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে পা দোলাতে থাকে। ঘুম আসতে চায় না। আচমকা একটা স্মৃতি তীরের মতো ওর কাছে ছুটে আসে।

ছাত্র জীবনে স্বেচ্ছাসেবকের কাজে দলবেধে ঘুরতো। নানা জায়গায় কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়তো কখনও কখনও। এমন এক ক্লান্তিকর দিনের অবসরে ৪/৫জন মিলে নাহিদ আপার বাসায় বারবিকিউ পার্টি করার সিদ্ধান্ত নেয়। পার্টিতে মাহতাব ভাই, মৃধা, তুলি, শাহানূর ছিলো। গাজা আর এলকোহলের ব্যবস্থাও ছিলো। নাহিদ আপার বাসাটাও সেইফ। আর বন্ধুরাও তা। ফলে সামান্য মজা হিসেবেই সবাই একসাথে বসে। কিছু সময়ের মাঝেই আড্ডা হুল্লোড়ে পরিণত হয়। সাধারণ কথাতেও প্রাণ খুলে হাসার দমক চলতে থাকে। প্রায় সারারাত আড্ডার এক পর্যায়ে ঘুমের আয়োজন হয় এ ঘরে ও ঘরে। যে যেখানে জায়গা পায়। খাটের উপর মাহতাব ভাই জায়গা নিয়ে নেয়, নাহিদ আপা তার বিছানায় শুয়ে পড়ে। নীলা ফ্লোরে বিছানা পাতে। এক বালিশ ভাগ করে নেয় মৃধার সাথে। শুরু হয় দুইজনের নানা বিষয় নিয়ে গল্প। আলবেয়ার কামু থেকে ইতালো কারলিনো, মিশেল ফুকো থেকে কিয়ের্কেগার্ড নিয়ে তুমুল আলোচনার এক পর্যায়ে মৃধা ওকে জাপটে ধরে। চুমু খায় গভীর আলিঙ্গন করে। নীলার মন সায় দেয় না, শরীর ঝাড়া দিতে চায়। কিন্তু শরীর তখন নেশায় এতোই টালমাটাল যে মৃধার শক্ত হাতের বাঁধুনি থেকে সরতে পারেনা। নীলা প্রবলভাবে বাধা দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু নিজের অনিচ্ছাতেও নীলা অনবরত হাসতে থাকে। নীলা হাসতে না চাইলেও হাসি থামাতে পারে না। এতে মৃধার চাপ আরও বাড়তে থাকে ওর গায়ের উপর। একসময় টের পেতে থাকে, এমন কিছু হতে যাচ্ছে, যা নীলা চায় না, কিছুতেই চাইছে না। কিন্তু বাধা দেয়ার শারীরিক সক্ষমতা কিছুতেই আনতে পারে না। অনিচ্ছাতে আর ঘৃণায় কুকড়ে মৃধাকে গালি দেয় মাতালের মতো। মৃধা থামে না।

পরদিন সকালে কিছুটা সুস্থির হলে নাহিদ আপাকে প্রথম জানায়। নাহিদ আপা স্তব্ধতা নিয়ে বসে থাকে। একে একে সবাই জাগে। প্রায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল, সন্ধ্যা অবধি চলে মৃধার সাথে নীলার তর্ক বিতর্ক। মৃধার ভাষ্য। একই সাথে বালিশ শেয়ার করে শুয়েছে, ওর গায়ে গা ঘেষে শুচ্ছে, যখন কাছে যাচ্ছে তখনও নীলা হাসছিল। তাহলে কোনো পুরুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নীলার সম্মতি ছিল না? নীলা হতভম্ব হয়ে মৃধার দিকে তাঁকায়। প্রায় দুই বছর একসাথে মাঠে ঘাটে কাজে থেকেছে। দলবেধে একঘরে ঘুমিয়েছে বহু সময়ে। কখনও সমস্যা তো হয় নি। আর সবচেয়ে বড় কথা, আজীবন ওরা সম্মতি আর অসম্মতির পার্থক্য হাটে ঘাটে মাঠের মেয়েকে শিখিয়েছে, ছেলেদের শিখিয়েছে। এ নিয়ে সবসময়ই একই ভাবনা সংগঠনের সবার। আজ হঠাৎ এ কোন মানসিক ভাবনা? তখন ঘোরে থাকলেও নীলার স্পষ্ট মনে আছে, নীলা প্রতিবারই না না করছিল। মৃধা জানায়, মেয়েরা ভালো লাগলেও না না করে। এ তেমনই ভেবেছিল। নীলার অবাক লাগে। মৃধা নীলাকে চেনে। ও আট দশটা মেয়ের মতো আটপৌঢ়ে মন নিয়ে চলে না। সম্মতি থাকলে নীলা ‘না’ শব্দটা কেন বলবে?

একসময় নীলা দেখে প্রত্যেকেই নীলাকে বোঝাবার চেষ্টা করছে। মামলা না করার পরামর্শ দিচ্ছে। কারণ এতে নীলার অসম্মান যেমন হবে, তেমনই সংগঠনও প্রশ্নের মাঝে পড়বে। বিশেষ করে, নাহিদ আপা নীলাকে বাস্তবতা বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকলো বেশি করে। কারণ তার বাড়িতে এ ঘটনা। সে এলকোহল আর গাজা এলাউ করেছে শুনলে সংগঠনে বড় ঝামেলা তৈরি হবে। নীলা ছিটকে সেদিন ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। সাহস পায়নি পরে মামলা করতে। কিন্তু কতটা ক্ষত নিয়ে ওর প্রতিটি দিন রাত কাটাতে হয়েছিল, তা কেবল নীলাই জানে!

অন্ধকারে নীলার চোখ জ্বলতে থাকে। লড়বে মেয়েটার জন্য। প্রাণ দিয়ে লড়বে। মামলায় ওর জিততেই হবে। নাহয় মেয়েগুলোকে যুগের পর যুগ শুনতে হবে – ‘ না মানেই হ্যা’ !  এ হতে দেয়া যায় না। কিছুতেই যায় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *