মায়েদের থ্যাংকলেস জব শেষ হবে কবে?
তাসনিয়া আল সুলতানা ।। আমি এখন বেশ বড় হয়ে যাওয়ার পরও আমার অনেক কাজ আমার আম্মু করে দেন। বলে রাখি, আমি রান্নার তেমন কিছুই জানি না এখনও। কেন জানি ওই কাজটা আমার আসে না, ঘরোয়া কাজের প্রতি আগ্রহ কাজ করে না তেমন।
না, এটা কোন ক্রেডিট নিয়ে বলছি না আমি। আমি জানি, রান্না বা ঘরের কাজ করতে জানাটা একটি বেসিক সার্ভাইভিং স্কিল। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য এটি জানা খুব অত্যাবশকীয় একটি বিষয়। কিন্তু নিত্য কাজের চাপে ইচ্ছাটা একেবারেই হয় না। রান্নায় আমার জ্ঞান একেবারেই শূণ্য হলেও ঘর মোছা বা গোছানোর কাজে আমি হাত লাগাই, যখনি সময় পাই। উদ্দেশ্য একটাই- আম্মু একটু হলেও রিলিফ পাক।
কিন্তু আমার মা, তিনি একটানা ৩২ বছর ধরে তার সংসারের জন্য, ছেলেমেয়েদের জন্য খেটে যাচ্ছেন। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, এই মানুষটার বয়স হচ্ছে। বয়সজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়াটা খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। ভাবি, করুণাময় না করুক, আব্বুর মতো আম্মুরও যদি কিছু হয় তখন আমার কী হবে? এই চিন্তা মনে আসতে না আসতেই প্যানিক অ্যাটাক শুরু হয় আমার। মনে হয়, পাগল হয়ে যাবো।
দিনের পর দিন মাতৃত্বকে আমরা ওভাররেটেড করে ফেলেছি। জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত সংসারের সকল কাজ, সন্তান লালন-পালন সবকিছু করার দায় যেন মায়েদের- এমন একটি অদৃশ্য অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে কিছু বিজ্ঞাপনে দেখি স্বামী গর্ব ভরে বাসার মেহমানদের বলে “বউ আমার হোম মিনিস্টার!” এই প্রশংসার ভেতর খুব সুক্ষ্মভাবে পুরুষতান্ত্রিকতার বীজ লুকিয়ে আছে। অর্থাৎ স্ত্রীকে মহিমান্বিত করার ফাঁকে “হোম মিনিস্ট্রি” এর সমস্ত দায়িত্ব বর্তানো হচ্ছে একা স্ত্রী অর্থাৎ মায়ের উপর। আর মায়েরাও এই মহান গুরুদায়িত্ব হাতে পেয়ে বেজায় খুশি। “মায়ের নাইকো কোন তুলনা” – এই মহান লাইন মননে-মস্তিষ্কে একেবারে গেঁথে নিয়ে তাদের সমস্ত জীবন উৎসর্গ করে তারা নেমে পড়ে এক মহাসমুদ্র দায়িত্ব পালন করতে, যেন সকল দায়িত্ব পালনের দায় কেবলমাত্র তার একার!
সন্তান জন্মদানের পর বেশিরভাগ মায়েরাই পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে ভুগে থাকেন। এই ডিপ্রেশনের তীব্রতা মাঝে মাঝে এতোটাই ভয়াবহ মাত্রায় চলে যায় যে এর ফলস্বরূপ মা তার নিজের সন্তানকে মেরে ফেলার এমন নজিরও পৃথিবীতে আছে। অথচ তিনি যে পূর্বপরিকল্পিতভাবে তার সন্তানকে মেরে ফেলেছেন বিষয়টা এমন নয়। প্রসব পরবর্তী সময়ে একজন মায়ের শরীরের পাশাপাশি মনেও বেশ প্রভাব পড়ে। এই সময়ে তার শরীর এবং মনের প্রয়োজন অধিক যত্নের, আদরের। অথচ আমাদের দেশে সন্তান জন্মদানের পর থেকে দেখা যায়, ভালো মা হতে পারার জন্য কী এক প্রতিযোগিতা! একই সাথে শুরু হয় পরিবারের জাজমেন্টাল মানুষের তীর্যক আচরণ!
বাচ্চার ঠিকমতো খাচ্ছে না? – নিশ্চয়ই মা বাচ্চাকে ঠিকঠাক খাওয়ার অভ্যাস করিয়ে নিতে পারে নাই। বাচ্চার ঠান্ডা লাগলো? – মা তো নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, বাচ্চার দিকে তাকানোর সময় কই? বাচ্চা কাঁদছে? – নিশ্চিত মায়েরই কোন গাফিলতি আছে এখানে।
এতোসব জাজমেন্টাল বক্তব্য দিতে দিতে সবাই ভুলেই যায়, এই মা-ও একজন মানুষ। তার শরীর আছে, সেই শরীরের যত্ন নিতে হয়। তার মন আছে, সেই মনের খোরাক পূরণ না হলে সে অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু মাকে নিয়ে ভাবার এতো সময় কোথায়? তিনি তো দশভুজা! তিনি সন্তান সামলাবেন, তিনি রান্নাও করবেন, তিনি ঘরও গোছাবেন, স্বামী এবং তার পরিবারের সেবাও করবেন, বিনিময়ে সবার কটু কথাও শুনবেন। আর হ্যাঁ, সবার দিকে খেয়াল রাখতে রাখতে মহানুভবতার পুরষ্কার হিসেবে পুষ্টিহীনতাসহ বিভিন্ন রোগেও তিনি আক্রান্ত হবেন।
অথচ বাচ্চা লালন-পালনসহ সংসারের যাবতীয় কাজ করার দায়িত্ব স্বামী-স্ত্রী উভয়ের উপর বর্তায়। স্ত্রী যদি সন্তান লালনপালন করেন তাহলে স্বামী অন্তত পক্ষে ঘর গোছানোর কাজটা করে দিক। স্ত্রী যদি রান্না করে তাহলে থালাবাসন ধোঁয়ার কাজটা তার স্বামী করুক। সংসারের সকল কাজ স্ত্রী বা মায়ের একার নয়, এই কথা ছোটবেলা থেকে সন্তানকে বোঝানোর দায়িত্ব বাবা এবং মা উভয়েরই। কিন্তু তা করে মাতৃত্বকে ওভাররেটেড আর জেনারালাইজড করতে করতে এটিকে একটা অত্যাবশকীয় অথচ Thankless job -এ পরিণত করা হচ্ছে। এটি বন্ধ না করা হলে হুদাই একটা দিন মা দিবস হিসেবে পালন করারও কোন মানে দেখি না।
সবাইকে মা দিবসের শুভেচ্ছা।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]