নারীর অপারগতা, অযোগ্যতা ইত্যাদি
সাহারা ইসলাম ।। আজ সকালে আমার মা গল্প করছিল, সে যখন ছোট ছিল তাদের পাশের গ্রামে দুজন নারীর সাথে ঘটা ভয়াবহ নির্যাতনের কথা। আমার মা তার নানীর সাথে ওই নির্যাতিত নারীদের একজনের বাড়িতে গিয়েছিল। ঘটনাটা হলো – ওই নির্যাতিতা নারী তার নিজের সংসারে নিজের করা রান্না স্বামীর অনুমতি না নিয়ে খাওয়ার পর মারধোরের শিকার হয়। এবং এটাকে প্রচার করা হয় যে, সে চুরি করে খেয়েছে। আমি বুঝে উঠতে পারি না নিজের সংসারের খাবার খাওয়া কেন চুরি করে খাওয়া হবে আর খাওয়ার জন্য তাকে মারধোরের শিকার হতে হবে! শুধু তাই নয় মারধোরের শিকার ওই নারী প্রতিবাদ করায় তার নপুংসক স্বামী নির্যাতিতার হাতের দুই আঙুল কেটে নিয়েছিল। কী ভয়াবহ নৃশংসতা!
এরপর আরেকজন নারীর ঘটনাটা হলো, সেই নারী তার স্বামীর সাথে আর সংসার করতে পারছিল না। তাকে নিয়মিত মারধোর করা হতো। তাই সে তালাক চেয়েছিল স্বামীর কাছে। স্বামীও বিয়ে করে নতুন একটা বউ নামধারী বিনা পারিশ্রমিকের দাসী পেতে আগ্রহী ছিল। সে তালাক দিতে রাজি হয়ে যায় তবে তালাকের আগে ওই নারীকে চরম হেনস্থা করার জন্য কৌশল ভাবতে থাকে। ওই বিকৃত চিন্তার ব্যক্তি তার দাদীর কাছে নাকি জিজ্ঞেস করেছিল, বউ তো ছেড়ে দিচ্ছে কিন্তু বউয়ের মাথার সব চুল ন্যাড়া করে তারপর ছাড়বে, নাকি বউয়ের নাক কেটে দিয়ে ছেড়ে দেবে। তার দাদী বললো চুল ন্যাড়া করে ছেড়ে দে। সে তাই করলো।
এই দুটো ঘটনা মূলত নারীর প্রতি চরম নৃশংসতা এবং পুরুষের আধিপত্য বিস্তারের বহিঃপ্রকাশ।
সৃষ্টির আদিমকাল থেকেই পুরুষ চেয়েছে নারীকে শোষণ করতে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে, ভয়ে তটস্থ করতে, কাজে লাগিয়েছে তার পেশীশক্তি এবং ধর্মীয় দৈব বানীকে। এখন পর্যন্ত নারীর প্রতি পুরুষের আধিপত্য বিস্তার, বর্বরতা ভয়াবহ। সোশ্যাল মিডিয়াতে পর্যন্ত বিভিন্নভাবে হেনস্থার শিকার হতে হয় নারীদের। নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোতে মানুষের প্রতিক্রিয়া অদ্ভুতভাবে ভীষণ নির্মম। যেকোনো নারীর অবমূল্যায়ন নিপীড়নের ঘটনায় তারা পৈশাচিক আনন্দ পায়। এতে প্রতিবাদ করলে একের পর এক অযৌক্তিক কথা এবং চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করার নোংরামি করে তারা। যেহেতু পুরুষতন্ত্র গোঁড়া থেকেই নারীকে এটা শিখিয়েছে যে সতীত্বই একজন নারীর সবকিছু এবং তার চরিত্র হিসেবে বিচার হবে, চরিত্রই তার মাথার মুকুট তাই নারীকে দমাতে চরিত্র প্রশ্নবিদ্ধ করা তাদের পুরনো নোংরা খেলা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় যেকোনো লেখালেখি কিংবা প্রতিবাদস্বরূপ কমেন্টে আমাকে প্রশ্ন করে পুরুষতান্ত্রিক পুরুষেরা যে, এই পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির জন্ম দিয়েছে পুরুষরা, নারীরা কী করেছে? এই প্রশ্নটাই তাদের হাতে থাকা বড় অস্ত্র বলে তারা মনে করে নারীকে ঘায়েল করতে। এই প্রশ্ন আমি অনেক পুরুষের কাছ থেকে শুনেছি। তারা উদাহরণ টানে পুরুষ বিজ্ঞানী এবং সাহিত্যিকদের।
এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই পুরুষেরা নারীদের পিষতে চেয়েছে এবং পিষেছেও তাদের পায়ের নিচে। নারীদের তারা করে রেখেছে অক্রিয়, নিকৃষ্ট। নারীরা জন্মলগ্ন থেকে কিংবা সহজাতভাবেই অক্রিয় নয়। পুরুষতন্ত্র তার তৈরি শেকলে বেধে রাখতে চেয়েছে নারীদের আজীবন। তাই ধর্মীয় বাণী দিয়ে, পেশীশক্তি দিয়ে নারীদের তৈরি করেছে চাবি দেয়া পুতুল রূপে। তাই দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ নারীদের শিক্ষা থেকে দূরে রেখে তাকে অশিক্ষিত বলা, বিজ্ঞান থেকে দূরে রেখে প্রযুক্তি থেকে বঞ্চিত করে তাদের অক্রিয় বলা, শাসন করার ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে রেখে তাকে শাসন করার অনুপযোগী বলা অত্যন্ত হাস্যকর এবং পুরুষতন্ত্রের নোংরা চক্রান্তগুলোর একটি।
সনাতন হিন্দুধর্মের জাতপাত নিয়ে প্রাচীনকালের ভয়ংকর বৈষম্যের কথা আমাদের সবারই জানা। সেসময় শূদ্রদের (সবচেয়ে নিচু জাতের হিন্দু) সাথে করা হতো চরম অবমূল্যায়ন। সমাজের তথাকথিত নিম্নস্তরের কাজ করানো হতো শূদ্রদের দিয়ে। শূদ্রদের শিক্ষা অর্জন থেকে করা হতো বঞ্চিত। শূদ্ররা কখনো রাজ্য পরিচালনা করার সুযোগই পায় নি। তাদের নিযুক্ত করা হতো অন্য সব কাজে যা অন্য শ্রেণির হিন্দুরা করতো না। এমনকি শূদ্রদের হাতের ছোঁয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। শূদ্রদের প্রতি অবমূল্যায়ন করে তাদের বঞ্চিত করে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে তারা শিক্ষার যোগ্য নয় কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনা করার কিংবা শাসন করার যোগ্য নয়।
তাই একইভাবে নারীরও জন্মলগ্ন থেকে সহজাতভাবে নেই কোনো অপারগতা, অযোগ্যতা। নারীর সমস্ত অপারগতা কিংবা অযোগ্যতাই পরিস্থিতিগত, নারীকে এই অক্রিয় করে রাখা, অযোগ্য করে রাখা সবই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে নিষ্ঠুরভাবে দমনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার ফল।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]