December 24, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

আমাদের বনসাই জীবন

নাজিয়া হোসেন অভি ।। কথা হচ্ছিলো সেদিন মেয়েদের স্বাধীন চিন্তা নিয়ে, মেয়েদের কি নিজের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, স্বেচ্ছায় কোনো সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা কি সমাজ তাদের দেয়? মেয়েদের কি নিজের কোনো জগৎ থাকতে পারে? সমাজ কি সেটা ‘অ্যালাউ’ করে? কোনো মেয়ে বিয়ের পর যদি নিজের জগতে কিছুটা ডুব দিতে চায়, সেই স্পেস কি তার সঙ্গী, শ্বশুরবাড়ি তাকে দেয়? সমাজ কি সমালোচনার বাইরে রাখে? এই ভাবনাগুলো ভাবতে গিয়ে প্রথমেই মনে হলো, প্রশ্নটার মধ্যেই তো উত্তর দেয়া আছে। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের ক্ষেত্রে ‘অ্যালাউ করা’, ‘সমাজের স্বাধীনতা দেয়া’ এই বিষয়গুলো আসবে কেন? একজন মানুষের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা তো তার জন্মগত অধিকার হবার কথা। কিন্তু যখন এমন মৌলিক বিষয় নিয়ে এতগুলো প্রশ্ন চলে আসে, তার মানে এখানে একটা বিরাট কিন্তু আছে। আর এই কিন্তুটা কিন্তু যুগ যুগ ধরেই চলছে আমাদের সাথে। ব্যাখ্যা দিতে কিছু গল্প বলি।

গল্প ১: মেয়েটি তার ২০/২১ বছর বয়সে একজনকে ভালোবাসলো, ছেলেটিও। তখন মেয়েটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে আর ছেলেটি ব্যবসা করছে। সম্পর্কের পাঁচ ছমাস পরে মেয়েটি তার পবিবারকে জানালো সে একজনকে পছন্দ করে, ছেলে ব্যবসায়ী। মেয়েটির পরিবারের প্রথম কথা ছিল, নিজের পছন্দে ভালোবেসে কাউকে বিয়ে করা যাবেনা এবং কোনো ব্যবসায়ী ছেলের সাথে তো আরো নয়। কেন নয় সেই প্রশ্নের উত্তর কেউ দেয়নি। হয় ছেলেটিকে তার ছাড়তে হবে নয়তো লেখাপড়া, বাসার বাইরে যাওয়া সব ছাড়তে হবে। সদ্য কৈশোর পেরুনো একটি মেয়ে বোধহয় তার সমস্ত জীবনীশক্তি এক করে, সাহস সঞ্চয় করে পরিবারকে বলেছিল পছন্দের মানুষটার কথা কিন্তু মানসিক পীড়ন আর  চাপে নিজের মনটা মেরে ফেলে পরিবারকেই বেছে নিয়েছিল শেষ পর্যন্ত।

গল্প ২: মেয়েটি তার বিয়ের ২/১ সপ্তাহের মধ্যেই বুঝতে পারলো যে যার সাথে তার বিয়ে হয়েছে তার পক্ষে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক , আর্থিক কোনো ধরণের স্বাচ্ছন্দ দেয়াই সম্ভব নয়।  পরিবারের কাছে আশ্রয় চেয়ে  আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা বলতেই প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, আমাদের পরিবারের মেয়েরা ডিভোর্স দেয়না। যা হয়েছে মানিয়ে নাও। মানসিক শান্তি নির্ভর করে তোমার মানিয়ে নেবার ক্ষমতার উপরে। আর্থিক শান্তি এখন নেই তো কি হয়েছে ভবিষ্যতে হবে। সবার তো আর সমান ঘরে বিয়ে হয় না এসব নিয়ে এত ভেব না। আর শরীর? ছিঃ শরীরের জন্য বিয়ে থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছো? আমরা তোমাকে এই শিক্ষা দিয়েছি। অবশেষে সেই মেনে নেয়ার পালা। অতঃপর তাহারা অসুখে অশান্তির দিনাতিপাত করিতে লাগিলো।

গল্প ৩: এই গল্পটার লেজ হিসেবে ছোট্ট একটা গল্প বলি, আমার এক বন্ধু তার অনেক বছরের সংসার ছেড়ে বের হয়ে এসেছে। এই মেয়েটির সংসার জীবনে সে তার সঙ্গীকে পরকীয়ায় জড়াতে দেখেছে ৩ বার।  সাথে সাথে না হলেও কয়েক বছর পর মেয়েটি সাহস সঞ্চয় করে বের হয়ে এসেছে। তারপর থেকে তাকে প্রতিনিয়ত শুনতে হচেছ এতদিন তো মেনে নিয়েছো সব কিছু, হঠাৎ কী হলো যে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হলো?

গল্প ৪: আরেক বন্ধু ক্যারিয়ারে সফল একজন নারী, কাজের জায়গার নানা রকম অসুবিধার জন্য চাকরিটা বদলে ফেলতে চায়, কিন্তু যতবারই সেই চেষ্টা করতে যায় প্রতিবারই একই ধরণের কিছু বাধার কারণে আর চাকরি আর বদল হয়না। ওর স্বামী চাননা ও কাজ করুক, পরিবারের সবারই কোনো না কোনো মন্তব্য থাকে যেমন এত দূরে কাজের জায়গা হওয়া যাবে না, তুমি সন্ধ্যার পরে বাইরে থাকতে পারবে না, বাচ্চাদের দেখবে কে ইত্যাদি ইত্যাদি।

গল্প ৫: দেশে ফিরে খুব ছোটবেলার একজন বন্ধুকে নিয়ে ঢাকার কাছে একটা রিসোর্টে বেড়াতে গেলাম বছর দুয়েক আগে। এইখানে অনুমতির একটা ব্যাপার ছিল। এই মধ্যবয়সে এসেও আমাদের দুই  বন্ধুর অনুমতি মিললো কোনো পুরুষ ছাড়া একা বেড়াতে যেতে কারণ রিসোর্টটি আমাদের পরিচিত একজনের, সেইসাথে আমি ওর পরিবারের খুব এ আস্থাভাজন একজন। সে যাক, মূল কথা হলো দুই বন্ধু মিলে বেড়াতে গিয়ে প্রাণ খুলে গল্প করার কোনো সুযোগ হলোনা, সারাদিন ওর ফোনে ওর শ্বশুর শাশুড়ি, মা, বোন, ভাই; এক পর্যায়ে বাসায় পরেরদিন সকালের নাস্তা কী হবে সেই সংক্রান্ত জটিলতাও রিসোর্টে এসে মেটাতে হলো। দিনশেষে টের পেলাম নাহ রিসোর্টে আমাদের দুই বন্ধুর আসা হয়নি, আমরা এসেছি পুরো পরিবার সাথে নিয়ে, আমাদের নিজেদের জন্য কোনো সময় নেই, কোনো স্পেস নেই।  এই গল্পগুলোর প্রতিটিই সত্য গল্প। সেই সাথে উপরের প্রশ্নগুলো সহজ আর  উত্তর তো জানা। উত্তরটা ‘না’, কিন্তু কেন না ?

আমাদের সমাজে এনসাইক্লোপেডিয়া সাইজের একটা নিয়মের বই আছে, নিয়মের গন্ডির বাইরে গেলেই সমাজ বিদ্রোহ করে, শুরু হয়ে যায় সমালোচনা। সমাজের আগে সমালোচনা, বাধা, তিরস্কার এই সব কিছু শুরু হয় পরিবার থেকে।

খুব ছোটবেলায় শিশুদের মেন্টাল কন্ডিশনিং হয়; আমাদের সচেতন কিন্তু বেশির ভাগটাই অবচেতন মন, চারপাশের পরিবেশ থেকে বেছে  নেয় ভালো মন্দের শিক্ষা। প্রতিটি ভালো কাজের জন্য পুরস্কার আর খারাপের জন্য তিরস্কার। সেই শিশুকালেই অবচেতন মনে সমাজে কোনটা গ্রহণযোগ্য আর কোনটা নয় তার একটা ধারণা পেয়ে যাই আমরা আশেপাশের নিয়মগুলোকে দেখেই। শত শত বছর ধরে এই  ঠিক-বেঠিকের নিয়মে বাঁধা প্রতিটি মানুষের শিক্ষা, বেড়ে ওঠা। আর সেই রুলবুকের একটা অধ্যায় বলে দেয় নারীদের ঠিক কী নিয়মে চলতে হবে।

আমাদের সমাজে মেয়েদের মানুষ করা হয় ঠিক যেমন করে বনসাই তৈরি করা হয়, তেমন করে। বনসাই তৈরি করার সময় মূল শিকড়টি একদম গোড়া থেকে কেটে দেয়া হয়, তারপর আশেপাশের ছোট ছোট শিকড়ের আশ্রয় বেঁচে থাকা। মাটির উপরের অংশটার বেশিরভাগটাই ছেঁটে  ফেলে দেয়া হয়, যতোটুকু রেখে দেয়া হয় সেটাও তার পেঁচিয়ে সুন্দর একটা আকৃতি দেয়া হয় যা কিনা দৃষ্টিনন্দন। সেই সাথে  মাঝে মাঝে গাছটিকে পাত্র থেকে বের করে ছোট ছোট শিকড় গুলোকেও ছেঁটে যতোটুকু প্রয়োজন রেখে বাকিটা ফেলে দেয়া হয়। এই প্রক্রিয়া চলে বারবার। রূপক অর্থে ভেবে দেখলে মেয়েদের বড় করে তোলার প্রক্রিয়াটাও অনেকটা তেমনই। মেয়েদের থেকে সমাজ আশা করে ঠিক তেমনই দৃষ্টিনন্দন নিয়মনিষ্ঠ জীবন। মেয়েদের এমনভাবে কন্ডিশনিং করা হয় যে, আমরা মেয়েরা আমাদের  স্বার্থত্যাগেই এক ধরণের আত্মপ্রসাদ অনুভব করি। আমাদের সমাজের নিয়মটাই এমন যে জন্মের পরে প্রথম নিঃশ্বাস নেবে পর থেকে মৃত্যুর সময় শেষ নিঃশ্বাস নেবার আগ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের চিন্তা চেতনা জুড়ে থাকে মানুষ কী বলবে। সেই সমালোচনা আর তিরস্কার নেবার মানসিক জোর, ওই বনসাই হয়ে বেড়ে ওঠার সময়ই ছেঁটে  দেয়া হয়। তাই আমাদের সমাজে বেশিরভাগ নারী বেঁচে থাকে  আত্মত্যাগের আত্মপ্রসাদে।

এর থেকে মুক্তি বা সমাধানের উপায় আমার জানা নেই। আমি শুধু আমার বিশ্লেষণটুকু দিয়ে গেলাম। কিন্তু তবুও আশা ও বিশ্বাস আছে দেরি হলেও একদিন বনসাইয়ের জীবন ছেড়ে মহীরুহ হবার দিন আসবে। কারণ এর  মাঝেও কেউ কেউ বের হয়ে আসছে নিয়ম ভেঙে। অসংখ্যবার  শিকড়, ডালপালা হারিয়ে রক্তাক্ত হয়েও মহিরুহ হবার সংখ্যাও এখন আর কম নয়। তাই আশায় বাঁচি, আরো শত বছরের যুদ্ধ শেষে একদিন সেই দিন আসবেই।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *