উচ্চমাধ্যমিক সাহিত্যের মেয়েরা
মেহেদী হাসান ।। এক সময় উচ্চমাধ্যমিকে সাহিত্য পড়াতাম। কিছুদিন পড়ানোর পর অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম যা কিছু পড়াই, নারী প্রসঙ্গ এলেই কেমন যেন দুঃখ-বেদনা-হতাশা-অপ্রাপ্তি আর বঞ্চনার প্রসঙ্গ ঘুরে ঘুরে আসে। মনে পড়ে বাংলাদেশের একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের একটা ছোট কলেজে পড়াই তখন। ডিগ্রি ক্লাসে মাত্র চারটা মেয়ে পড়তে আসে। ছেলেরা একটু দূরের নোয়াখালী বা লক্ষ্মীপুর কলেজে পড়তে যায়। মেয়েগুলোর সেখানে যাবার সুযোগ নেই তাই বাধ্য হয়ে ছোট কলেজটাতে পাস কোর্সে ভর্তি হয়। ধারণা করি বিয়ের অপেক্ষায় থাকে ওরা আর ওদের অভিভাবকরা।
একদিন ক্লাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুঁই মাচা’ পড়াচ্ছি। গল্পের শেষে ক্ষেন্তির মৃত্যু সংবাদটা পাচ্ছি নিরাসক্ত এক বিবরণে। মেয়েটা যে মরে গেছে সে সংবাদটাও বাবাকে জানতে হচ্ছে মেয়েকে দেখতে এসে। ঘরের চালে ক্ষেন্তির লাগানো পুঁই মাচায় শাক জমে উঠেছে, মেয়েটা শাকটা পছন্দ করতো। লেখক ‘প্রবর্ধমান জীবনের লাবণ্যে ভরপুর’ বলে কাব্য করছেন। আমার বয়স কম ছিল। মাত্র শিক্ষকতা শুরু করেছি। আমি চারটা মেয়ের সামনে নির্লজ্জের মতো কেঁদে দিলাম। আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়েগুলো। সে বিস্ময় ওদের বিয়ের পর কেটেছে কি না আর জানি না। আমার প্রয়োজন পড়ে নি জানার। ততদিনে আমিও শক্তপোক্ত হয়ে গেছি। সাহিত্যকে ব্যক্তিগতভাবে বুঝে নেওয়ার চেয়ে প্রথাগত কৌশলে ব্যাকরণ মেনে পড়ার চর্চা রপ্ত করে নিয়েছি।
নারীর বেদনার প্রথম প্রত্নপ্রতিমা আমার কাছে কাজলাদিদি। স্কুলে পড়েছিলাম। ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই/ মাগো আমার শোলোক বলা কাজলা দিদি কই।’ কাজলাদিদির কী হয়েছিল আজ আর মনে নেই, সে সময়ও বুঝেছিলাম ভালো করে এমন নয়। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ানো শুরু করি ‘হৈমন্তী’। রবীন্দ্রনাথের আহা মরি কোনো গল্প নয় এটি। তবুও পাঠ্য বইয়ের কল্যাণে সর্বাধিক পঠিত গল্প। মেয়েটা মরে গেছে। ক্ষেন্তির মতোই। অপু নতুন বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইনিয়েবিনিয়ে রবীন্দ্রনাথ কত কথা বলছেন। তাতে অপাপবিদ্ধ, নিষ্কলঙ্ক, শুভ্রতার প্রতীক হৈমন্তীর জন্য হাহাকার আমাদের ঘোচে না। অপু কেন প্রতিবাদ করে নি। একবার আমার এক ছাত্র আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো। আমি উত্তরটা জানতাম। এটা পুরুষতন্ত্র নয়, সামন্তবাদ। যেখানে ব্যক্তি নয়, পরিবার প্রধান। সে পরিবারের প্রধান যে পুরুষ, সে-ই প্রভু। তার সিদ্ধান্তই সব। অপু যতই পড়ুক, ওর সিদ্ধান্তের কোনো মূল্য নেই। যেহেতু সমাজ তখন ব্যক্তির মূল্য দিতে শেখে নি তাই ব্যক্তি গৌণ হয়ে গেছে।
শরৎচন্দ্রের ‘বিলাসী’ও পড়াতে শুরু করি এক সময়। দেখি, অসবর্ণের দুজন নরনারীর ‘প্রেমের জয়’ নামীয় একটি ধারণা থেকে আমার চৈতন্যে বেশি করে ধরা দিচ্ছে বিলাসীর কষ্ট। শরৎচন্দ্রের সমুদয় মনোযোগ পেয়েছে মেয়েটা ন্যাড়াকে রাতে একা ছাড়তে চায় না। অথচ এগিয়ে দিতে গেলে তাকেই একা ফিরতে হয়। তবুও সে মানবিক! নিজের কষ্টকে, লাঞ্ছনাকে সে কিছু মনে করে না, বরং বলে, ‘বাবুরা আমাকে একটিবার ছেড়ে দিন। না হয় অসুস্থ মানুষটা না খেয়ে থাকবে’। জগৎসংসারে এমন মেয়ে পাওয়া সম্ভব কি না জানি না, কিন্তু সাহিত্য এমন নারী-প্রতিমা নির্মাণে আগ্রহী। কিন্তু এতসব করে কার লাভ হলো? বিলাসী কী পেলো? মৃত্যু। এক সময় আমার মনে হতে থাকে সমস্যা কি বিয়েতে? হৈমন্তীর বিয়ে না হলে সে বাবার সংসারে অন্তত বেঁচে থাকতো ভালোবাসা নিয়ে। শিক্ষিত একটা মেয়ে বিয়ে না হলেও সে জীবন চালিয়ে নিতে পারতো। এমন একটা চরিত্র নির্মাণ করে বিয়ে দিয়ে ছাড়লেন। মেয়েটা মরলো! নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে এমনি করে মৃত্যু কামনা করেছিলেন। মীরার বরকে বিদেশ থেকে পড়িয়ে এনে দেশে চাকরির ব্যবস্থা করার পর বাসায় তুলে দিয়েও শেষ রক্ষা হয় নি। তিন সন্তানসহ মীরাকে আশ্রয় নিতে হয় বাবার সংসারে। রবীন্দ্রনাথ তখন বলেছিলেন, আমার এ মেয়েটি যদি সাপে কেটে মারা পড়তো আমি সবচেয়ে সুখী মানুষ হতাম। বড় মেয়ে বেলার জীবনও সুখের কিছু ছিল না। চুক্তি অনুযায়ী যৌতুকের টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে নানাভাবে মেয়েটা নির্যাতিত হয়।
এইডসের গ্রহণকালে হঠাৎ পাঠ্য করা হয় ‘অপরাহ্ণের গল্প’ নামে একটা হুমায়ূন আহমেদের একটা গদ্য রচনা। ফরমায়েশি একটা লেখা। এইডসর রোগের কারণ জানানোর জন্য লেখা। আমরা ইনিয়েবিনিয়ে সেটাই বোঝাতে চেষ্টা করেছি সেটা পড়িয়ে। এক সময় আমার মনে হতে থাকে গল্পের মানুষটার এইডস হয়েছে সে মধ্যপ্রাচ্যে ‘খারাপ মেয়ের’ সংসর্গে গিয়েছে তাই। কিন্তু তার স্ত্রীর কী দোষ? সে তো স্বামী ছাড়া কোনো পুরুষের সংসর্গে যায় নি? যৌন জীবনে স্বামী স্ত্রীর বিশ্বস্ততা তাহলে এক রৈখিক? কিন্তু দায়টা দুজনের? এ মেয়েটাকে কেন এইডসের বেদনায় নীল হতে হচ্ছে?
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ পড়িয়েছি দীর্ঘ দিন। কপিলা স্বামী কর্তৃক গৃহীত হয় ততদিন, যতদিন স্বামীর প্রয়োজন। প্রয়োজন শেষ হলে স্বামী পরিত্যক্ত হয় আর তখন সে ছলচাতুরী করে কুবেরকে ধরে। কুবের আমাদের আলাভোলা, বোকাসোকা নায়ক। নদীর ধারে রাতে সাদা কাপড়ে কপিলাকে দেখে ভয়ে ‘আধ মরা হইয়া যায়’। এ নায়কও পঙ্গু ‘রাজরানীর মতো সুন্দরী’ স্ত্রী মালাকে সংসারে একটু এদিক সেদিক হলেই বলে, মাইয়া মানুষ জন্ম অইছে পোলা বিয়াইবার লাইগা। বিয়া পোলা যত পারস। রাও করস ক্যান রে?’ উপন্যাসের শেষে এসে কুবের যখন পালিয়ে যাচ্ছে তখন আর কাউকে না পেয়ে ঔপন্যাসিক কথা বলে ওঠেন, ‘হ, কপিলাও চলুক সঙ্গে একা কুবের এতো দূর পাড়ি দিতে পারিবে না।’ আমরা নায়ক-নায়িকার মিলনের আনন্দে বিভোর হই। আমি উপন্যাস আলোচনা শেষে ছাত্রদের জিজ্ঞেস করতাম, এ উপন্যাসে সবচেয়ে বড় মিথ্যেটা কে বলেছে? ওরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে আমার দিকে তাকাতো। তখন বলতাম, মানিক নিজে। শেষ বাক্যটা দেখো। ডাহা মিথ্যে। কুবের কি আজ প্রথম যাচ্ছে ময়নাদ্বীপে। এর আগে তো কপিলাকে ওর প্রয়োজন হয় নি। আজ কেন প্রয়োজন হলো? আসলে এটা মানিকের সান্ত্বনা। লেখক হিসেবে তাঁকে যদি প্রশ্ন করা হয় মালার কী করলেন? কুবের কপিলা না হয় ময়নাদ্বীপে সংসার পাতলো। কিন্তু মালা? পঙ্গু একটা মেয়ে লখা চণ্ডী ছাড়াও আরেকটা ছেলে শিশু আছে। ওদের নিয়ে মালা কী খাবে? আমরা জানি না। ওরা কীভাবে বাঁচবে তাও জানি না। মালা জগত সংসারে কুবেরের সন্তান উৎপাদন করছে ঠিক আছে কিন্তু তার উৎপাদনের শ্রম মূল্য কি? মানিকের কাছে এর জবাব ছিলো না। সান্ত্বনামূলক এ বাক্য মানিক নিজেকে নিজেই দিয়েছে। বিবেক বলে তো একটা কথা আছে!
পাঠ্যসূচির শেষ গল্পটা ছিলো ‘কলিমদ্দি দফাদার’। আবু জাফর শামসুদ্দীনের মুক্তিযুদ্ধের গল্প। একটা সামান্য গ্রাম্য চৌকিদারের প্রতিরোধের গল্প। নারী এর বিষয় হবার কথা নয়। নারী এ গল্পের মূল বয়ানও নয়। তবু বিধবা হরিমতি আর তার মেয়ে সুমতি আখ্যানে ক্ষুদ্র বয়ান হয়ে আসে। যুদ্ধে নারী না থাকলে কি চলে? নারী যুদ্ধ করে না। তবু সে অংশ নেয়। ওরা নদীতে গোসল করতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক আক্রান্ত হয়। আর্দ্র বস্ত্রে পালিয়ে বাঁচতে স্কুল ঘরে আশ্রয় নেয়। পাক বাহিনী ওদের মুক্তিযোদ্ধাদের মতো করে গুলি করে মারে না। বরং মেরে ফেললেই ভালো হতো। আবু জাফর শামসুদ্দীন বলছেন, ওরা নিঃস্ব। জায়গা জমি নেই। পরের ঘরে ধান কুটে, চিড়া করে দিয়ে দুবেলা খায়। ওদের শরীর ওদের কাল হলো।
উচ্চমাধ্যমিকের আখ্যানধর্মী সাহিত্যগুলোর সব কটি নারী বিষয়ক নয়। লেখকরা সে অর্থে লেখেননি। এনসিটিবি গল্প নির্বাচনে নারী বিষয়ক একটা গল্প হয়তো নিয়েছে। এটা কাকতালীয় নয়, সব কটি গল্পে নারী সবার অজান্তে বিষয় হয়ে গেছে। লেখকরা পুরুষ। তারাও কমবেশি নারীর কথা বলতে গিয়ে দুর্ভোগের কথা বলে ফেলেছেন। তাহলে কি আমরা বলতে পারি, সমাজের কোথাও গলদ আছে। সে গলদ লেখকদের হাতে ধরা পড়েছে এই যা। আমাদের সমাজই মনে হয় এটা!