November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

বাসে টি-শার্ট; সমাজ কেন ক্ষেপে যায়?

সামিয়াতুল সামি ।। ক’দিন আগে বাংলাদেশের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে একটি অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে। অবশ্য ‘অস্বাভাবিক’ না বলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেটাকে ‘স্বাভাবিক’ বলাটাই মনে হয় ভাল ছিল। সে যাক, ঘটনাটা কী? ঘটনাটি হল বাসে ‘টি-শার্ট’ পরে ওঠায় একটা মেয়েকে ডিফিম করা হয়েছে। আর সেই ডিফিম কোন পুরুষ করেনি, করেছে একজন নারী। এখানেই আমি সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি উত্থাপন করতে চাই।

দেশে যে প্রচলিত মতামত ‘ধর্ষণের কারণ নারীর পোশাক’ আর সেই মতামতের যে যুক্তি যেখানে বলা হয় পুরুষ নারীর পোশাক দেখে উত্তেজিত হয় আর সে কারণেই এমন প্রবৃত্তি দেখায়। তাহলে এই যে মহিলাটি হুট করে ক্ষেপে গেলেন তিনিও কি মেয়েটির পোশাক দেখে উত্তেজিত ছিলেন? তারও কি  এই মেয়েটির ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়েছিল ? না পারাতেই কি অন্যসব পুরুষের মত করে এখানেও পোশাককে ডিফিম করেছেন? হতে পারে অবশ্য, সমকাম ব্যাপারটাকে তো একেবারে উহ্য রাখা যায়না।

কিন্তু এসবের পরও এই মহিলার কান্ড আসলে আমাদের সামনে আরেকটা উত্তর এনে দিয়েছে। সেই উত্তর হল নারীর স্বাধীনতার প্রতি হস্তক্ষেপের কারণ আসলে কোনো লিঙ্গের জন্যে হয়না, হয় একটি বিশেষ ভাবনার জন্যে। হ্যাঁ, স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ একটি বিশেষ লিঙ্গ দ্বারাই বেশি ঘটে বটে, কিন্তু এর মূল কারণ আসলে একটু সুপ্রতিষ্ঠিইত ভাবনা। সেই ভাবনা কী? সেই ভাবনা হল ‘সবাইকে একটা বিশেষ ওরিয়েন্টেশনে থাকতে হবে’।

যেমন ধরুন, আপনি যদি একজন মেয়ে হন তাহলে আপনার ‘ড্রেস কোড’ আর ‘ম্যানার কোড’ আগে থেকেই প্রিসেট করা থাকবে। আপনি এই কোডের বাইরে আচরণ করতে পারবেন না। একইভাবে আপনি যদি একজন ছেলে হন, সেক্ষেত্রেও আপনার জন্যে একই রকম আচরণ বরাদ্দ আছে। যদিও ছেলেদের জন্যে আচরণের কোডে একটুখানি শিথিলতা দেওয়া হয় কিন্তু তবুও সমস্যা ঐ প্রিসেট কোডেই। আর এই কারণেই যখন আসলে একটা মেয়ে জিন্স-টিশার্ট পরে বের হয়, একটা ছেলের চুলে বিণুনী দেখা যায়- ঐ কোডটা ভেঙে যায়। আর তখনই সমাজ ক্ষেপে যায়।

আমাদেরকে তাই যেটা করতে হবে, ঐ কোডটা ভেঙে ফেলতে হবে। একজন মানুষের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে হলে আমাদের প্রথমে সব ধরণের নির্ধারিত কোড উৎরে ফেলতে হবে। আমাদের ভাবতে হবে, একজন মানুষ যা পরতে চায় তাই সে পরতে পারে। যা করতে চায়, অন্যের ক্ষতি না করে তাই-ই সে করতে পারে।

কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, এই ভাবনার সাথে তাল মেলানোটা সহজ নয়। বাংলার একটা বিখ্যাত উক্তি আছে। যেখানে দেখা যায়, একটি গাছ কাঠুরেকে বলছে, “কাঠুরে ভাই, তুমি কি কাটতে পারতা মোর/ যদি না থাকত পিছে মোর সহোদর”

সত্যিই কিন্তু তাই। গাছের কাঠ দিয়ে হাতল তৈরি না করা হলে কখনই কি কুড়াল ধরে গাছ কাটতে পারত কাঠুরে? পারত না। এটা একটা সাইক্লিক প্রসেস। যেখানে গাছ কাটা হয় যে কুড়াল দিয়ে, সেই কুড়ালের হাতল বানানো হয় ঐ কাঠ দিয়েই, আবার কুড়াল দিয়ে গাছ কেটে সেই গাছ দিয়ে অন্য কোন কুড়ালের হাতল বানানো হয়। এই একইরকম সাইক্লিক প্রসেস দেখা যায় সমাজেও।

একটা শিশু প্রথমেই বড় হয় তার মায়ের কাছে। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের সমাজে বেশিরভাগ মায়েরাই উদারমনা হতে পারেন নি। তারা এখনও পুরুষের দাসত্ব করাটাকেই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মনে করে থাকেন। আমরা যতই নারী স্বাধীনতার নাম করে ফানুস উড়াই না কেন, যত বেশি সেমিনার করি না কেন, এই সব কার্যক্রমের কোনোটাই আসলে একদম মূলে পৌঁছাচ্ছে না। আমরা যেটা করছি, যে আলোকিত তাকে আরো বেশি আলোকিত করছি। যে জানে, তাকে আরো বেশি করে জানাচ্ছি। কিন্তু যার জানার দরকার তাকে আমরা জানাচ্ছি না। একটা গার্মেন্টসকর্মীকে আমরা নারীবাদের আসল তথ্য ও উদ্দেশ্যটুকু বিলিয়ে দিতে পারছিনা। কিংবা একজন নির্যাতিত গৃহিণীকে আমরা বলতে পারছি না তারও নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত, এই নির্যাতিত অবস্থা তার ‘ভাগ্য’ বা ‘অবধারিত’ নয়। আর এতেই মূলত সমস্যা থেকে যাচ্ছে। দিনের পর দিন এসব মায়েরা একেকটি সেক্সুয়ালি ফ্রাস্ট্রেটেড, অন্ধ প্রজন্ম জন্ম দিচ্ছে।

এই সাইক্লিক প্রসেসই আমাদের জন্যে ক্ষতির কারণ হয়ে যাচ্ছে। নতুন করে বড় হওয়া বেশিরভাগ শিশুকেই আমরা একজন মানুষের স্বাধীনতার অংশটুকু বোঝাতে পারছিনা। আমরা যাদেরকে বোঝাতে পারছি তারা, যাদের বোঝাতে পারছিনা তাদের ভিক্টিম হয়ে যাচ্ছে। এভাবে আসলে মূল সমস্যাটা সমাধান করা যায়না। এভাবে যতদিন চলবে, ততদিন অব্দি ঐ বাসের মহিলাটির মত সবাই এটাই মনে করতে থাকবে যে- একজন মানুষ প্রচলিত কোডের বিরুদ্ধে যেতে পারেনা!

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *