May 17, 2024
সাহিত্যস্যাটায়ার

‘বখাটে ছেলের ভিড়ে ললনাদের রেহাই নাই’

মাসকাওয়াথ আহসান ।। বোশেখের নববর্ষে প্রাচীন নগরী রং-এর বাড়ই-এ আনন্দের আহ্বান করলে যোধা বাঈ সম্রাট আকবরকে অনুরোধ করেন, বাদশাহ, আপনি সারাক্ষণ মানুষের সঙ্গে থাকেন, তাদের নিয়ে ভাবেন, বীরবলের সঙ্গে বসে খুশিজল পান করেন। একবারও ভেবেছেন আমার কথা! আপনার ফুপু সারাক্ষণ আমার পিছে লেগে আছেন। আমাকে টিপ পরতে নিষেধ করে বলেছেন, মুসলমানের বউ আবার সিঁদুর দিয়ে ঘুরছো কেন যোধা। আমি খুব কষ্ট পেয়েছি সম্রাট, আমি তো মুসলমানকে বিয়ে করিনি; একজন মানুষকে ভালোবেসেছি; যিনি হিন্দু-মুসলমান সবার বন্ধু।

আকবর তখন বাবুরনামা থেকে চোখ তুলে বলেন, ফুপু অল্প বয়সে বিধবা হয়েছেন; তার জীবনের বেদনা কি তুমি অনুভব করোনা! নিঃসঙ্গতায় মন বিষণ্ণ থাকে বলেই তিনি তেতো কথা বলেন। তোমার তো দিনশেষে সব আছে যোধা; ফুপুর জীবনে কী আছে বলতে পারো?

যোধা একটা ধূসর কবুতরকে উড়িয়ে দিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে টিপ দেয়। আকবর আবার চোখ রাখেন বাবুরনামায়; তার দাদার সাহিত্যকর্ম তাকে বারবার দাদার সান্নিধ্যে নিয়ে যায়। মনে পড়ে দাদা তাকে ঘোড়ায় করে; ভূস্বর্গ কাশ্মীর দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন; সেখানে কাশ্মীরিরা নেচে গেয়ে বসন্ত বাহারের পুষ্পবর্ষণ করেছিল। বজরায় করে উচাঙ্গ সংগীতে মাতোয়ারা কী সেই চাঁদ্গলা রাত!

অনেকক্ষণ সামনে দাঁড়িয়ে থেকে যোধা বলে; সম্রাট সারাক্ষণ বাবুরনামা পড়েন রাজা, যোধার কিতাবি চেহারা কি কখনও পড়েছেন! কত কথা লেখা আছে তাতে। সেই যে প্রথম সে দেখা, আপনি সম্রাটের খোলস ছেড়ে কেমন করে মাখন চোর কানহাইয়া হয়ে উঠলেন! একী রাজ্য জয়ের অভিনয় ছিল আপনার! নইলে যোধারাজ্য জয়ের পর কেমন করে যেন ফিরে গেলেন দিল্লীরাজের মুখোশে। কোনটা মুখ কোনটা মুখোশ, কোনটা প্রেম, কোনটাই বা প্রজাশাসন।

আকবর বলেন, যোধা খোদা যখন কাউকে রূপ দেন; তখন তার মস্তিষ্কের গঠন জটিল করে তোলেন। খোদার এই রূপের উপহার; নারীকে নিসর্গের মতো সুন্দর করা; ধরিত্রীর মতো পূর্ণ করা; পুরুষের জন্য প্রেমের আলেয়া হয়ে; তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড যেন। ভেবে দেখো যোধা, আসমুদ্র হিমাচল সবাই বিনাবাক্যে আমাকে ভালোবাসে; আর তুমি নীরবতার মাঝেও অসংখ্য বাক্যের শেকল পরাও আমাকে। তা ঢাকার জাসন ই বাহারার কথা বলে কোথায় চলে গেলে হে হৃদয়সম্রাজ্ঞী, প্রেম উপনিবেশের প্রভু!

যোধা এবার রেগে তরবারি নিয়ে আসে। একটা তরবারি ছুড়ে দেয়, আকবরের দিকে। তরবারি দুলিয়ে বলে, এই যুদ্ধে হেরে গেলে তোমাকে ঢাকা যেতে হবে আমার সঙ্গে। আকবর বলেন, যেতে তো পারিই। কিন্তু ওটা দ্রুত ধনীর অভিজাত নগরী। এতো আভিজাত্য কি আমাদের আছে! ঢাকা বিশ্বের ব্যয়বহুল শহর। এতো তাড়াতাড়ি কোত্থেকে এতো টাকা খরচ করবো!
যোধা তার গলার মালা, কানের দুল, হাতের বালা, কোমরের বিছা, নাকচাবি খুলে দিয়ে বলে, তবু আমার ঢাকা যাওয়া চাই।

ঢাকায় এসে কম খরচে বিউটি বোর্ডিং-এ ওঠেন দুজন। অপরূপ এই বাগানবাড়ি। এখানে কবি গায়ক চিত্রকরেরা এসে চৈত্র সংক্রান্তির আয়োজন করে। যোধাকে দেখেই কবি মুজতবা আহমেদ মুরশেদ বলেন, ওগো জ্যোৎস্নাদায়িনী, দেবে কি আমায় চন্দ্রমুদ্রার অলোকাপুরী
ওগো সূর্যদায়িনী, নেবে কী আমার আমন্ত্রণ, ডাকবো কি ভিক্টরিয়াজুড়ি!
তুমি কি যাবে ওগো নীলাঞ্জনা, বুড়িগঙ্গার স্রোতে ভাসা আনন্দতরী!

আকবরের একবার ইচ্ছা হয় কিছু বলতে; কিন্তু সমঝে নেয়। এখানে তো সে সম্রাট নয়। বিউটি বোর্ডিং-এর সম্রাট হতে গেলে কবি হতে হয়।

সকালে কবি মুরশেদ তাদের ছবির হাটে নিয়ে যান। একজন চিত্রকর এসে যোধার অনুমতি নিয়ে স্কেচ করতে থাকে। আকবর রঙ চা খেতে খেতে উপভোগ করেন, এই গোলাপী রোদ, চিত্রকরের আড্ডা; এই মুক্তাঞ্চল; আইন ই আকবরির আনন্দরাজ্যের মতো!

মুরশেদ আকবরকে নিয়ে যান তার বোশেখি আয়োজনে। একটানা গান ভেসে আসে –

এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো
তাপসনিঃশ্বাসবায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক…

কয়েকজন তরুণী এসে আকবরের অটোগ্রাফ নেয়, সেলফি তোলে। টিএসসি’র ভেতরে নামাজ পড়তে দেখে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ তো কাছে; একটু হেঁটে না গিয়ে এখানে দেড় ইটের মসজিদ গড়েছে কেন! ধর্ম দেখাচ্ছে ওরা কাকে; এই দুনীতিতে ঝাঁঝরা জনপদে!

মুরশেদ বলেন, আস্তে বলুন সম্রাট; ওরা ক্ষুব্ধ হতে পারে।

আকবর এগিয়ে গিয়ে নামাজ পড়া শেষ হলে তরুণ-তরুণীদের বোঝান, নামাজ হচ্ছে খোদার কাছে আত্মসমর্পণ। মসজিদ হচ্ছে সেই সুনসান-নীরব পবিত্র গৃহ, যেখানে খোদার সাধনা করা যায়। এতো ধর্ম প্রদর্শন কোরোনা। গভীর ভালোবাসা সব সময় থাকে অপ্রদর্শনে। কিন্তু খোদা তা দেখতে পান।

ছেলেমেয়েগুলো আকবরের কথায় সম্মতি দেয়। মুরশেদ তাড়া দেন। মঙ্গল শোভাযাত্রায় যেতে হবে।
টিএসসি থেকে ছবির হাটে যাবার সময়, মুনতাসির মামুন এসে জিজ্ঞেস করেন, মি আকবর, আপনি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি না বিপক্ষের শক্তি! আপনি কী ভারতপন্থী না পাকিস্তানপন্থী।

পাশ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে তুহিন মালিক বলেন, মঙ্গলের প্রতীক খোদা। মঙ্গলশোভাযাত্রার এই পেঁচা, সূর্য, হাতি, কচ্ছপ তো হিন্দুয়ানী!
আকবর হেসে বলেন, পেঁচা হিন্দু নাকি! সূর্য হিন্দু হলে, আলোতে দাঁড়িয়ে কেন জনাব! হাতি হিন্দু হলে আমি দিল্লীতে হাতিতে চড়ি কেন! আর কচ্ছপ সে হিন্দু কেন হবে; সে তো কোনটা ভারত সাগর কোনটা আরব সাগর বুঝে সাঁতার কাটে না।
মঙ্গল শোভাযাত্রায় যোধা আনন্দে মাতোয়ারা হয়। চিত্রকরেরা গান গায়, যোধা ঠোঁট মেলায়। চিত্রকর নাজিব জিজ্ঞেস করে, কী পেয়েছেন আকবরের মাঝে! উনি কী অমন স্কেচ আঁকতে পারবেন, যতটা মায়া দিয়ে এঁকেছি আমি!

যোধা বলেন, তুমি বয়সে অনেক ছোট নাজিব, অমন ছেলেমানুষী করোনা! নাজিব বোঝায়, কেন প্রতিষ্ঠানে বন্দিনী হয়ে আছেন, প্রতিষ্ঠানবিরোধী হতে শেখেন। মিশেল ফুঁকো এ প্রসঙ্গে কী বলেছেন জানেন!

মিশেল ফুঁকোর ভয়ে যোধা রমনা পার্কে ঢুকে পড়েন। রমনার বটমূলে ছায়ানটের গানের সুনাম অনেক শুনেছে যোধা। হঠাৎ টিকটকার অপু দৌড়ে এসে যোধার পাশে ফেসবুক লাইভ করে, ফ্রেন্ডস আমি আমার ক্রাশের দেখা পেয়েছি; এই দেখুন আমার জি এফ।
পেছন থেকে দুটো ছেলে গেয়ে ওঠে, বখাটে ছেলের ভিড়ে ললনাদের রেহাই নাই, মেলায় যাইরে!

যোধা ছায়ানটের সানজিদা আপাকে সালাম দিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়ান। উনি বলেন, এই মেয়ে গান শেখোনা কেন! তোমার গলায় সুর আছে।
যোধা গুন গুন করে গায় –
কাহেনো কো জাসনে বাহারা হ্যায়,
ইশক এ দেখকে হারা হ্যায়,
ফুলসে খুশবু খাফা খাফা হ্যায় গুলশানমে
চুপা হ্যায় কোয়ি রাঞ্জ ফিযা কী চিলমানমে!

সানজিদা আপা যোধার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন। যোধার চোখে জল আসে। মনে মনে প্রার্থনা করে, ফুপু যেন সানজিদা আপার মতো স্নেহময়ী হয়ে ওঠেন।

কবি মুরশেদ ছুটতে ছুটতে আসেন, যোধা এভাবে হারিয়ে গেলে কি চলে! আমি তো ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
যোধা বলে, আপনি দেখুন আমার খোঁজ নিতে এসেছেন, কিন্তু আকবর কোথায়!
কবি মুরশেদ বলেন, চলুন উনি চারুকলার পুকুরের পাশে বসে খুশিধোয়া পরিসেবন করছেন।
দূর থেকে যোধা দেখে, পরীর লাস্যে মাতোয়ারা আকবর। পরী নাচতে নাচতে ঘুরছে আনন্দ সরোবরের চারপাশে। বিতার্কিক আব্দুন নূর তুষার আকবরকে বোঝাচ্ছেন, আপনিও পরীর পাল্লায় পড়ে যান; কেমন করে চলবে! এমনিতেই এ শহর থেকে বসন্তের বাতাস হারিয়ে গিয়ে পাপিয়ার বাজপাখীরা আড্ডা জমিয়েছে দুর্নীতির কাশিমবাজার কুটিরগুলোতে; অবৈধভাবে জমি দখল করা বোট ও ঠোঁট ক্লাবগুলোতে।

আকবর বলেন, হে বিতর্করাজ, হীরকখণ্ডের পরিচর্যা করতে হয়। হীরকখণ্ড কেন পড়ে থাকবে দুর্নীতি বসন্ত রোগের ফ্রড আর ফ্রয়েডের জুয়া খেলার আসরে। পরীকে আজ থেকে নাম দিলাম পরী বাঈ; এখন থেকে ও আমার দশম রত্ন। ও তানসেনের সুরে নাচবে। ওকে দেখে আমার কবিতা লিখতে ইচ্ছা করছে।
যোধা কোত্থেকে ঝড়ের মতো এসে আকবরকে ঝটকা টানে তুলে বলে, বাসায় চলো!
কবি মুরশেদ পরিস্থিতি সামাল দিতে বলেন, ক্রোধ তোমাকে মানায় না। সুরঞ্জনা দিল্লিতে ফিরে যেওনা সুরঞ্জনা; কী কথা তোমার আকবরের সাথে!
এমন সময় এক পেট মোটা পুলিশ এসে বলে, কপালে এমন হিন্দুয়ানী টিপ কেন! আপনারা জানেন না, দুপুর দুইটার মধ্যে এইসব বৈশাখের হাঙ্গামা শেষ করতে হবে!

যোধা নিজের হাতের রাখি খুলে পুলিশকে পরিয়ে দিলে, পুলিশ জিজ্ঞেস করে, কী খাইবা কও বইন! চলো আজ তোমারে আর জামাইরে নীরব হোটেলে আট পদের ভর্তা ভাজি দিয়া খাওয়ামু! একেবারে অষ্টব্যঞ্জন যারে বলে।

পরী ততক্ষণে কবি মুরশেদের পাশে এসে দশম শ্রেণীর সুবোধ মেয়েটির মতো চশমা পরে দাঁড়িয়েছে।
আকবর বলেন, যে শহরের মানুষের মন এতো সুন্দর; সে সুন্দর অনেক সুন্দর। ঢাকা কবিতার শহর, গানের শহর, প্রেমের শহর, বন্ধুত্বের শহর আর অষ্টপদের শহর।

 

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত স্যাটায়ার লেখকের নিজস্ব চিন্তার বহিঃপ্রকাশ]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *