May 15, 2024
ইতিহাসসাহিত্যফিচার ৩

নারীর ভোটের অধিকার আদায়ে এমেলিন পাংকহার্স্টের লড়াই

কারিন আশরাফ ।।

 

কে ছিলেন এমেলিন?

এমেলিন পাংকহার্স্ট ইংল্যান্ডের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি সারাজীবন কাজ করে গেছেন নারীর ভোটাধিকার আদায়ে। তার অসংখ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে ছিল “উইমেনস সোশ্যাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল ইউনিয়ন” প্রতিষ্ঠা করা। এই রাজনৈতিক পার্টির সশস্ত্র বিভিন্ন কলাকৌশল নানাভাবে সমালোচিত হলেও তা ব্রিটিশ নারীদের ভোটাধিকার আদায়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৮৫৮ সালে ম্যানচেস্টারে জন্মানো এই তুখোড় নারীমুক্তি আন্দোলনকারীর ঘটনাবহুল জীবন আজকের আলোচ্য বিষয়।

প্রেক্ষাপট

গ্রেট ব্রিটেন ছিল পৃথিবীর একেবারে প্রথম দিককার একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু প্রাচীন গ্রিসের মতই ব্রিটেনেও বিশ শতকের আগে নারীদের মেলেনি ভোটাধিকার। মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট ১৭৯২ সালেই নারীর ভোটের অধিকারের কথা তুলে ধরেছিলেন তার বইতে। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের বুদ্ধিজীবীরাও এই দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে শুরু করেন, গঠিত হয় নানা “সাফ্রেজ সোসাইটি”। সাফ্রেজ সোসাইটি হলো নারীর ভোটাধিকার আদায়ের উদ্দেশ্যে গঠিত সংঘ। ১৮৭০ সালে সংসদে নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে প্রায় তিরিশ লক্ষ স্বাক্ষরসহ একটি পিটিশন জমা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিবারই পার্লামেন্টের সদস্যরা নাকচ করে দেন সংগঠনগুলোর দাবি।

এমেলিনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড

এমেলিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন একটি প্রগতিমনা পরিবারে। তার মা-বাবা দুজনেই নারীর ভোটাধিকার তথা সাফ্রেজ সমর্থন করতেন। তিনিও বড় হয়ে এসব সংগঠনের সক্রিয় সদস্য হন। ১৮৮৯ সালে তিনি ও তার স্বামী রিচার্ড পাংকহার্স্ট প্রতিষ্ঠা করেন ‘উইমেনস ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ’। এই দলটি বিবাহিত ও অবিবাহিত নারী সবার জন্যই ভোটাধিকার দাবি করে। এছাড়াও বিবাহবিচ্ছেদ ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারীর সম-অধিকারের জন্য তারা কাজ করতেন। এজন্য দলটিকে ‘চরমপন্থি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এক বছরের মাথায় দলটি ভেঙে যায়।

পরবর্তীতে এমেলিন ইনডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টিতে যোগদান করেন ও সেখানে গরিবদের দেখাশোনার কাজ করেন। ১৯০৩ সালে তিনি লেবার পার্টি ত্যাগ করেন, কেননা দলটি “নারীর জন্য ভোট”কে গুরুত্ব দিতে চায়নি। তিনি বুঝতে পারেন যে, বছরের পর বছর বক্তৃতা আর এমপিদের কাছ থেকে ফাঁকা প্রতিশ্রুতি তাদের লক্ষ্য হাসিল করবে না। সেজন্য তিনি নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন ‘উইমেনস সোশ্যাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল ইউনিয়ন’, এই সংগঠনটি ছিল শুধু নারীদের জন্য উন্মুক্ত। তাদের স্লোগান ছিল, “কথা নয়, কাজ।”

সংগঠনটি বিভিন্ন র‍্যালি, বক্তৃতার আয়োজন করত। তাদের একটি নিজস্ব নিউজ লেটার ছিল, যার নাম ছিল “ভোটস ফর উইমেন”। ধীরে ধীরে তাদের কর্মকাণ্ড কিছুটা সহিংস হয়ে ওঠে। এমেলিনের তিন মেয়েই সংগঠনে সক্রিয় ছিলেন। তারা সবাই কোনো না কোনো কারণে, যেমন নিয়ম ভাঙা, প্রধানমন্ত্রীর জানালায় ঢিল ছোঁড়া ইত্যাদি কারণে গ্রেপ্তার হন। এমেলিন ১৯০৮ সাল থেকে শুরু করে মোট সাতবার গ্রেপ্তার হন। ১৯০৯ সালে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে একজন পুলিশ কর্মকর্তার মুখে আঘাত করেন, যাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার মতে, গ্রেপ্তার হওয়ার মাধ্যমে নারীর ভোটাধিকারের গুরুত্বটা আরো বেশি প্রকট হয়ে উঠবে। তিনি একবার আদালতে বলেছিলেন,

“আমরা এখানে আইন ভাঙতে নয়, আইন গড়তে এসেছি।”

জেলের থাকা খাওয়ার শোচনীয় অবস্থার প্রতিবাদে এমেলিন ও তার সহকর্মীরা অনশন করেন। জেল কর্তৃপক্ষ জোর করে নল দিয়ে তাদের খাওয়ানোর চেষ্টা করে, যা ছিল খুবই কষ্টদায়ক।

ব্রিটিশ একটি পত্রিকা তাদের চরমপন্থি কার্যক্রমকে ব্যঙ্গ করে তাদের “সাফ্রেজেট” বলে অভিহিত করেছিল। যারা নারীর ভোটাধিকার সমর্থন করত তাদের সাফ্রেজিস্ট বলা হত, আর তারই বিকৃত একটি শব্দভেদ ছিল এটি। এতে মোটেও বিচলিত না হয়ে এমেলিন পাংকহার্স্ট লুফে নেন শব্দটিকে এবং নিজেদের পরিচয় দিতে শুরু করেন সাফ্রেজেট হিসেবে।

ব্ল্যাক ফ্রাইডে ও অন্যান্য

১৯১০ সালের নির্বাচনের পরে পুনরায় একটি বিল পেশ করা হয়, যা আবারও নাকচ হয়ে যায়। এমেলিন তখন ৩শ’ এরও বেশি নারীকে নিয়ে একটি মিছিল করেন। এই মিছিলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের আদেশে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের আক্রমণ করে। ১৯১০ সালের ১৮ই নভেম্বরের দিনটিকে ব্ল্যাক ফ্রাইডে হিসেবে স্মরণ করা হয়। এই দিন এমেলিনের বোনকে গ্রেপ্তার করা হয় ও একমাসের জন্য জেলে পাঠানো হয়। জেল থেকে ছাড়া পাবার দুদিন পরেই তিনি মারা যান।

১৯১২ সাল থেকে দলটির সদস্যরা অগ্নিসংযোগকে প্রতিবাদের একটি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা শুরু করেন। এমেলিন পাংকহার্স্ট এই পদ্ধতি ব্যবহারের নির্দেশ না দিলেও তিনি একে সমর্থন করতেন। ১৯১৩ সালে একজন সাফ্রেজেট রাজার ঘোড়ার সামনে ঝাঁপ দিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করেন। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় লোকসমাগম হয়েছিল পঞ্চান্ন হাজারেরও বেশি। এসব ঘটনা নারীর ভোটাধিকারের পক্ষে আরো বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে মানুষের।

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এমেলিন তাদের কার্যক্রম স্থগিত রাখেন।

সাফল্য

১৯১৮ সালে পার্লামেন্ট ত্রিশোর্ধ্ব নারীদের জন্য ভোট দেওয়ার অনুমতি দেয়। ১৯১৭ সালেই এমেলিনের দলের নাম বদলে ‘উইমেনস পার্টি’ রাখা হয়। তার দলটি তখন নারী-পুরুষের সমান কাজের সুযোগ, সমান বেতন ইত্যাদি দাবি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছিল। ১৯২৮ সালে নারীর ভোটের বয়স পুরুষদের সমান তথা একুশ করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এর মাত্র কিছুদিন আগে এমেলিন পাংকহার্স্ট মারা যান।

সমালোচনা

এমেলিনের অতীব উগ্র কর্মপদ্ধতি সবাই সমর্থন করেননি। এমনকি তার নিজের দুই কন্যাই পরবর্তীতে দল ছেড়ে চলে যান। এমেলিন ছিলেন অত্যন্ত জাতীয়তাবাদী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি সময় কাটিয়েছিলেন পুরুষদের যুদ্ধে যেতে আর নারীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে উদ্বুদ্ধ করে। তার এই দুই মেয়ে আবার যুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন। তারা মনে করতেন যুদ্ধের মাধ্যমে পুঁজিবাদ লাভবান হয় আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষ। এসব নিয়ে তাদের মায়ের সঙ্গে মতবিরোধ ছিল।

এছাড়াও এমেলিন বিশ্বাস করতেন যে, অন্যান্য জাতির উপর ব্রিটিশদের প্রভুত্ব রয়েছে। তার মতে, “সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অনেকে কথা বলেন, তাদের আচরণ এমন যেন এটি কোন লজ্জিত হওয়ার মত ব্যাপার!”

ঐতিহাসিকদের মতে, এমেলিন পাংকহার্স্ট ও তার সংগঠনের অবদান এককভাবে নারীর ভোটাধিকার অর্জন করেনি। তবে পুরো আন্দোলনে তাদের ব্যাপক ভূমিকা ছিল।

শেষ কথা

এমেলিনের বর্ণাঢ্য কর্মমুখর জীবন প্রতিবাদ, ত্যাগ আর দৃঢ়তার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। নারীবাদের ইতিহাস পর্যালোচনায় তার জীবন আর অবদান সম্পর্কে জানাটা অপরিহার্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *