May 15, 2024
মন ও জীবন যাপন

পুরুষটি কি একজন ওকফিশার?

মারুফা ইয়াসমিন অন্তরা ।।

যুগ যুগ ধরেই প্রতিযোগিতামূলক প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষ ম্যানিপুলেশনকে স্বার্থ উদ্ধারের এক নীরব হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। সম্পর্কের সহজলভ্যতার এই সময়টাতে মানুষ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার থেকে কম্প্যাটিবল সঙ্গীকে বগলদাবা করে পরিবার, ফ্রেন্ড সার্কেল এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শো-অফ করতেই বেশি আগ্রহী। কিন্তু শিক্ষা, আধুনিকতা, আত্মসম্মানবোধ, নারীবাদ প্রভৃতির বরাতে মেয়েরা বিশেষ করে শিক্ষিত, আত্মনির্ভরশীল মেয়েরা পশ্চাৎপদতা ও পুরুষ সঙ্গীর প্রতি আনুগত্যের পুরুষতান্ত্রিক ছক থেকে বেরিয়ে এসেছে। আর এখান থেকেই জন্ম নিয়েছে পুরুষজাতির ম্যানিপুলেশনের আপডেটেড হাতিয়ার ওকফিশিং।

ম্যানিপুলেশন আসলে এক ধরনের মাইন্ড গেইম। অতি চালাক, বুদ্ধিমান কিন্তু কুটিল পুরুষরাই এই মাইন্ড গেইম প্লেয়ার। পারিবারিক এবং পারিপার্শ্বিক কালচারের দরুন ঘোরতর মিসজেনিস্ট হয়ে বেড়ে ওঠা পুরুষেরা যখন সার্বিক দিক বিবেচনা করে সামাজিক স্ট্যাটাস বৃদ্ধির জন্য সেলফ ডিপেন্ডেন্ট মেয়েদেরই পারফেক্ট বলে মনে করে কিন্তু মনের মাঝে বছরের পর বছর লালন করা মিসজেনিকেও ত্যাগ করতে অস্বীকার করে, ঠিক তখনই তারা হয়ে ওঠে একেকজন ওকফিশার। আরো ভেঙে বলতে গেলে, সূক্ষভাবে নিজেদের ভণ্ডামিকে সুচারুরূপে কপটতার আড়ালে আবদ্ধ করে পরিমার্জিত সুশীল রূপে আত্মপ্রকাশ করা ব্যক্তিরা সচেতনভাবেই একেকজন ওকফিশার।

লেখক সেরেনা স্মিথ সর্বপ্রথম “ওকফিশিং” শব্দটির অবতারণা করেন। তার একটি নিবন্ধে এক পরিস্থিতির বর্ণনা করার ক্ষেত্রে এই শব্দের আবির্ভাব ঘটে। ওকফিশিং শব্দটি দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যারা “জাগ্রত” হওয়ার ভান করে অর্থাৎ সামাজিক এবং জাতিগত ন্যায়বিচার সম্পর্কিত সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার নাটক করে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং লেখক গায়ানি ডিসিলভা’র মতে, ‘ওকফিশিং হল, যখন কোনো ব্যক্তি কথোপকথনের সময় বিভিন্নভাবে প্রগতিশীলতা নিয়ে অস্পষ্ট প্রশ্ন করে এবং অপর ব্যক্তির সেই বিষয়ের উপর আগ্রহ ও যুক্তির অবস্থান বুঝে নিয়ে সেই অনুযায়ী নিজেকে উপস্থাপন করে।’ আদতে রক্ষণশীল চিন্তাধারার বাহকরা বন্ধুত্ব পাতাতে, সঙ্গীকে প্রভাবিত করতে, সম্পর্ক গড়তে অথবা যৌন ঘনিষ্ঠতা তৈরি করার জন্য ওকফিশিং-এর আশ্রয় নেয়।

ওকফিশিং আসলে অন্যকে ম্যানিপুলেট করার বেশ পুরোনো পদ্ধতি। অনেক বছরের চেনা জানা, সখ্যতার বিশ্বাস হুট করেই ভেঙে যেতে দেখা যায় অহরহ। বলা যায়, অধিকাংশ মেয়েই তাদের জীবনের কোনো এক পর্যায়ে এমন কুটিল ওকফিশারের পাল্লায় একবার না একবার পড়েছেনই। নিচের সারমর্মগুলো এমনই কিছু ভণ্ডামির উদাহরন।

– ইউনিভার্সিটি লাইফের খুব কাছের বন্ধু যার সাথে সামাজিক-রাজনৈতিক অন্যায়, অনিয়ম ও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে হাজারবার কথা হয়েছে; কথা হয়েছে জেন্ডার ডাইভার্সিটি আর ইকুয়ালিটি নিয়ে। সেই বন্ধুই বছরখানেক পর কর্মক্ষেত্রে আশানুরূপ উন্নতি না করতে পেরে বলেছে – ‘শুধু মেয়ে বলেই অফিস অমুককে ফিল্ডওয়ার্ক দেয় না; কোনো এক্সপার্টিস নাই, শুধু শুধু এসি রুমে বসে আমার থেকে বেশি টাকা বেতন নেয়।’

– টকিং স্টেইজে পার করে পছন্দের মানুষটির সাথে যখন আরেক ধাপ এগিয়ে পথচলা শুরু হয় তখন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো একই মতাদর্শ, জীবনধারা, ধর্মনিরপেক্ষতা, জেন্ডার ইক্যুইটি নিয়ে বুলি কপচানো মানুষটি অন্য ধর্মাবলম্বীদের গালি দিয়ে ‘দিন শেষে আমি খুব ধার্মিক’ বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে জাত চিনিয়ে দেয়।

– নারীবাদ এবং নারী অধিকার নিয়ে মাঠেঘাটে সংগ্রামী-প্রতিবাদী অ্যাক্টিভিস্ট বাড়ি ফিরে মায়ের মুখে ভাতের থালা ছুড়ে মেরে নিজের অবস্থান জাস্টিফাই করে। নারী সঙ্গীর সাথে ঝগড়াকে দোষারোপ করেই যেন গঙ্গা স্নানসম পূন্যি অর্জন হয়ে যায়।

– ক্যাজুয়াল রিলেশনশিপে অভ্যস্ত ধার্মিক ব্যক্তিটি কালিম্বা (মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট) গিফট হিসেবে নিতে অপারগতা প্রকাশ করে – বাড়িতে ফেরেশতা আসবে না অজুহাতে।

– ওয়েস্টার্ন ড্রেসে অভ্যস্ত মেয়ের সাথে প্রেম করে সুযোগমত বাপের মস্ত পদমর্যাদার দোহাই দিয়ে সুশীল পুরুষটি গার্লফ্রেন্ডকে ওড়না এবং সামাজিক মর্যাদার গুরুত্ব বোঝায়।

– সেক্যুলার মতাদর্শ নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনাকারী ব্যক্তিটি সেক্সিস্ট জোক্সকে জাস্টিফাই করে ‘ক্যুল ড্যডু’ সেজে থাকে। লেইম জাস্টিফিকেশন হিসেবে তাদের বড় গলায় বলতে শোনা যায়, অনেক মেয়েই এসব জোক্সে হেসে কুটি কুটি হয়।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওকফিশারদের সনাক্ত করা বেশ কঠিন কারণ ওরা সাধারনত টার্গেটেড নারীর পছন্দ অনুযায়ী নিজেকে উপস্থাপন করে। তবে অবশ্যম্ভাবীভাবেই ওকফিশারদের কথা এবং কাজের গড়মিল উল্লেখযোগ্য। তাই লং টার্ম অথবা শর্ট টার্ম যেকোনো সম্পর্কে জড়ানোর আগে সিলেক্টেড পুরুষের সাথে বিভিন্ন টপিক নিয়ে আলোচনা করুন, প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে যাচাই করুন পুরুষটি জেনুইন নাকি ছদ্মবেশী একজন ওকফিশার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *