December 23, 2024
কলামফিচার ২

যাদের কাছে সন্তানদের পাঠাচ্ছি, তারা নেকড়ে হয়ে উঠছে না তো?

মেহেদী হাসান ।। 


গল্পটা নিতে চাই রূপক হিসেবে। যাদের কাছে আমরা সন্তানদের পাঠাচ্ছি তারা নেকড়ে হয়ে উঠছে না তো?

হোজ্জা মাঠে গরু চরাচ্ছে। হঠাৎ বৈকালীন হণ্টনে রাজা ও তার উজির ঢুকলো মাঠে। এদের আগমনে গরুটা হঠাৎ “হাম্বা হাম্বা” শব্দে চিৎকার শুরু করলো। হোজ্জা বিব্রত। রাজা হোজ্জাকে আরও বিব্রত করার জন্য কাছে এসে বললো, ‘গরুতো তোমারই মতো দেখছি। তা তোমাকে গরুটা কী বললো, হোজ্জা?’

“হুজুর, গরুটা আমাকে বললো, মালিক, সাবধান। মনে হয় মাঠে দুটো নেকড়ে ঢুকেছে। এবার আমাদের ছিঁড়ে খাবে।”

এ গল্পের রূপকটা ভেঙে দিলে বেরিয়ে পড়ে একটা বিশেষ অর্থ। এখানে মাঠ যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় হয় আর মালিক যদি সন্তানের অভিভাবক হয়, গরু যদি ছাত্রী হয় আর রাজা-উজির যদি ছাত্রীর শিক্ষক হয়, অর্থটা কেমন হয় বলুন তো? সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলি থেকে গল্পটা মনে এলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগকারী তার ছাত্রী। এরকম অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আগেও উঠেছিল।

আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নারীর জন্য কতটা নিরাপদ, এখানে ‘কাস্টিং কাউচ’ কতটা নির্মম মাত্রায় চলে এ নিয়ে আমরা কতটুকু খবর রাখি! মাঝে মধ্যে হালকা ঝড় ওঠে, তারপর বুদবুদের মতো মিলিয়ে যায়। কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষের মানসিকতার একটা বহিঃপ্রকাশ এসব ঘটনা।

সম্প্রতি দেশের পত্রিকাগুলোতে এরকম দুটো ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। অভিযুক্ত একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তারকা-শিক্ষক। তিনি জাতীয় পর্যায়ের একাধিক পুরস্কারে পুরস্কৃত। তিনি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন। ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন করার জন্য তিনি ক্ষমা চেয়েছেন, ক্ষমা পেয়েছেন। এর আগেও তিনি এরকম অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন একাধিকবার। সে সময়গুলোতে বিষয়টা এমনভাবে আলোচনায় আসেনি তাই তিনি অব্যাহতি পেয়ে গেছেন নীরবে-নিভৃতে।

একটা ঘটনা কতটুকু প্রকাশ পাবে, কখন প্রকাশ পাবে, কেন প্রকাশ পাবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করে যারা তারা ক্ষমতাবান কিন্তু ক্ষমাশীল। সবক্ষেত্রে আমরা অত্যন্ত দয়াশীল। কিছুদিন আগেও মরক্কোর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে এ ধরনের অপরাধে ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আমাদের এখানে তেমনটা হয় নি। এসব ক্ষেত্রেও আমরা ক্ষমাশীল। ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ বটে। সে জন্য আমরা খুব আত্মতৃপ্তিতে ভুগি। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের একটা উপন্যাসে পাচ্ছি, ধর্ষণের বিচার চাইতে আসা নারীর পক্ষে উকিল বলছেন, ‘অভিযুক্ত এ ধরনের আচরণ আগেও করেছে। একটা ঘটনা মামলা মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়িয়ে অর্ধ-সমাপ্ত অবস্থায় হারিয়ে যাওয়া এই ধর্ষক দ্বিতীয় ঘটনা ঘটাতে সাহস পেয়েছে।’ বিচারহীনতার এ-সংস্কৃতি নতুন নতুন ঘটনার জন্ম দেয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্রী আরেক সিনিয়র প্রফেসরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। মেয়েটি কাস্টিং কাউচের শিকার। প্রফেসরের ইচ্ছে অনুযায়ী বিছানায় যেতে অস্বীকার করায় তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়া হয় নি। এক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেটা পড়ার ইচ্ছে করে নি আর। আমি ধরে নিচ্ছি অস্বীকারের সংস্কৃতি এখানে নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে আমার প্রথম উপদেশ হলো নারীর সিদ্ধান্ত নারীকে নিতে হবে। তিনি গোপনীয়তার দেয়াল ভাঙবেন কি না? আর একটি গল্প মনে পড়লো। এটাও শুনেছি এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মুখে। একটু অশ্লীল। কিন্তু কী করি! লিখতেই বসেছি যখন অশ্লীল প্রসঙ্গ নিয়ে তখন মুখ ঢেকে আর কী লাভ! ‘জলে নামবো, জল তো ছোঁব চুল ভেজাবো না’ – এমনটা লোকগানে সম্ভব কিন্তু বাস্তবে তো সম্ভব নয়। কায়েস আহমেদের একটা গল্প পড়েছিলাম সেই কবে! এখনো সংলাপটা ভুলি নি। আর সব ভুলে বসে আছি। মেয়েটা তার সিনিয়র সহকর্মীর একটা সংলাপ উচ্চারণ করেছে অন্য আরেকজনকে সাবধান করতে: ‘জানিস, শান্তিদি বলতো, পুরুষ মানুষগুলোকে কখনো বিশ্বাস করিস নে, ওরা মেয়েদের দেখলে ভাবে, ইস! এটাকে যদি বিছানায় শোয়ানো যেতো! আহা, শান্তিদি’ – আমার এখনকার গল্পের অর্থও তাই। বিয়ে বাড়িতে খুব ভিড়। এক মেয়ে বিয়ে বাড়িতে রাতে থাকার জায়গা পাচ্ছিল না। সবাই মিলে বয়স্ক খালুর রুমে ওর থাকার ব্যবস্থা করলো। ভেবেছ এ রুমটা সবচেয়ে নিরাপদ মেয়ের জন্য। সকালে দেখে মেয়েটার মুখ কালো। সবাই জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে?’ মেয়েটা বললো, ‘ব্যাটা ছেইলে কি কোনোদিন খালু অয় নি?’ তাই সাহস করে রুখে দাঁড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে ব্যাটা ছেলেরা কখনোই খালু হয় না।

‘না, মতলব না।’ এ-ছোট সংলাপটা হিন্দি ‘পিংক’ ছবির শেষ সংলাপ। অমিতাভ বচ্চন কঠিন একটা অভিব্যক্তি নিয়ে যখন কথাটা বলেন তখন সবাই চুপ হয়ে যায়। একটা মেয়ে ১৯ বছর বয়সে কৌমার্য হারায়। তার জন্য মেয়েটির পুরুষ সঙ্গীকে জোর করতে হয় নি, টাকা পরিশোধ করতে হয় নি। যা হয়েছে সবটা দুজনের ইচ্ছায়। সে মেয়েটি পরে অন্য এক ঘটনায় ধনীর দুলালদের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়। মেয়েটির অসহায়ত্বে অমিতাভ এগিয়ে আসে। ‘খারাপ মেয়ে সুতরাং তাকে যখন ইচ্ছে তখন, যে ইচ্ছে সে, যা ইচ্ছে তা, করতে পারে’ – এমন বয়ান যখন সামনে চলে আসে, তখন অমিতাভ আদালতকে কথাটা বলেন। ‘না, মতলব না।’ অর্থাৎ না-কে না হিসেবে নিতে হবে। হ্যাঁ-কে হ্যাঁ। কৌমার্য হারানোর সময় যা হয়েছে তা স্বেচ্ছায় হয়েছে। এখন যা হয়েছে তা অনিচ্ছায়। সুতরাং নারী নয়, মানুষের ইচ্ছেকে মূল্য দিতে হবে। এটাই ছিলো অমিতাভের বক্তব্য। সমস্যা অন্য জায়গায়। মানুষের লিঙ্গ-বিভাজনের শারীরিক পরিচয়ে। লিঙ্গ নারীকে অপর বর্গ হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে নারীর নির্মাণ ঘটে পুরুষের হাতে। সে জন্য নারীর শরীর পুরুষের জন্য নির্মিত হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় শুদ্ধতা-অশুদ্ধতার মূল্যবোধ, যুক্ত হয় সতীত্বের-অসতীত্বের ধারণা। এতে সমাজের কলঙ্ক থেকে বাঁচতে নারী পুরুষের অপরাধকে নিজের মধ্যে টেনে নেয়। সে নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করে। চেপে যায় অপরের অপরাধ। টেনে নেয় নিজের মধ্যে। তৈরি করে বিষন্নতার দেয়াল। এ ধরনের ঘটনা আকচার ঘটছে। কিন্তু এ দেয়াল ভাঙতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ দুজন মহীয়সী নারীকে শ্রদ্ধা জানাই। তারা সাহস করে অভিযোগ তুলে ধরেছেন। দেয়ালে আঁচড় দিয়েছেন। আগামীতে বাকিরা এ দেয়াল ভাঙতে শুরু করবেন আশা করি।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *