November 24, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

‘টক্সিক মাস্কুলিনিটি’র দূত উইল স্মিথ

শামস আবীরুজ্জামান সিয়াম ।। সোশাল মিডিয়ার সুবাদে ইতোমধ্যে আপনারা ৯৪তম আ্যকাডেমি এওয়ার্ডস-এর মঞ্চে ঘটে যাওয়া ভাইরাল ঘটনা – উইল স্মিথের কমিডিয়ান ক্রিস রককে চড় মারা’র বিষয়ে অবগত আছেন এবং ইতোমধ্যে নিজেদের স্ট্যান্ডও নিয়েছেন। অনেকে মনে করেন ক্রিস রকের গালে একহাত বসিয়ে বেশ করেছে উইল স্মিথ, মানুষের অসুস্থতা নিয়ে রসিকতা করলে একহাত বসিয়ে দেওয়াই উচিত।

আবার অনেকে বলছেন কমিডিতে এসব ব্যাপার তো স্বাভাবিকই,স্ট্যান্ড আপ কমিটিডিতে ৯/১১-এর হামালায় মারা যাওয়া নিজের মৃত অভিভাবক নিয়েও যেখানে সন্তান খোদ  রসিকতায় মেতে ওঠে, সেখানে এসব আর আহামরী আর কী!

তাছাড়া ক্রিস রকের ইনটেনশন নিশ্চয়ই ছিল না কাউকে হেয় করা, বিনোদনের খাতিরে আসর জমানোর জন্য এতটুকু মজা একজন কমিডিয়ান করতেই পারে। আমাদের সবকিছু রেখে মূলত ইনটেনশন দেখা উচিত!

এরকম নানা মন্তব্যে দুটা পোলার সাইডে সোশ্যাল ভরপুর, তাই ভাবলাম আজ ব্যাপারটা নিয়ে একটু পণ্ডিতি করে কেটে পড়ি।

অনেকের মতো আমার প্রথম ইমপ্রেশন ছিল কারো মেডিকেল কন্ডিশন নিয়ে রসিকতা করলে এরকম চড় বসিয়ে দেওয়াই উচিত।

ছোটবেলা থেকে নিজেরও মেডিকেল কন্ডিশন নিয়ে এরকম সো-কল্ড “নির্দোষ রসিকতার” শিকার হলে গালে একহাত বসিয়ে দিতে মন চাইত। সেই মনে বেশ করেছে বলে সায় দেয়াটা অস্বাভাবিক কিচ্ছু না বটে। অনেকে এই জায়গায়  ইনটেনশনের প্রসংগ তুলছেন তাদের।

মাঝে মধ্যে আপনার ইনটেনশন ম্যাটার করে না কারণ আপনার মেটিরিয়ালটাই সমস্যাজনক। কোনো একজনের মেডিকেল কন্ডিশন আপনার রসিকতার উপকরণ হলে আপনার ইনটেনশন যাচাই করতে আমি যাব না, আমি বলব আপনার উপকরণটাই সমস্যাজনক, অন্য কোনো মানুষের অসুস্থতা,মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি প্রথম জায়গাতেই আপনার নির্দোষ রসিকতার উপকরণে অর্ন্তভুক্ত হওয়া উচিত না।মানুষের মেডিক্যাল কন্ডিশন নিয়ে রসিকতার নামে আলাপ পাড়াকে এলবিজম বলে। দৈনন্দিন নারীদের পিরিয়ড নিয়ে, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে, অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে হওয়া এসব এলবিজম দেখলেই আমি চোয়াল শক্ত করে আড়চোখে তাকাই, আমি আর ইনটেনশন খুঁজতে যাই না। কাজেই ইনটেনশনের আলাপ আমার কাছে খুব একটা ভালো ঠেকলো না।

ছিলাম প্রথম ইমপ্রেশন নিয়ে কথা বলায়।

“চড় মেরেছে,বেশ করেছে” আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া হলেও আমার ইনিশিয়াল স্ট্যান্ড নয়। ক্রিস রকের কার্যক্রম যেমনি জঘন্য, উইল স্মিথের কাজও তেমনি অ্যাসল্ট। আমি অ্যাসল্টকে হোয়াটএভার দি কনটেক্সট অ্যাসল্টই মনে করি।

আনসেনসরড ভিডিও কাটে চোখ বুলালেই দেখা যায় ক্রিস রকের মন্তব্যের উপর উইল স্মিথ প্রথমে নিজেই দঁন্তপাটি বের করে হাসছেন।

পরে আবার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে উনি চটে গেলেন, নিজে প্রথমেই অফেন্সিভ মনে না করে দাঁত বের করে হাসা উইল স্মিথের পরবর্তীতে আবার টোন বদলে যাওয়ার ব্যাপারটা গলাদ্ধকরণ করতে পারছিলাম না। থাক, গোয়েন্দাগিরি বাদ দিই। আসল কথায় আসি।

“ভালোবাসা আপনাকে উদ্ভট জিনিস করতে বাধ্য করে (Love makes you do crazy things) উক্তিটা উইল স্মিথের, অস্কার পাওয়ায় পরবর্তী বক্তব্যের সময় করা। পাশাপাশি তিনি উনার অভিনীত চরিত্র কিং রিচার্ড এবং উনার মধ্যে সাদৃশ্যের কথা বলেন, উনারা দুজনই পরিবারের অকুতোভয় রক্ষক (defender)। ঘটনাটা যে মুহূর্তে ঘটে জেডা পিনকেট স্মিথ সেই সময় অস্কারের সামনের সারিতে উপস্থিত ছিলেন।

মার্কিন অভেনেত্রী ও গায়িকা জেডা পিনকেট স্মিথ একজন স্বাধীন এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর একজন নারী। দি টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১ সালে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী মানুষের মধ্যে জেডা স্মিথ ছিলেন। উপরন্তু আ্যকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের মঞ্চ এমন একটি জায়গা যেখানে সবাই কথা বলার জায়গায় থাকেন। রসিকতার প্রাপকের দ্বারপ্রান্তে থাকা জেডার নিজের এজেন্সি ছিল নিজের হয়ে কথা বলার।

আমরা আসল পুরুষ বলে অনেকে উইল স্মিথকে তার স্ত্রীকে “রক্ষা” করার জন্য অভিবাদন দিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু সেই “রক্ষা করা” স্ত্রী পিনকেট স্মিথের কাছ থেকে ইনিশিয়ালি আমরা কিছুই শুনিনি, উনি নি নিজের জন্য নিজে স্ট্যান্ড নিতে অক্ষম যে উনি সেইভড হতে চান? যেখানে পিনকেট স্মিথের কাছে পৃথিবীর সব মাইক্রোফোনে স্টেটমেন্ট দেওয়ার মতো আওয়াজ ছিল। তাহলে কোন বোধ বাধ্য করল উইল’কে জেডার প্রটেক্টর হয়ে উঠে গিয়ে ক্রিস রককে চড় মারতে?

সেই একইবোধ থেকে যে আমার স্ত্রীকে আমার প্রটেক্ট করতে হবে, সেই দায়িত্ব আমার, আমার স্ত্রীর রক্ষক আমি যা সচরাচর আমরা আমাদের চারপাশে প্রায়শই দেখতে পারি। তবে পার্টনার হয়ে পাশে দাঁড়ানো এবং রক্ষাকর্তাকে (fierce defender!) আবার এক কাতারে ফেলবেন না। পার্টনার হয়ে পাশে দাঁড়ানোটা নারীর নিজের এজেন্সিকে অস্বীকার করে না, এখানে অভিভাবকের আসনে কেউ কাউকে বসাতে যায় না। কিন্তু রক্ষক হয়ে, ফিল্মে যেমন বলে, স্ত্রীর সম্মান রক্ষার খাতিরে অ্যাকশন নেওয়া এবং ভায়োলেন্সকে নিজের উপায় হিসেবে নির্বাচন করা – এসব, জি হ্যাঁ, টক্সিক মাস্কুলিন ট্রেইট এবং পুরুষতান্ত্রিক আচারের মধ্যে পড়ে। আমার স্ত্রীকে বলছে বলে আমার স্ত্রীর রক্ষক হতে হওয়ার যে প্রয়োজনীয়তা তা সরাসরি নারীর নিজের এজেন্সিকে অস্বীকার করে। নিজের পাশে বসা স্ত্রীকে আমারই রক্ষা করতে হবে- এর প্রয়োজনীয়তা বা তাগিদ অনুভব করে নিজেকে “আলফা মেইল” মনে করে ভায়োলেন্ট আচরণ করা এবং ভালোবাসা আপনাকে পাগল সব জিনিস করাতে বাধ্য করে বলে ভালোবাসার নামে ভায়োলেন্ট আচরণকে যথার্থতা দেয়া পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা।

উইল স্মিথ নিজের ভাষায় “আমার জীবনের এই সময়ে, এই মুহুর্তে, ঈশ্বর আমাকে এই পৃথিবীতে যা করতে এবং থাকতে বলছেন তাতে আমি অভিভূত। আমি ভালোবাসা আর স্নেহের দূত হতে চাই।”

উইলিয়াম স্মিথ যে বেঞ্চমার্ক সেট করেছেন তাতে ভালোবাসা আর স্নেহের দূত হন আর না হন, টক্সিক মাস্কুলিন ট্রেইট এবং ভায়োলেন্সের দূত হইতে পারবেন তাতে সন্দেহ নাই। এই আমি আমার পরিবারের আলফা মেইল মনোভাব নিয়ে যখন একজনকে সুপিরিওর স্থানে বসিয়ে দেই, তখনই তার শোচনীয় পর্যায়ে আমরা সমাজে বিবাহিত নারীদের কাজ করতে হলে স্বামীর “অনুমতি” নিতে হবে পরিস্থিতিতে দেখতে পাই।

ছোট থাকতে ইংরেজি মুভিতে দেখতাম মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সময় আবেগী পিতা জামাতাকে চোখের পানি ফেলে জিজ্ঞেস করতে “Will you put yourself before to defend my daughters honour? ” সেই বিবাহ দেওয়া মেয়েটা আজ পর্যন্ত নিজেকে ডিফেন্ড করতে যেন শেখে নাই। শিখলেও তাকে করতে দেওয়া হয় না কারণ সেইদিন প্রমিস করা আজ্ঞাকারী জামাইবাবু আজ পর্যন্ত তার “সম্মান রক্ষা” করেই যাচ্ছে। পাশপাশি বেঞ্চমার্কে অনুকরণ স্বরূপ পুত্র জেডেন স্মিথের ” That’s how we do it ” আমাদের আশাহত করছে না।

উইল স্মিথ ভালোই ভেসেল হতে পেরেছেন, টক্সিক মাস্কুলিনিটির ভেসেল।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *