November 21, 2024
সাহিত্যবই নিয়ে আলাপ

নারীর ভাগ্যজয়ের অধিকার: অনুবাদ-সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন

আলম খোরশেদ ।। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের রক্ষশীল ইংল্যান্ডে এক আশ্চর্য মেধাবী, অগ্রসর ও মৌলিক চিন্তার অধিকারী, নির্ভীক নারীর আবির্ভাব হয়েছিল। স্বশিক্ষিত এই নারী তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে অগ্রসর চিন্তাভাবনা, প্রথাবিরোধী জীবনযাপন, সর্বোপরি স্বতন্ত্র ও সাহসী লেখনীর মাধ্যমে তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে এমন আঘাত ও আলোড়িত করেছিলেন যে, জনৈক প্রবীণ রাজনীতিবিদ তাঁকে ‘পেটিকোট পরিহিত হায়না’র সঙ্গে পর্যন্ত তুলনা করেছিলেন! হ্যাঁ,আপনারা ঠিকই আন্দাজ করেছেন, আমি মেরি উলস্টোনক্রাফট (১৭৫৯-১৭৯৭) এর কথাই বলছি, যিনি সেই আমলেই একজন পেশাদার সাহিত্যিক ছিলেন, তা-ও আবার সস্তা, বাজারি লেখা নয়; রীতিমতো মননশীল, চিন্তামূলক, দার্শনিক প্রবন্ধ রচনাই ছিল তাঁর সৃজনশীলতার প্রধান ক্ষেত্র। তাঁর সেসব রচনা থেকে অন্তত একটি বই কালের ব্যবধান ও বৈরিতাকে ঘুচিয়ে দিয়ে অমরত্ব লাভ করেছে এবং বর্তমান বিশ্বের বৌদ্ধিক তৎপরতা ও চিন্তারাজ্যে একটি অপরিহার্য ধ্রুপদী গ্রন্থের গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। গ্রন্থটির নাম A Vindication of the Rights of Woman, যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৯২ সালে ফরাসি বিপ্লবের ঠিক তিন বছর পর এবং যার সঙ্গে ফরাসি বিপ্লবের একটি যোগসূত্রও ছিল বৈকি।

বিপ্লবের বছরখানেক পর ফ্রান্সের নবগঠিত সংসদে রাজনীতিবিদ Charles Maurice মেয়েদের শিক্ষা বিষয়ে যে প্রতিবেদন পেশ করেন মূলত তারই প্রতিবাদে অপরিসীম পরিশ্রম করে মাত্র ছয় মাসের মধ্যে মেরি এই মহাগ্রন্থটি লিখে শেষ করেন। তিনি এতে তীব্র ভাষায় সেই চরম পুরুষতান্ত্রিক প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করেন এবং জোর গলায় দাবি করেন যে, সমাজে নারী ও পুরুষের একই রকম শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে এবং সেটি সমাজের সার্বিক মঙ্গল, বিশেষ করে পুরুষদের কল্যাণের জন্যও বটে। তিনি এর সপক্ষে নানারকম জোরালো যুক্তি ও তথ্য উপস্থাপন করেন এবং আরও এক ধাপ এগিয়ে এমনকি নারী-পুরুষের সমানাধিকার পর্যন্ত দাবি করেন। এর পাশাপাশি তিনি এমন সিদ্ধান্ত টানতেও পিছপা হন না যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে গৌন কিছু দৈহিক প্রভেদ ছাড়া তেমন কোনো লক্ষণীয়,গুরুতর পার্থক্য নেই এবং তা থাকা কাম্যও নয়। সমাজ এবং বিশেষ করে পুরুষনির্মিত এইসব প্রভেদমন্ত্র এবং তজ্জনিত বৈষম্য ও পীড়নের অবসানকল্পে তিনি নারী-পুরুষের একই রকম সুযোগ ও শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তবে নারীর শিক্ষা বিষয়ে তাঁর এমন ভাবনা নতুন কিছু নয়, এর কয়েকবছর আগে ১৭৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গ্রন্থ Thoughts on the Education of Daughters এর প্রধান উপজীব্যও ছিল মূলত নারীর শিক্ষা ও আলোকায়ন।

অথচ বিস্ময়কর ও অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এরকম একটি যুগান্তকারী, সুগভীর তাৎপর্যপূর্ণ, আজও সমান প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় গ্রন্থের এতদিন কোনো বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়নি, না বাংলাদেশে না আমাদের প্রতিবেশী দেশে। পরম আনন্দের কথা, সম্প্রতি আমাদের এই সম্মিলিত লজ্জার অপনোদন ঘটিয়েছেন ইংরেজি সাহিত্যের সুখ্যাত অধ্যাপক ও অনুবাদক মোবাশ্বেরা খানম, নারীর ভাগ্যজয়ের অধিকার নামে এই কালজয়ী বইটির একটি বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করে। এর আগে তিনি আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের বিদেশিনী শিক্ষক মিস এ. জি. স্টকের স্মৃতিকথা এবং উইনিফ্রেড হল্টবির বিখ্যাত গ্রন্থ Women and a Changing Civilization। আলোচ্য গ্রন্থটি গত বছর বইমেলাতে প্রকাশিত হলেও, করোনাকালীন অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কবলে পড়ে বোধগম্য কারণেই তার তেমন প্রচার প্রসার হয়নি। তা নইলে এমন একটি অমর বিশ্বক্লাসিকের বাংলাভাষায় অনূদিত হবার ঘটনাটি, তা-ও আবার প্রথমবারের মতো, সঙ্গত কারণেই আমাদের প্রকাশনাশিল্পের একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হিসাবে স্বীকৃত ও উদযাপিত হবার কথা ছিল। আমাদের সেই অক্ষমতার প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপই বলা যেতে পারে এই নিবন্ধটির অবতারণা। তবে বলাই বাহুল্য, বর্তমান আলোচনাটি এই গ্রন্থের কোনো চুলচেরা রিভিউ কিংবা বিদ্যায়তনিক বিশ্লেষণ – এর কোনোটাই নয়। এর উদ্দেশ্য মূলত দ্বিবিধ। প্রথমত অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে, প্রায় ছয় বছরের নিরলস পরিশ্রমে এমন একটি দুরূহ কর্ম সম্পাদন করে বাংলা অনুবাদ ও চিন্তামূলক সাহিত্যের অঙ্গনটিকে সমৃদ্ধতর করে তোলার জন্য অনুবাদককে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জ্ঞাপন। দ্বিতীয়ত বইটির প্রতি সচেতন পাঠকদের, বিশেষ করে নারীবাদ, নারীমুক্তি ও নারীপ্রশ্ন বিষয়ে আগ্রহী পাঠক, গবেষক ও শিক্ষার্থীদের সপ্রেম মনোযোগ আকর্ষণ করা।

মোবাশ্বেরা খানম যে এই বইটি অনুবাদ করার কথা আদৌ ভেবেছেন এবং তাঁর সেই ভাবনাকে সত্যি সত্যি কর্মে পরিণত করেছেন সেই জন্য তাঁর প্রতি আমাদের ঋণের কোনো শেষ নেই, তাঁকে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও টুপিখোলা অভিনন্দন। সকলেই স্বীকার করবেন, এই কাজটি মোটেও সহজ কোনো কর্ম ছিল না; যেটি করার কথা ছিল একটি প্রতিষ্ঠানের, সেটি তিনি একা হাতে সম্পন্ন করেছেন, এটি চাট্টিখানি কথা নয়। বিশেষ করে যেখানে দুই আড়াইশো বছর আগের প্রাচীন ও জটিল ইংরেজি ভাষাকে যুগোপযোগী করে তোলা, এবং মূল লেখিকার ততোধিক জটিল চিন্তাপ্রণালীকে সহজ ও সর্বজনবোধ্য বাংলায় অনুবাদ করার কাজটি রীতিমতো একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই চ্যালেঞ্জ তিনি সপাটে গ্রহণ করেছেন সেটিই আমাদের কাছে বড় কথা, সেটা কতটা উৎরাতে পেরেছেন তিনি তা নির্ধারণ করবেন উপযুক্ত বিশেষজ্ঞবৃন্দ। আমার বলার কথা এটুকুই যে, তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করেছেন বইয়ের জটিল বক্তব্যকে সহজ ভাষায় ও ভঙ্গিতে পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করতে। এর জন্য তিনি সবসময় মূলের প্রতি অন্ধ আনুগত্যেরও তেমন প্রয়োজন বোধ করেননি। যখন দরকার মনে করেছেন, লেখিকার জটিল ভাষারীতি, দীর্ঘ বাক্যবিন্যাস, অপ্রচলিত শব্দবন্ধের প্রয়োগ ইত্যাদিকে ভেঙে বাংলা ভাষার রীতি ও স্বধর্মমাফিক আত্মীকৃত করে নিয়েছেন। উদ্দেশ্য একটাই: মূল লেখিকার ভাবনা, বক্তব্য, যুক্তিকাঠামো ইত্যাদিকে যতটা সম্ভব সহজ ও বোধগম্য করে পাঠকের কাছে হাজির করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই কাজে তিনি সফল হয়েছেন সন্দেহ নেই, যদিও বইটি সর্বাংশে সুখপাঠ্য, সুবোধ্য ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পেরেছে তেমনটা হয়তো জোর গলায় বলা যাবে না। এর জন্য অবশ্য প্রকাশকের দায়ভাগটাই বেশি বলে মনে হয়। কেননা এই বইটিকে ঠিক সেভাবে সম্পাদনা করা হয়েছে বলে মনে হয়নি, যেকারণে বাক্য, বানান, ব্যাকরণ এবং অন্যবিধ ত্রুটির পরিমাণ নেহাৎ অনুল্লেখ্য নয়, যা এর পাঠযোগ্যতাকে অনেকটা খর্ব করে। পাশাপাশি বইয়ের মূল বক্তব্যসমূহকে পাঠকসমীপে সঠিকভাবে উপস্থাপিত হওয়ার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট বিঘ্ন সৃষ্টি করে। আমরা আশা করব, পরবর্তী সংস্করণে সঠিক সম্পাদনার মাধ্যমে এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে এবং গ্রন্থটি তার উপযুক্ত আবেদন ও গুরুত্বসমেত বৃহত্তর পাঠকসমাজের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হবে।

এখানে উল্লেখ্য, বইটির প্রকাশক বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনা সংস্থা সুবর্ণ, যার কর্ণধার আহমেদ মাহফুজুল হকের ঐকান্তিক আগ্রহ ও উদ্যোগেই মূলত গ্রন্থটি অনূদিত ও প্রকাশিত হতে পেরেছে শেষ পর্যন্ত। যদিও পরম পরিতাপের বিষয়, বইটিকে স্বচক্ষে দেখে যাবার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি; এর আগেই নিষ্ঠুর অতিমারি তাঁকে কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল এই ধরণীর বুক থেকে। বাংলা ভাষা, গ্রন্থপ্রকাশনা ও জ্ঞানচর্চার এই পরম সুহৃদকে নিবন্ধের উপসংহারে তাই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। সেই সঙ্গে, তাঁর অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করে বইটিকে অবশেষে পাঠকের হাতে তুলে দেবার জন্য প্রাণঢালা ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করছি তাঁর সুযোগ্য জীবনসঙ্গিনী ও কন্যাকেও। অনুবাদক মোবাশ্বেরা খানমকে পুনর্বার অভিনন্দন ও অভিবাদন জানাই চিন্তাপৃথিবীর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সময়োপযোগী ও মূল্যবান গ্রন্থের বাংলা অনুবাদের কাজে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করার জন্য। আর সবশেষে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি নারীর সমানাধিকার, সম্মান, ক্ষমতায়ন ও মুক্তিসংগ্রামের অগ্রসেনানী, এই গ্রন্থের জননী মহীয়সী মেরি উলস্টোনক্রাফটকে, ১৭৯৭ সালে এক কন্যার (যিনি পরবর্তীকালে আরেক ধ্রুপদী গ্রন্থ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন এর রচয়িতা এবং অকালপ্রয়াত কবি পার্সি বিশি শেলির পত্নী মেরি উলস্টোনক্রাফট শেলি নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন) জন্ম দিতে গিয়ে যাঁর জীবনাবসান ঘটে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে। নারীর ভাগ্যজয়ের অধিকার বইটির বহুল প্রচার, প্রসার ও পাঠকপ্রিয়তা কামনা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *