November 21, 2024
সম্পাদকীয়

পিতৃতন্ত্র ভিকটিম নারীকেই অপরাধী বানায়, আর সমাজকে বানায় ভিকটিম

‘ভিকটিম’ শব্দটার ভেতরে একটা করুণা মেশানো অবজ্ঞা আর নাক সিঁটকানো ব্যাপার আছে। আছেই। অথচ ভিকটিম তা নয়। ভিকটিম হলো যার উপর কোনো অপরাধ করা হয়েছে। যাকে কষ্ট দেয়া হয়েছে। ক্ষতি করা হয়েছে। যার উপরে কোনো ভয়াবহ ঘটনা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। সে হলো অপরাধমূলক ঘটনার শিকার। ক্ষতিগ্রস্ত। ভিকটিম করুণার পাত্র/পাত্রী নয়।

কিন্তু মজাটা হলো আমাদের সমাজে ভিকটিম যদি হয় নারী, তবেই সে করুণার পাত্র তো বটেই, একই সাথে সে নিজেও অপরাধী, কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট অপরাধে তারও সংযুক্ততা আছে – এমন ধরে নেয়াই চল। সেই সংযুক্ততা নারীর মিউচুয়াল সেক্স থেকে শুরু করে ধর্ষণ, পোশাক থেকে শুধু করে নারীর পেশা – যেকোনো দিক দিয়ে হতে পারে।

আমাদের সমাজে পুরুষদের একটা চরিত্রগত ব্যাপার আছে। নারীকে নিয়ে খেলাধুলা করা। এই খেলাধুলার ভেতর দিয়ে নারীকে ব্যবহার করার প্রবণতা এবং ব্যবহার শেষে নারীকে ছুঁড়ে ফেলে নতুন নারীর দিক হাত বাড়ানো। পুরো প্রক্রিয়াটাই পুরুষের জন্য সহজ, কারণ ওই ভিকটিম বিষয়টিকে করুণা ও অপরাধের অংশীদার- এই দুইয়ের ব্লেন্ডের ভেতরে ফেলে দিয়ে নারীকে নিজেকেই নিজে অপরাধী ভাবার অভ্যস্ত মনোস্তত্ত্বের মুখোমুখি করে দিয়ে ভেগে যাওয়ার সুযোগ পুরুষের জন্য সর্বত্র আছে। আর পুরো সমাজ তো আছেই। নারীকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফানাফানা করে দেবার জন্য।

তাই ভিকটিম শেষ অব্দি অপরাধী। ভিকটিম যদি অপরাধীই হয়, তাহলে ন্যায়বিচারের আর চাহিদা থাকে না। পুরা সমাজের চোখে ভিকটিমই অপরাধী আর সমাজ হলো ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ ভিকটিম যাকে বলা হচ্ছে সেই নারী সমাজকে মানে না। মানে হলো এখানে ঘুরায়ে প্যাচায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সমাজ। নারী না।

পিতৃতন্ত্রের প্যাঁচটা দেখছেন? কেমন দারুন এক কৌশল ফেঁদে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে ব্যবসা করে যাচ্ছে। ক্ষমতা ধরে রাখছে। এই যে পিতৃতান্ত্রিক কৌশলে ভিকটিমহুডকে ঘুরায়ে দেয়া, নারীর ভিকটিম অবস্থাকে করুণামিশ্রিত করে ভিকটিম নারীকেই অপরাধে সংযুক্ততার ফাঁদে ফেলে পুরুষের সমাজকেই ক্ষতিগ্রস্ত দেখানো – এইটা করতে পিতৃতন্ত্রকে যা করতে হয়, তা হলো পিতৃতান্ত্রিক দর্শন, আদর্শ, মতাদর্শ, চেতনা ইত্যাদিকে গুলিয়ে ঘুটে পাকিয়ে একখানা জাজমেন্টাল ট্যাবলেট বানিয়ে সমাজের সব লেভেলে খাইয়ে তৈরি করে রাখা। পুরা সমাজ যখন জাজমেন্টাল হয়ে যায়, তখন পিতৃতান্ত্রিক আদর্শের বাইরে নতুন ভাবনা ঢোকার, বিভিন্ন পারস্পেক্টিভে ঘটনা দেখার সুযোগ থাকে না। আর পিতৃতান্ত্রিক আদর্শে এত কিছু দেখারও তো কিছু নেই। পিতৃতন্ত্র একমুখী। এককভাবে পুরুষের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা এবং নারীর অধীনতা ওপরাধীনতায় বিশ্বাসী। এখানে সাম্যের কোনো অস্তিত্ব নেই। পুরোটাই পুরুষের আনন্দ ও উপভোগের নিমিত্তে। ফলে এখানে নারীর ক্ষতিগ্রস্ত হবার ঘটনা যদি পুরুষের স্বার্থ ও আনন্দের কারণে ঘটে, তবে তাতে পিতৃতন্ত্র অপরাধ দেখেনা।

এখন রাষ্ট্রকাঠামো গণতন্ত্র, সাম্য, সমতা ইত্যাদির গান গাইছে। সমাজ কিন্তু গাইছে না। সমাজ যা বোঝে, তার নাম পিতৃতন্ত্র, শ্রেণিভেদ ও ক্ষমতা। সমাজ দাঁড়িয়ে আছে এখনও এই কাঠামোর উপরেই। রাষ্ট্রের সাথে তার আনুষ্ঠানিক সংঘর্ষ ঘটছে বটে, কিন্তু তাতে সমাজের সমস্যা হচ্ছে না। কারণ রাষ্ট্রকাঠামো কাগজে কলমে সমতার কথা বললেও, কাঠামো গঠন ও পরিচালনায় যারা আছে, তারা ওই অসমতাবাদী পিতৃতান্ত্রিক চিন্তার লোকেরাই। ফলে আনুষ্ঠানিক কাঠামো যাই লেখা থাকুক, প্রয়োগে সমাজের দিকেই কাঁটা ঘুরে যায়। আর তাতে বিপুল সমর্থণ জোটে। কারণ সমাজকাঠামোর ভেতর থেকে উঠে আসা নীতিনির্ধারকরাই নারী ও পুরুষের অবস্থান নির্ধারণ করে দেয়। কাগজে কী লেখা আছে সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ থাকে না। প্রয়োগও হয় না।

সমাজকাঠামোয় চিন্তাগত, আদর্শগত, মনোস্তত্ত্বগত পরিবর্তন না আনলে রাষ্ট্রকাঠামোয় সমতার প্রয়োগ কখনো সম্ভব হবে না।

বোধোদয় হোক। সবার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *