November 24, 2024
কলামফিচার ২

বাংলাদেশে গবেষক-লেখক-চিন্তক সমাজে নারীর অবস্থান

অপর্ণা হাওলাদার ।। প্রায় সারা দুনিয়ার অন্য সব জায়গার মতই বাংলাদেশেও ইন্টেলেকচুয়াল জগতে নারীর সংখ্যা খুবই সামান্য। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে যেসব নারীর নাম শোনা গেছে গবেষণা এবং অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে,  তাদের মধ্যেও অনেকেই বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা মানুষ নন। উদাহরণের মধ্যে পড়বেন হামিদা হোসেন কিংবা সালমা সোবহান। এর বাইরে রওনক জাহানসহ অনেকেই দেশের বাইরে আছেন বহুকাল। দেশের মধ্যে অ্যাকটিভিস্টদের মধ্যে নারীবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কিছু নাম আছে। কিন্তু এর বাইরে উচ্চতর শিক্ষা, স্কলারলি কাজ, গবেষণা, চিন্তায় নারীর সংখ্যা আজকেও নগণ্য। গুণগত মানের দিক থেকেও বেশ পেছনে। দেশের সাহিত্য লেখকদের তালিকার মধ্যেও নারীদের সংখ্যা নগণ্য। গুণগত বিষয়ে আপাতত যাওয়ার প্রয়োজন নেই, কেবল প্রতিনিধিত্ব বিচারে অর্ধেক জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় কেউ না থাকা দেশের সার্বিক মঙ্গলের জন্যই বড় বাধা। এই প্রবন্ধে আমি মূলত উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণায় নারীর অবস্থানের পেছনের বাধাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছি।

গবেষণায় নারীর সংখ্যা নগণ্য হওয়ার পেছনে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কিছু বিশেষ কারণ আছে। কারণগুলোর মূল পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে প্রোথিত, এবং অনেক সময়েই সহজ চোখে পড়ার কথা না। যেমন, একজন উচু মানের গবেষকের জীবনকাহিনী জানলে দেখা যাবে কী ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশের মধ্যে তাদের শৈশব – কৈশোর কেটেছে। প্রফেসর বদরুদ্দিন উমরের শৈশব থেকে তাঁর পিতা এবং পিতৃবন্ধুদের সান্নিধ্য এবং মেন্টরিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, যেমন তিনি লিখেছেন তাঁর জীবনীতে। মেন্টরিং এর ভূমিকা, আশেপাশের পরিবেশের ভূমিকা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের ক্ষেত্রে প্রচন্ড জরুরি। এই ভূমিকা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় সর্বক্ষেত্রেই পালনে অক্ষম। আমাদের তাই স্কুল-কলেজে ফলাফলের ক্ষেত্রে অনেক মেয়েই ভালো ফল করলেও পরবর্তীতে গবেষণাক্ষেত্রে তেমন নাম দেখা যায় না।

শৈশব থেকে আমাদের পরিবারব্যবস্থায় ছেলে আর মেয়েদের প্রতিপালনে পার্থক্য অনেক। তার মধ্যে একটা বড় ব্যাপার হলো মেয়েদের নিয়মতান্ত্রিক ভালো হওয়ার পরীক্ষায় প্রশ্ন করাকে খুব খারাপ চোখে দেখা হয়। পাড়াভিত্তিক বইপড়ুয়াদের সাথেও মেয়েদের তুলনামূলক সংযোগ কম। বাড়ির ভেতর থেকে নিজেকে তৈরি করতে প্রতিষ্ঠিত সিলেবাসে মুখ গুঁজে দেওয়া ছাড়া মেয়েদের হাতে উপায় থাকে না। বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে আগ্রহী মানুষদের সাথে নিয়মিত সংযোগ না হলে জানার প্রতি আগ্রহ তৈরি হওয়া সম্ভব, কিন্তু সহজ নয়। সামাজিক চাপে একটি মেয়ে “ভালো” হতে আমাদের সমাজে নম্র হতে হয়, প্রশ্নহীন হতে হয়, কোমলতার পরীক্ষা দিয়ে চলতে হয়। অন্যদিকে, প্রশ্ন না করে, কৌতূহলী না হলে স্কলার হওয়া সম্ভব না। একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে নারীর রেজাল্ট যত ভালো দেখা যায়, জানার গভীরতা তত বেশি দেখা যায় না। প্রশ্ন করার সাহস এবং স্বাধীনতা তত গভীর দেখা যায় না।

সামাজিক আরেকটি সমস্যা হলো, যে সময়টা একজনের নিজেকে স্কলার হয়ে তৈরি হওয়ার কথা তখন পারিবারিকভাবে বিয়ের চাপ জীবনকে অতিষ্ঠ করে ফেলে। আমাদের দেশে নারীদের অনার্স শুরুর সময় থেকেই চাপ দেওয়া হয় বিয়ের জন্য। আবার, অন্যদিকে, দেশে আমাদের নিজস্ব গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলতে কিছুই তেমন নেই। ট্রেনিং এর জন্য দেশের বাইরে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা প্রচন্ড বাধার মুখোমুখি হন। সামাজিকভাবে কেবল বিয়ের উপর এত জোর দেওয়া এবং দেশে উচ্চতর শিক্ষার  প্রতিষ্ঠান না থাকা একইসাথে অনেক নারীর উচ্চশিক্ষার স্বপ্নকে নষ্ট করে দেয়।

বুদ্ধিবৃত্তিক, গবেষণাভিত্তিক কাজগুলো অনেকটাই গুরুবাদী। গুরু বলতে বোঝাচ্ছি যেমন আহমদ ছফা তাঁর “যদ্যপি আমার গুরু” বইতে লিখেছেন প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক সম্বন্ধে। একজন মেন্টর যিনি প্রয়োজনমত গাইডেন্স দেওয়া, রেফারেন্স রিসোর্স দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের বেশিরভাগ ক্লাসই এখন নেন লেকচারাররা। আমার নিজের আন্ডারগ্র্যাডে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ শিক্ষকের নিজের পিএইচডি ছিল না। ভালো শিক্ষক হওয়ার জন্য পিএইচডি জরুরি, এমন নয়। প্রফেসর রাজ্জাক পিএইচডি ইচ্ছে করেই শেষ করেন নি। কিন্তু সেই কথা আমাদের আজকালকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে সত্য নয়। লেকচারার মানে তাঁরা নিজেরাই এখনো ঠিকঠাক রিসার্চে এক্সপোজার পাননি। লেকচারাররা কিছু টেকনিক্যাল বিষয় পড়াতে সমর্থ হলেও, তাদের পক্ষে গভীরতর গাইডেন্স দেওয়া প্রায় অসম্ভব। এর উপরে নারীদের জন্য সমস্যা হলো, আমাদের নারী শিক্ষকদের সংখ্যা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খুবই কম। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য মেন্টর পাওয়া প্রায় অসম্ভব তাই।

সমাধানের অনেক উপায় নিয়ে কথা বলা যায়। কিন্তু আমি বিশেষ একটি কথায় জোর দিতে চাই। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মেন্টরিং, প্রয়োজনে টিউটোরিয়াল গ্রুপ করে অ্যাডভাইজিং এর প্রয়োজন। অ্যাডভাইজার-স্টুডেন্ট পার্সোনাল রিলেশনশিপ গড়ে তোলার মাধ্যমে আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের গবেষণামূলক কাজে আগ্রহী করতে পারি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসমতা কমানোর জন্য সেমিনারভিত্তিক ক্লাস পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। সামাজিক যেসব বাধার মধ্যে থেকে নারীদের যেতে হয়, সেই বাধাগুলো বুঝতে পারলে আমাদের পক্ষে তা সমাধানও সম্ভব হবে। আমাদের নারী শিক্ষার্থীরা তাদের পুরুষ সহপাঠীদের তুলনায় অন্তর্মুখী। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্মুখী শিক্ষার্থীদের সাথে সংযোগের অনেক উপায় বের করা হয়েছে। যেমন নিয়মিত পেপার লিখতে দেওয়া যাতে অন্তর্মুখী ছাত্ররাও তাদের ধারণাগুলো লিখে জানাতে পারে। ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরির মধ্যে দিয়ে অন্তর্মুখী ছাত্রদের উৎসাহিত করা যায় বক্তব্য উপস্থাপনে।

বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ বৈচিত্র্য প্রায় নেই বললেই চলে। উচ্চতর গবেষণায়, চিন্তাজগতে বৈচিত্র্য আনতে সমাজের সব অংশের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। আর এই জন্য দরকার স্কুল-কলেজ থেকেই নারীদের তৈরি করা যাতে সামাজিক বা পারিবারিক কারণে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের জন্য প্রস্তুতিতে বাধাগুলো অতিক্রম করা সম্ভব হয়।

অপর্ণা হাওলাদার : পোস্টডকটরাল ফেলো, ইউনিভার্সিটি অফ রোড আইল্যান্ড, ইউএসএ

 

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *