প্রকৃতি ও নারীর উপর পুরুষতান্ত্রিক হানার বিরুদ্ধে ইকোফেমিনিজম
কাজী নাজিফা লামিনূর ।।
আজকের পৃথিবীতে প্রকৃতি ও পরিবেশ যে হুমকির মুখে পড়েছে তা নিশ্চয়ই এড়ানোর উপায় নেই। মাটি, পানি, গাছপালা ও পুরো জলবায়ুর ওপর এমন বিরূপ প্রভাব কিন্তু একদিনের ফলাফল নয়। দিনের পর দিন প্রকৃতির ওপর নির্যাতন, পরিবেশকে নিজের ভোগের সামগ্রী ভেবে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করার ফলেই আজ আমরা মাশুল গুনছি। একইভাবে যদি লক্ষ্য করি, সামাজিক, পারিবারিক, রাজনৈতিকসহ সমস্ত ক্ষেত্রে নারীর প্রতিও সহিংসতা দিনে দিনে বাড়ছে। এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। অর্থাৎ নারীকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা, তাদের দুর্বল মনে করে পুরুষের প্রভুত্ব কায়েম করা ইত্যাদি। এখানে দেখা যায় যে পরিবেশ ও নারী উভয়েই পুরুষতন্ত্রের ভয়াল থাবার শিকার। নিজেকে উত্তম ও অপরকে অধম মনে করে নিজ স্বার্থ উদ্ধারের মনোভাব থেকেই নারী ও পরিবেশের প্রতি মানুষের এমন আচরণ প্রকাশ পায়।
আমরা জানি, নারীবাদের মূল বাণী হলো সমতা। এবং এই সমতা লিঙ্গ, জাতি, বর্ণ, শ্রেণিসহ পরিবেশকেও অন্তর্ভূক্ত করে। কারণ মানুষ পরিবেশেরই অংশ। এবং পরিবেশের সাথে মানুষের সম্পর্ক ঘনিষ্টতর। সুতরাং পরিবেশকে শুধুমাত্র নিজের ভোগবস্তু ভাবার কোনো কারণ নেই। অন্যদিকে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক প্রভুত্ব-দাসত্বের নয় বরং সমান্তরাল। এই দুটি বিষয়কে আরো পরিষ্কারভাবে আলোচনার জন্য নারীবাদের একটি স্বতন্ত্র অংশ গঠিত হয়েছে যাকে বলা হয় পরিবেশ-নারীবাদ বা ইকোফেমিনিজম। এখানে বিশ্বাস করা হয় প্রকৃতির সাথে নারীর সম্পর্ক চিরন্তন। মূলত নারীর উপর পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য ও শোষণের বিভিন্ন দিক এবং প্রকৃতির উপর মানুষের দমন, উৎপীড়নের চিত্র তুলে ধরাই পরিবেশ-নারীবাদের উদ্দেশ্য।
১৯৭০-৮০ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম পরিবেশ-নারীবাদ নিয়ে আলোচলা শুরু হয়। তখন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে সচেতনতামূলক প্রচারণা চলছিল। তৎকালীন নারীবাদীরা পরিবেশের উপর অত্যাচার ও নারীর প্রতি সহিংসতা এই বিষয় দুটিকে পাশাপাশি রেখে পর্যালোচনা করেন। শুরু হয় পরিবেশ-নারীবাদ দর্শনের চর্চা। ফ্রাসোয়াঁ দ্যুবন থেকে শুরু করে ক্যারেন জে. ওয়ারেন, ভাল প্লামউড, মারে বুকচিন, জিম চেনি, বন্দনা শিবা, মারিয়া মাইজ প্রমুখ লেখক ইতোমধ্যে পরিবেশ নারীবাদের প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত। যদিও তাদের মতামত ও তত্ত্বের মধ্যে মিল-অমিল রয়েছে। তবুও তাদের দর্শনের অভিন্ন জায়গাটি হলো পিতৃতন্ত্রের বিরোধীতা, যে পিতৃতন্ত্র প্রকৃতি ও নারী উভয়কে দাস মনে করে এবং শোষণের মাধ্যমে কতৃত্ব স্থাপন করতে চায়। নারীবাদী সুসান ব্রাউনমিলার প্রথম দেখান যে আধুনিক হ্রাসবাদী বিজ্ঞান কিভাবে প্রকৃতির ধ্বংস ডেকে আনছে। প্রকৃতির উপর বিজ্ঞানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকে পুরুষ দ্বারা নারীকে ধর্ষণ-প্রক্রিয়ার সাথে তুলনা করেছেন তিনি। আজকের দিনে আমাদের হাতে প্রযুক্তির কাছ থেকে পাওয়া সকল সুবিধাই রয়েছে। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির নানা আধুনিক উপায় রপ্ত করেছি আমরা। কিন্তু উৎপাদন বাড়ানোর ছলে ভূমির যে ক্ষয় হয় তা রোধের উপায় আমরা ভাবিনা। অর্থাৎ একতরফাভাবে প্রকৃতি থেকে শুধু নিয়েই যাচ্ছি, অন্যদিকে প্রকৃতিকে রক্ষণাবেক্ষনের সমস্ত দায়ভার এড়িয়ে যাচ্ছি। গ্রামীণ এলাকায় তামাক চাষ নিয়মিত ঘটনা। তামাক চাষের অন্যতম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো তা নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়। অথচ এই বিষয়টি সবসময়ই উপেক্ষিত। এমনকি এর বিরুদ্ধে সচেতনতাও গড়ে ওঠেনি। আসলে দরিদ্র সমাজে নারীস্বাস্থ্য নিয়ে পুরুষতন্ত্রের কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে আসল কথা হলো ক্ষতিকর চাষাবাদ ব্যবস্থা নারী নির্যাতনের আরেক রূপ।
এ তো গেল কৃষির প্রসঙ্গ। প্রকৃতির উপর আরো অগণিত অত্যাচার আমাদের চোখের সামনেই ঘটে চলেছে। বৃক্ষনিধন, পলিথিন-প্লাস্টিকের ব্যবহার, নদীভরাট ইত্যাদি কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে মানুষ বোঝাতে চায় প্রকৃতিকে খেয়ালখুশি মতো ব্যবহার করার ক্ষমতা তার আছে। আবার আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোও তেমন বার্তাই প্রকাশ করে যেন নারীর প্রতি বিরূপ আচরণ করার অধিকার পুরুষের আছে। প্রকৃতিগত কারণে নারী পুনরুৎপাদনে অংশ নেয়। এখানেই প্রকৃতির সাথে তার মিল। ভারতীয় নারীবাদী বন্দনা শিবা ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ‘The Seed and the Earth: Women, Ecology and Biotechnology’ প্রবন্ধে বলেন প্রকৃতির মধ্যে বীজ ও ভূমিকে বাদ দিয়ে জন্ম, বৃদ্ধি ও বিকাশ সম্ভব নয়। বীজ মাটি থেকে পরিপুষ্ট হয়ে পূর্ণতা লাভ করে, সব সৃজনশীলতা ও জীবনের উৎস এই মাটি। প্রাচীনকাল থেকে নারীরা যেভাবে সংসারের হাল ধরেন, সেখানে পরিবারের দেখভালসহ কৃষিতে বীজ রক্ষার কাজও তাদের করতে হতো। এছাড়া খাদ্য উপাদান সংগ্রহ, পশুপালন ইত্যাদি কাজের কারণে প্রকৃতির সাথে তাদের সখ্য গড়ে ওঠে। তারা বুঝতে শুরু করে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে হলে প্রকৃতিকে রক্ষা করা জরুরী। কিন্তু মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অবসানের সাথে সাথে পরিবেশের উপর শুরু হয় অবিচার। প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক কৃষিভিত্তিক সমাজের কথা উল্লেখ করে রোজ মেরি রুথার ১৯৭৫ সালে একটি মডেল প্রকাশ করেন যেখানে বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবার পরিবেশের ওপর পুরুষতান্ত্রিক হানার এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছিল।
তবে এইমুহূর্তে আমাদের জন্য আশার কথা হলো, ‘ইকোফেমিনিজম’ নিয়ে আজ কথা হচ্ছে, বিতর্ক হচ্ছে, সচেতনতা বাড়ছে; এবং তা কেবল শিক্ষিত নারীর সমাজেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং পৃথিবীর বহু প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরক্ষর ও নিরন্ন নারীদের মাঝেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে, নিজেকে রক্ষার স্বার্থেই আজ তারা পরিবেশ-নারীবাদকে সমর্থন করে। এবং তার উদাহরণ আমাদের সামনেই। দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানীর হুইল এলাকায় পারমানবিক প্ল্যান্ট স্থাপনের বিরুদ্ধে সেখানের কৃষক নারীরা যে আন্দোলন করছেন, হিমালয়ে নেপালী চিপকো আদিবাসী নারীরা বিক্ষোভ করছেন চুনাপাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে, কেনিয়ায় “সবুজবন্ধনী আন্দোলন” গড়ে তুলেছেন জাপানের সিইকাৎসু ক্লাবের নারীরা যারা এন্টি-কনসিউমারিজমের সমর্থক, ম্যানগ্রোভ অরণ্য বাঁচাতে ইকুয়েডরের দরিদ্র নারীদের সংগ্রাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাভ ক্যানালে যখন পারমানবিক বর্জ্য ফেলা হয় সেখানে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ গড়ে তোলেন লুইস গিবস নামের এক সাহসী নারী শ্রমিক এবং ভারতে নর্মদা বাঁধের বিরুদ্ধে মেধা পাটেকরের লড়াই। সুতরাং পরিবেশ-নারীবাদ তত্ত্ব জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বব্যাপী। এখন এই জায়গাকে প্রসারিত করার দায়িত্ব আমাদের। পিছিয়ে গেলে চলবেনা, অস্তিত্বের প্রয়োজনে নারী ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেকোনো অনাচার রোধে সরব হওয়া এখন সময়ের দাবী।