September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নিম্নবর্গের যৌনতা ও শিল্পী নার্গিসের গান

সাকিব শাকিল ।। উপনিবেশিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষার অবদমিত অবস্থা তৃতীয় বিশ্বের নারীদের ক্ষেত্রে প্রকট রূপ ধারণ করে। অবদমনের চুড়ান্ত রূপ একজন নারীর সত্ত্বা উপনিবেশিত সমাজের পুরুষতান্ত্রিক শাসনে পুতুল-চরিত্রের ভূমিকায় পর্যবসিত হয়। নারীর প্রেম, ভালোবাসা, যৌনতার দৃষ্টিভঙ্গিগুলো সাহিত্য, গানে, সংস্কৃতির নানান ক্যাটাগরিতে প্রকাশ হয় পুরুষতন্ত্রেরই বয়ানে। নারী তাই হয়ে ওঠে পুরুষের যৌন শাসনের ফ্যান্টাসি। সাহিত্য, গানে, হাস্যরস-কৌতুকে পুরুষতন্ত্র নিজেদের ফ্যান্টাসিতে বর্ণণা করে নারীকে। তৃতীয় বিশ্বের নিম্নবর্গের নারীর প্রেম ভালোবাসা যৌনতার অবদমিত রূপ কবিতা, গানে যতটা উঠে আসে, উপনিবেশিত বুর্জোয়া মনন গড়া ঐতিহাসিকদের লেখায় তার স্বরূপ উদঘাটন হয় না। নিম্নবর্গের চেতনাকে ‘অপর’ করে রেখে মুদ্রণ পুঁজিবাদের মদদে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত এলিট-শ্রেণি বাইনারি তৈরি করে শিল্পের সংজ্ঞায়নে। সৃষ্টি হয় ‘কালজয়ী’ ‘ধ্রুপদী’, ‘শ্লীল’ ‘শৈল্পিক’ সাহিত্য এবং অপরপক্ষে অশ্লীল, সস্তা, বটতলার কাব্য, পুঁথি, বিচ্ছেদী গান, ভাটি অঞ্চলের প্রেমের গান নামকরণের মধ্য দিয়ে অপর করে রাখা হয় তৃতীয় বিশ্বের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে।

‘কার্যত প্রকাশনা জগতের যাবতীয় দেখভালের ও পরিবেশনের কর্তৃত্ব মধ্যবিত্ত শ্রেণিরই আয়ত্ত্বে। অপরাপর শ্রেণি, গোষ্ঠী আর প্রান্তিক মানুষজনের রচনা এই ব্যবস্থায় অদৃশ্য হয়ে যায় এবং অদৃশ্যকরণের এই প্রক্রিয়াটা বৈষম্যের সম্পর্কের বাস্তবতায় এখনও চলমান।’

বৈষম্যের এই প্রতিযোগীতায় অশ্লীলতার মানদণ্ডে কিংবা নান্দনিক শিল্পের সংজ্ঞায়নের সীমায় নিম্নবর্গের গানকে উপেক্ষিত করে রাখে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত এলিট-শ্রেণি। তাদের আলোচনায় যাদের গানের কথা উঠে আসে তাদের গানের ভাষা, আকাঙ্ক্ষা, আশ্রয় কুসুম কুসুম ভাষ্য, রাবীন্দ্রিক এবং এই গানের বুঝ যেন শুধু শিক্ষিতরাই বুঝে নেবে এবং তা পুঁজিবাদী এলিট সমাজের আব্রু (মানদণ্ড) রক্ষা করা রুচি নিয়ন্ত্রিত ও কঠিন শৃঙ্খলাপূর্ণ।

এভাবে সমাজের সংখ্যাগুরু অশিক্ষিত, সুবিধাহীন শ্রেণিকে অপর করে রাখার মাধ্যমে নিম্নবর্গের সামাজিক সমস্যা সামনে আসে না এবং নিম্নবর্গের শিল্পের সামাজিক স্বীকৃতিও জোটে না।

জমিন দিয়া দিমু বর্গা রে, এইবার জমিন দিয়া দিমু বর্গা

বিয়ে, পরিবার ধারণার যে পাশ্চাত্য প্রগতিশীলতার প্রজেক্ট যার মাধ্যমে নারীর পরিবারকেন্দ্রীক কাজ স্থির হয়ে পড়ে সংসারের কাজে। বিয়েপ্রথার মাধ্যমে পুরুষ তার বিপরীত লিঙ্গের মানুষের উপর যে যৌনতার অধিকারের সামাজিক স্বীকৃতি, আধিপত্যের অধিকার পায় তা শুধুমাত্র যৌনতাকেন্দ্রীকই থাকে না। পৌরুষের এই অধিকার হয়ে ওঠে নারীর সমগ্র যৌন শুচিতা, চাওয়া-পাওয়া ও সকল যৌন নৈতিকতার অধিকারের হর্তাকর্তারূপে আবির্ভূত এক চরিত্রে।

পুরুষ ঘরের বাইরে অর্থনৈতিক উৎপাদনের সাথে জড়িত থাকার মাধ্যমে নারীর যে গার্হস্থ্য অর্জন তার কোনো মূল্যায়ন পায় না। একই সাথে তার যৌন চাহিদাও চাপা পড়ে যায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। কিন্তু ঘাটে বাজারে পুরুষের যাতায়াত, আর ‘সাংসার চালানো’ শব্দের মতো অর্থনৈতিক মানদণ্ডে নিম্নবর্গের পুরুষ যখন পুঁজিবাদের যাতাকলে জীবিকার জন্য নগরমূখী হয় তখন নারী হয়ে ওঠে আরও একা। এই একা তার যৌন চাহিদার যে সামাজিক স্বীকৃতির বিয়ে মাধ্যম আর যৌন শুচিতার মানদণ্ড সে তখন মানে না। প্রেম, পরকিয়ার মাধ্যমে কখনো খুঁজে নেয় অন্য পুরুষ কিংবা কল্পনায়-গানে গানে খুঁজে নেওয়ার সাহস সঞ্চার করে।

 টাকার জন্য ঢাকায় যাবি, টাকাই কামাই কর গা

জমিন দিয়া দিমু বর্গা রে, এইবার জমিন দিয়া দিমু বর্গা।

নারী এভাবেই প্রকৃতির সাথে নিজেকে আত্তীকরণ করে। এই আত্তীকরণের মাধ্যমে নারী প্রকৃতির উপর আধিপত্য কায়েম করেনা বরং প্রকৃতির পরিচর্যা ও লালন করে নিজের শরীরের মতো। নতুন জীবনদানকারী হিসেবে নারীর যে সম্পর্ক জমিনের সাথে সেই সম্পর্ক পুরুষের ‘উৎপাদনশীল শিল্পায়ন ভাবাদর্শে’ আদর্শিত পুরুষতন্ত্রের অবমূল্যায়নের ও অস্বীকৃতির মাধ্যমে লিঙ্গীয় অসমতা তৈরি করে। অথচ ‘নতুন জীবনদানকারী হিসেবে নারীরাই মূলত সাহায্যদানকারী এবং প্রথম উৎপাদশীল অর্থনীতির আবিষ্কারক। তারাই সমাজ ও ইতিহাসের সামাজিক উৎপাদন ও সামাজিক সম্পর্কের নির্মাতা।’২

তাই তৃতীয় বিশ্বের নিম্নবর্গের নারী প্রকৃতির সাথে নিজেকে আত্তীকরণের মাধ্যমে যে নারীসুলভ প্রতিরোধ গড়ে তোলে পুরুষতান্ত্রিক ‘অবউন্নয়নের’ বিপরীতে সেখানে থাকে পূর্ব ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যা নিম্নবর্গের গানগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায়। এমন বেআব্রু চেহারার গান এখনো বাজে নিম্নবর্গের অঞ্চলে অঞ্চলে। কেউ কেউ লুকিয়ে ক্যাসেট বাজিয়ে, ঘরের আড়ালে গুনগুন করে একসময় গাইতো এইসব বেআব্রু গান।

গোপনে গোপনে বন্ধু হবে যে সকাল

তোমার ছোয়ায় ভালোবাসায় মন, হলো যে পাগল

আমার মুখে আছে বন্ধু তোমার মুখের দাগ

সোনা বন্ধু যাও এবার, মোরগ দেবে ডাক।

আসগর আলী পণ্ডিতের লেখা একটা জনপ্রিয় গানের সাথে উপরের লিরিকটির মিল পাওয়া যায়। বিবাহোত্তর প্রেমের যে বর্ণনা আসগর আলী পণ্ডিতের লেখা সে লিরিক আব্রু রক্ষা করা, নান্দনিক আড়াল আড়াল। এবং সে গানের শিল্পী ও শ্রোতারাও নান্দনিক, আব্রু রক্ষা করা সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা মানুষজন।

“বন্ধু পরবাসী, পরের ঘরে আসি,

এত ঘুমে কেন ধরে

কয়লা করে ধ্বনি, পোহাইল রজনী,

না ডাকি ননদিনীর ডরে”

দুইটা গানের লিরিক এ পার্থক্য স্পষ্ট কিন্তু ভাব একই। আসগর আলী পণ্ডিতের গান আব্রু রক্ষা করা, শৃঙ্খল, সুর ও মিউজিক শ্রুতিমধুর। অপরদিকে শিল্পী নার্গিসের গাওয়া গান সুর, লিরিক বেআব্রু, মিউজিক বিচ্ছিন্ন। তাই এই গান হয়ে ওঠে নিম্নবর্গের বিচ্ছিন্ন, এলোমেলো, শৃঙ্খলহীন জনজীবনের অনুসঙ্গ।

‘আমি জোয়ান একটা মাইয়া /বুড়া জামাইর কাছে আমায় বাবায় দিছে বিয়া’

সমাজের বিয়েকেন্দ্রীকতার ব্যাপারেও নারীর পুরুষ পাওয়ার অধিকার ঠিক করে দেয় পুরুষই। যৌনতার শাসন ও পারিবারিক নিগৃহীতে যাতে নারী কোনো প্রতিবাদ না করে এইজন্য পুরুষ বেছে নেয় অল্প বয়সের নারী। পুরুষের বয়স লুকাতে হয় না। সে রোজগার করলেই যথেষ্ঠ তার চাহিদা বর্তায় শুধু নারীর প্রতি আর নারীর চাহিদা ঠিক করে দেবে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। একইসাথে চলমান এই ভাবাদর্শের ফাঁদে পা দেয় অনেক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারীও।

দাম্পত্যকেন্দ্রীক মতাদর্শ ও সংসারকেন্দ্রীক ভবিষ্যৎ জীবন কাটানোর যে প্রক্রিয়া এসব পুঁজি করে পুরুষ সুযোগ নেয় নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার। সামাজিক যৌন নৈতিকতার সংজ্ঞায়নে নারীর শরীরের পবিত্র জ্ঞান, সম্ভ্রম, শুচিতা ইত্যাদি শব্দ অভিধায় যখন নির্ধারিত হয় তখন পুরুষের বিয়েপূর্বক নারীর শরীরের ব্যবহার নারীর কাছেই হয়ে ওঠে সর্বনাশের বস্তু। আশার কথা দিয়ে পুরুষের প্রতারণা এবং পুরুষতান্ত্রিক যৌনতার সীমানায় তখন নারীও এই ধারণাকে (নারীর শরীরকেন্দ্রীক সম্ভ্রমজ্ঞান) সত্য হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়।

 পুরুষজাতির প্রতি আমার নাই কোনো বিশ্বাস

তারা বিয়ার আশা দিয়া করে নারীর সর্বনাশ।

‘দাম্পত্যপনার মতাদর্শ নব্যগঠিত গৃহীপনার মতাদর্শের অংশ। নারী এই পরিকাঠামােতে ঘরণী, তার ভূমিকা নৈতিক, আদর্শিক নারী চৈতন্যের বিশাল জায়গা জুড়ে আমরা দেখতে পাই যৌন শুচিতা (sexual purity)। পুরুষের পরিচিতি এই পরিবার পরিকাঠামােতে আর্থিক। তার কাজের জায়গা বহির্জাগতিক (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক); তার শুচিতার ব্যাপার নারীর মত সংকটের নয়।’

সংকটের এই জায়গা থেকেও বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে নারীর যৌনতা। নিম্নবর্গের নারীর চিন্তাচেতনা ও ভাষায় যার প্রকাশ হয়েছে বিস্ফোরিতভাবে। দৈনন্দিন জীবনেও নিম্মবর্গের আচরণভঙ্গি, প্রথা, চলাফেরার ধরণের বেশিরভাগই ছিল কাউকে তোয়াক্কা না করার মতোন। শিল্পী নার্গিসের গানও কাউকে তোয়াক্কা করে না। একটা শ্রেণির কথা নির্দ্বিধায় বলে যায়।

শিল্পী নার্গিসের গানের লিরিকে দেখা যায় তার গানের নারী প্রেম করে, ব্যর্থ হয়,পুরুষ কিংবা ক্ষমতাবান লোকের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয় (আমায় বেবিওয়ালা খাইছেরে সামনে বসাইয়া); একইসাথে যৌনতার সরাসরি আচরণ করে। যৌনতাকেন্দ্রীক নারীর চাওয়া পাওয়া এবং এমন সরাসরি মন্তব্য বাঙলাদেশের আর কোনো শিল্পীর গাওয়া গানে নেই।

এইসব অবদমিত অঞ্চল থেকেও নারী তার গান, গল্প, কবিতায় নিজস্ব চাওয়া-পাওয়ার কথা জানান দেয়। নিম্নবর্গের গানে সে ভাষা উঠে আসে একদম বেআব্রু হয়ে, যেন চরাঞ্চলের রৌদ্রে ফাটা ফসলি জমির মাটির মতো একদম নিম্নশ্রেণির গানের এই ভাষা। যে গানের ভাষার সাঁতার শুধু নিজ নিজ অঞ্চলকেন্দ্রীক গড়ে ওঠা খাল, বিল, হাওড়, নদী, ধুধু মাঠের দিকে দিকে ছড়িয়ে ছড়িয়ে যায়।

 

টীকা

১. কর্তার সংসার (সায়দিয়া গুলরুখ ও মানস চৌধুরী সম্পাদিত)

২. প্রকৃতিতে নারী- বন্দনা শিবা

৩. লিঙ্গ শ্রেণি এবং অনুবাদের ক্ষমতা: বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্ত পরিবার ও বিয়ে — রেহনুমা আহমেদ ও মানস চৌধুরী

সহযোগী গ্রন্থ

মার্কসীয় বীক্ষায় নারীমুক্তি – শ্রী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়

উনিশ শতক: বাঙালী মেয়ের যৌনতা – অর্ণব সাহা

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *