May 15, 2024
সাহিত্যফিচার ৩প্রবন্ধ

নিজের একটি কামরা: নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ নিয়ে ভাবনা

ড. নূর সালমা খাতুন ।। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় পুরুষের আধিপত্য এটা প্রমাণ করে যে নারীরা পিছিয়ে আছে। অনেক উচ্চশিক্ষিত পুরুষকেও বলতে শোনা যায় নারীরা তাদের মেধাকে বিকশিত হতে দেয় না, ফলে খোলামেলা আলোচনায় অংশ নিতে পারে না। কথাটা হয়তো কিছুটা ঠিক। কিন্তু এর পেছনের কার্যকারণসূত্রটা কি আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছি? মনে হয় না। এমন একটা দিকে আলো ফেলেছেন ভার্জিনিয়া উলফ (১৮৮২-১৯৪১)। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ের ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক ভার্জিনিয়া উলফ। লেখক ও গবেষক পিতার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে পড়াশোনার সুযোগ পেলেও একটা বৈরি পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠেন তিনি। এসবের মাঝেও তাঁর সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞা থেমে থাকেনি। লিখেছেন- Msr Dalloway (১৯২৫), To the Lighthouse (১৯২৭), Orlando (১৯২৮)| A Room of one’s Own (১৯২৫),  লেখাটি দুটো বক্তৃতার পরিবর্ধিত রূপ। ‘উপন্যাস ও নারী’ শিরোনামে দুটো বক্তৃতা দিয়েছিলেন ১৯২৮ সালে। পরের বছর ১৯২৯ সালে সেটা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। “সেই সঙ্গে সৃষ্টি হয় সাহিত্য সমালোচনার এক নতুন পরিপ্রেক্ষিত ও অধ্যায়, যাকে বলা যেতে পারে ‘নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনা’। আলম খোরশেদ নিজের একটি কামরা নামে এটিকে অনুবাদ করেন। তাঁর ঝরঝরে গদ্যে লেখাটি বেশ সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে। ‘অনুবাদকের ভূমিকা’ অংশে তিনি বলেন :

ভার্জিনিয়া উলফ তাঁর বক্তৃতায় নারী ও উপন্যাসের সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে একটি মৌলিক প্রসঙ্গের অবতারণা করেন; সমাজে নারীর অর্থনৈতিক অবস্থান এবং শিল্পের ওপর এর প্রভাব। তিনিই প্রথম চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়েছেন যে, স্মরণাতীত কাল থেকেই নারীরা পুরুষের চেয়ে বিত্তহীন, ফলত শক্তিহীন। তার এই সীমাহীন দারিদ্র্যের জন্যও দায়ী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এই সমাজ তার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে সামাজিক বিধিনিষেধ এবং তাকে বঞ্চিত করেছে তার প্রাপ্য অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা থেকে, মূলত পুরুষেরই এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজনে।
. . .

নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা ও বিত্তহীনতার জন্য নারী বঞ্চিত হয়েছে জীবনের এমন সব জরুরি অভিজ্ঞতা অর্জন থেকে যা সৃষ্টিশীল কাজের জন্য নিতান্তই অপরিহার্য। সৃজনপ্রতিভাসম্পন্ন নারীরা এভাবে নিজেরা যেমন বঞ্চিত হয়েছেন প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ থেকে তেমনি আমাদের সাহিত্য ও শিল্পও বঞ্চিত হয়েছে তাঁদের সম্ভাব্য সৃষ্টির অবদান থেকে।
. . .

ভার্জিনিয়া উলফ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন জেন অস্টেন থেকে শুরু করে ব্রন্টি ভগ্নিদ্বয়, জর্জ এলিয়ট ও মেরি কারমাইকেল পর্যন্ত প্রত্যেকের লেখাই তাঁদের বিপুল প্রতিভা সত্ত্বেও নানা সীমাবদ্ধতায় আকীর্ণ। আর তার কারণ একটিই, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সীমাবদ্ধতার কারণে জীবনের সর্ববিধ অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হওয়া। আর সেখান থেকেই তিনি তাঁর এই বিপ্লবী, যদিও প্রতীকী, সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, নারীকে উচ্চমানসম্পন্ন সাহিত্য রচনা করতে হলে, সর্বাগ্রে তার নিজের একটি কামরা ও বছরে কমপক্ষে পাঁচশত পাউন্ড আয়ের নিশ্চয়তা দিতে হবে। এক কথায়, নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে।
. . .

ভার্জিনিয়া উলফের এই ভবিষ্যদ্বাণী যে সত্য প্রমাণিত হয়েছে তার সাক্ষাৎ প্রমাণ তিনি নিজে এবং গ্রাৎসিয়া দেলিদ্দা, গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, নেলি সাক্স, আনা আখমাতোভা, টনি মরিসন, নাদিন গর্ডিমার, ভিস্লাভা শিমবরস্কা, নাওয়াল এল সাদাবি, ডরিস লেসিং, মহাশ্বেতা দেবী, মার্গারেট অ্যাটউড, হার্তা মুলার, আমা আতা আইদু, ইসাবেল আয়েন্দের মত আরও অসংখ্য প্রতিভাবান ও প্রতিষ্ঠিত নারী লিখিয়েরা।

ভার্জিনিয়া উলফ নিজের একটি কামরায় নারীকেন্দ্রিক সমস্যার মূলে আলো ফেলেছেন। নারীর সামাজিক অবস্থান সুদূঢ়করণের জন্য তার স্বাবলম্বী হওয়াটা জরুরি, জরুরি বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশও। এসব যখন সাধিত হবে তখন নারীর প্রতি অবমাননা অনেকাংশে কমে আসবে। পুরুষতন্ত্রের একাধিপত্যতে ফাটল ধরবে। এমন আশাবাদ আমরা ব্যক্ত করতেই পারি। ১৯২৮ থেকে ২০২২ এই ৯৪ বছরে পৃথিবীতে অনেক কিছুর বদল ঘটেছে। নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা উন্নত বিশ্বে অনেকটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় নারী শিক্ষা গ্রহণ করে পুরুষের পাশাপাশি বৃহত্তর কর্মজগতে পা রেখেছে। জলে, স্থলে, আকাশ সর্বত্র নিজের যোগ্যতায় কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তার অবস্থান কি খুব বেশি উন্নতি ঘটেছে? এমন প্রশ্ন চলেই আসে চারপাশের সমাজ বাস্তবতাকে নিরীক্ষণ করতে গেলে। পয়সা আয় করা আর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হয়তো এক কথা নয়। আবার স্বাবলম্বী হওয়াও ভিন্ন বিষয়।

এ তো গেল ভার্জিনিয়া উলফ কথিত পাঁচশ পাউন্ড আয় সংক্রান্ত বিষয়ের কথা। বাকি আছে নারীর নিজের একটি কামরা। নিশ্চয় প্রতীকী ভাবনা এটি। কামরা বলতে স্পেসকে বোঝানো হয়েছে। চিন্তার স্বাধীনতাকে বোঝানো হয়েছে। বোঝানো হয়েছে নিজের প্রজ্ঞা, মেধা আর মননশীলতাকে কাজে লাগিয়ে সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার স্বাধীনতাকে। একটি মুক্ত আকাশ দরকার সকলের জন্য। যে আকাশে থাকবে ইচ্ছে মতো উড়ার স্বাধীনতা, চলার স্বাধীনাতা, বলার স্বাধীনতা। পুরুষ যেভাবেই হোক তা উপভোগ করে। যখন নারীর প্রসঙ্গ আসে তখন পদে পদে বাধার দেয়াল দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। সমাজ নারীর জন্য এক অদৃশ্য কারাগার বানিয়ে রেখেছে। দেখা যায় না কিন্তু নড়াচড়া করতে গেলে বাধা আসে, ব্যথা লাগে কখনো বা মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, থাকে রক্তাক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও। এই সমাজ কিন্তু নারী-পুরুষ উভয়ের। অর্থাৎ এখানে পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে নারীও ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কিংবা নারী তার খণ্ডিত জ্ঞানের জন্য উদারনৈতিক চিন্তা দ্বারা উদ্ভাসিত হতে পারে না। নারীর স্বাধীনতা হরণে কোনো কোনো নারীও পুরুষের কাতারে শামিল হয়। নিজের জীবনের অবরুদ্ধতা তাকে ডানাহীন পাখিতে পরিণত করেছে বলে অন্যের ডানাকে সেও অপছন্দ করছে। কিংবা ওড়াটাকেই স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার মনটাই তাদের তৈরি হয়নি।

বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২) তাঁর ‘সুবেহ সাদেক’ প্রবন্ধে বলছেন :

আমরা ভূমিষ্ঠ হইয়াই শুনিয়াছি যে, আমরা জন্মিয়াছি দাসী, চিরকাল দাসী, থাকিব দাসী।
. . .

আমাদিগকে “নাকেসুল আকেল” বলিয়া দুনিয়ার সমস্ত দোষ আমাদের স্কন্ধে চাপানো হয়। আমরা মূক বলিয়া কোনো কালে এইসব অন্যায়, অবিচারের প্রতিবাদ করি নাই। আমাদের প্রতি পশুর ন্যায় ব্যবহার করা হয়, আমরা তাহাতেই গৌরব বোধ করি।
. . .

শিক্ষা বিস্তারই এই সব অত্যাচার নিবারণের একমাত্র মহৌষধ। . . . শিক্ষা অর্থে আমি প্রকৃত সুশিক্ষার কথাই বলি; গোটা কতক পুস্তক পাঠ করিতে বা দু’ছত্র কবিতা লিখিতে পারা শিক্ষা নয়। আমি চাই সেই শিক্ষা – যাহা তাহাদিগকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে, তাহাদিগকে আদর্শ কন্যা, আদর্শ ভগিনী, আদর্শ গৃহিণী এবং আদর্শ মাতারূপে গঠিত করিবে। শিক্ষা মানসিক এবং শারিরিক উভয়বিধ হওয়া চাই। তাহাদের জানা উচিত যে, তাহারা ইহজগতে সুদৃশ্য শাড়ী, ক্লিপ ও বহুমূল্য রত্নালঙ্কার পরিয়া পুতুল সাজিবার জন্য আইসে নাই; বরং তাহারা বিশেষ কর্ত্তব্য সাধনের নিমিত্ত নারীরূপে জন্মলাভ করিয়াছে। তাহাদের জীবন শুধু পতিদেবতার মনোরঞ্জনের নিমিত্ত উৎসর্গ হইবার বস্তু নহে। তাহারা যেন অন্নবস্ত্রের জন্য কাহারও গলগ্রহ না হয়।

বিষয়টা অদ্ভুত! পৃথিবীর দুই প্রান্তে বসে দুজন মানুষ প্রায় একই সময়ে প্রায় একইরকম ভাবছে। সেটা আলোকিত ইংল্যান্ডের হোক কিংবা প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষ হোক – এদের ভাবনার বিষয়বস্তুর ঐক্য এটা প্রমাণ করে নারীকেন্দ্রিক ইস্যুতে প্রত্যেক সমাজের চিন্তাটা প্রায় এক। রোকেয়া নারীর শিক্ষার কথা বলছেন, মানসিক ও শারীরিক বিকাশের কথা বলেছেন। এসবই একটু ভিন্নভাবে ভার্জিনিয়া উলফ বলছেন। নারীর সংকটগুলো পৃথিবীব্যাপী এক। বর্তমান সময়ে শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে নারীরা অনেকটা এগিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষার কথা বললে চুপ থাকতে হয়। প্রজ্ঞা, মেধা, বিচক্ষণতা এসব গুণকে লালন করতে হয়, চর্চা করতে হয়। নারীর শিক্ষার বিষয়টা এমন যে কাজের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই। এর বাইরে নারীর মননশীলতাকে যত্ন করা, সৃজনশীলতাকে গুরুত্ব দেওয়া, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে শ্রদ্ধা করার মতো উদার মানসিকতা একুশ শতকের আধুনিক মানুষও কতটা পোষণ করে তা ভেবে দেখার বিষয়। আদৌ করে?

ভার্জিনিয়া উলফ তাঁর লেখায় “মেয়েরা গরিব কেন?” এই প্রশ্ন তুলেছেন এবং এর কারণ অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে জ্ঞানী লোকেরা নারী সম্পর্কে কী ভাবেন তা তুলে ধরেন। যেমন :

পোপ বলেছেন, “অধিকাংশ নারীরই চরিত্র বলতে কিছু নেই।” আর দেখুন না ব্রুয়ের কী বলেছেন – “নারীরা হচ্ছে চরম প্রতিভূ; তারা পুরুষের চাইতে হয় উত্তম অথবা অধম।” নাপোলিয়ঁ তাদের অক্ষম ভাবতেন। … কিছু জ্ঞানীজন বলেন তাঁরা মস্তিষ্কের দিক থেকে অগভীর, অন্যরা বলেন চেতনার দিক থেকে তাঁরা গভীরতর। গ্যয়টে তাঁদের সম্মান করতেন; মুসোলিনি ঘেন্না। যেখানেই তাকান পুরুষেরা নারীদের সর্ম্পকে ভেবেছেন এবং ভিন্নভাবে ভেবেছেন। এর আগামাথা নির্ধারণ করা অসম্ভব, . . .।

এ প্রসঙ্গে বসওয়েলের ‘দ্য জার্নাল অভ এ টুর টু দ্য হেব্রিউস’ নামক লেখা থেকে উদ্ধৃত করেন, “পুরুষ জানে নারী তাদের চেয়ে অধিকতর যোগ্য, তাই তারা খুব অজ্ঞ অথবা দুর্বলতর নারীদের পছন্দ করে। এমনটি না ভাবলে তারা নারীদের তাদের সমান জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে এতটা ভীত হত না। . . .” আবার ফ্রেজারের দ্যা গোল্ডেন বাউ থেকে উদ্ধৃত করেন, “প্রাচীন জার্মানিরা বিশ্বাস করত নারীদের মধ্যে দেববিীত্ব রয়েছে, তারা তাকে সেই মত ঈশ্বর প্রদত্ত দূত বলে বিবেচনা করত।”

নারী সম্পর্কিত এসব পরস্পরবিরোধী মন্তব্য থেকে এই সত্য বেরিয়ে আসে কোথাও না কোথাও পুরুষের জয় করার প্রবণতার বাধা পড়ার ভয় রয়েছে। ধনীরা যেভাবে গরিবের উপর রেগে থাকে অর্থাৎ ভাবে তারা তাদের সম্পদ হরণ করতে পারে। এমন সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করে ভার্জিনিয়া উলফ বলেন :

পুরুষের কাছে যাকে জয় করতে হয়, শাসন করতে হয়, তাই নিজেকে বিশাল, প্রায় পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠীই জন্মগতভাবে তার চেয়ে অধম, কল্পনা করাটা এত জরুরি। বস্তুত এটাই তার শক্তির অন্যতম প্রধান উৎস। . . . এত শতাব্দী ধরে মেয়েরা এমন এক আয়নার কাজ করে এসেছে যার রয়েছে পুরুষকে দ্বিগুণ করে দেখানোর এক সুস্বাদু ও জাদুকরী ক্ষমতা। . . . সভ্য সমাজে আয়নার আর যে-ব্যবহারই থাকুক না কেন, যে-কোন বীরত্বব্যঞ্জক ও শক্তি প্রদর্শনমূলক কাজের জন্য তা অপরিহার্য। সে-কারণেই নাপোলিয়ঁ ও মুসোলিনি উভয়েই এমন জোর দিয়ে নারীর অধমর্ণতার কথা বলেন, কেননা নারীরা অধম না হলে তাদের বড় হবার পথ যে বন্ধ হয়ে যায়।

এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন মনের কোণে উঁকি দেয় – পুরুষতন্ত্র কী ভয় পায়? কোনো না কোনোভাবে নারীকে তাদের প্রতিযোগী ভাবে? যদি এমন হয় তবে তো প্রাসঙ্গিক আরও কিছু প্রশ্ন ওঠে। যেমন : জীবনটা তাহলে কী কোনো খেলা? যে খেলায় দুটো দল রয়েছে। এবং কাল থেকে কালান্তরে ছলে-বলে-কৌশলে একটা দল জিতে এসেছে আর আরেকটা দল হারতে হারতে জেতার স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিয়েছে? এমন জটিল আর অনভিপ্রেত ভাবনারা মনকে বিক্ষিপ্ত করে ফেলে। চারপাশে তাকালে এমন ভাবনারাই ফিরে ফিরে আসে। আমাদের এখান থেকে বেরুনোর সময় এসেছে। অনেক তো হলো। এবার একটু চিন্তার পূর্ণতা আনি না কেন।

ভার্জিনিয়া উলফ দেখিয়েছেন নারীর জন্য সমাজ কাজ ভাগ করে রেখেছে। নারীদের যদি ‘সংরক্ষিত সস্প্রদায়’ করে রাখা না হয় তাহলে তাদের অনেক কিছু করার সম্ভাবনা তৈরি হবে। এই বিষয়টি খুব প্রাসঙ্গিক। জেন্ডার সংক্রান্ত ধারণা সমাজ নিজেদের মতো করে তৈরি করেছে। এবং বৈষম্যের সূত্রপাতও সেখানে থেকেই। এই বৈষম্য আবার সামাজিক অবস্থানভেদে ভিন্ন হয়। বড় কোনো ঘটনা তথা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নারীর অবস্থান খুঁজে মেলা ভার। যা মেলে তা এটা প্রমাণ করে এরা উচ্চ শ্রেণির নারী। এদের শিক্ষা তথা প্রতিপালনে বিশেষ যত্ন রয়েছে। মধ্য শ্রেণির নারীর ক্ষেত্রে এমন ভাবার সুযোগ নেই। নারীর অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যাপারটা কতটা জরুরি এক্ষেত্রে এটাই প্রমাণিত হয়। তার মেধা ও সম্ভাবনা থাকার পরেও তাকে পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়েই থাকতে হয়। তার স্বাধীন ইচ্ছা প্রকাশের সুুযোগ থাকে না। সেই প্রাচীন সময় থেকে আজ অব্দি নারী কিন্তু একটা ঘেরাটোপের মধ্যে ছকে বাঁধা জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়েই আসছে। সমাজ তাকে বাইরে বেরুনোর মানে স্বাধীনভাবে ভাবার বা চলার সুযোগ করে দেয়নি। এই সত্যটা বাস্তবের। আমরা চারপাশে তাকালেই দেখতে পাই। ভার্জিনিয়া উল্ফও দেখেছেন। কিন্তু তিনি একটা বিষয়ে বিস্মিত হয়েছেনÑপুরুষের রচিত সাহিত্যে নারীর ব্যক্তিত্বময় প্রকাশ দেখে। বাস্তবে নারীকে বন্দি করে রাখা হয়। বদ্ধ ঘরে প্রহার করা হয়। রুদ্ধ করা হয় তার চিন্তার, মননের জগৎকে। অথচ সাহিত্যে চসারের কাল থেকে আজ অব্দি তাকে দেখানো হচ্ছে বিভিন্ন ভূমিকায় উজ্জ্বলরূপে। তিনি এফ.এল. লুকাসের ট্রাজেডি গ্রন্থ থেকে উল্লেখ করছেন :

স্মরণাতীতকাল থেকে সমস্ত কবির সমস্ত রচনাতেই নারীরা আলোকবর্তিকার মত জ্বলছেনÑক্লাইটেমনেস্ট্রা, আন্তিগোনে, ক্লিওপেট্রা ও লেডি ম্যাকবেথ, ফ্যাড্রো, ক্রেসিডা, রোসালিন্ড, দেসদেমনা, ডাচেস অভ মালফি, নাটক ও কথাসাহিত্যেÑমিলামান্ত, ক্লারিসা, বেকি শার্প, আনা কারেনিনা, এমা বোভারি, মাদাম গ্যরমান্তেস, এইসব নাম ভিড় করে আসে মনে, তাদের কেউই বলেন না যে, ‘নারীচরিত্রে ও ব্যক্তিত্বে’ কোন ঘাটতি ছিল। বস্তুত, পুরুষদের লেখা সাহিত্য ছাড়া আর কোথাও যদি তার অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে যে-কেউ তাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে ধরে নিত; খুবই বৈচিত্র্যময়, বীরোচিত, সঙ্কীর্ণমনা, আকষর্ণীয় ও স্বার্থপর, অসাধারণ সুন্দর ও চূড়ান্তভাবে ভয়ংকর, পুরুষের মত কিংবা তারও চেয়ে বেশি।

এফ.এল. লুকাস তাঁর ট্রাজেডি গ্রন্থে আরও বলেন :

এটা আজও এক অদ্ভুত ও অব্যাখ্যেয় সত্য যে, আথেনা নগরীতে যেখানে নারীদের প্রায় প্রাচ্যদেশীয় পীড়নের মধ্যে রক্ষিতা কিংবা দাসী করে রাখা হত সেখানে তারা নাট্যমঞ্চ জন্ম দিয়েছিল ক্লাইটেমনেস্ট্রা ও কাসান্দ্রা, আটোসা ও আন্তিগোনে, ফ্যাড্রো ও মেডিয়া এবং ‘নারীবিদ্বেষী’ ইউরিপিদিস-এর অপর সব নাটকে প্রাধান্যবিস্তারকারী নায়িকাদের মত চরিত্রসমূহ। বাস্তব জীবনে ভদ্রঘরের কোন নারীর পক্ষে একা রাস্তায় রেরুনো যেখানে অসম্ভব ছিল, সেখানে কী করে মঞ্চে নারীরা পুরুষের সমতুল্য এমনকি কখনও কখনও তাকে ছাড়িয়েও গেছে, জগতের এই ধাঁধাঁর সন্তোষজনক ব্যাখ্যা মেলেনি আজও।

বিষয়টি ভাববার মতোই। সাহিত্যে তো সমাজের দর্পণ। এক অর্থে জীবনের অনুকরণ। বাস্তবতার পুর্ননির্মাণ হয় শিল্পের ভুবনে। যার জন্ম শিল্পীর হৃদয়ভূমে। যেখানে কল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার মিশেলে এক নতুনের জন্ম হয়। তাহলে লেখকদের কল্পনায় নারীর এই ব্যক্তিত্বময়ী সত্তার জন্ম হয়েছিল! কিন্তু কল্পনা তো বাস্তবকে আঁকড়ে ধরেই ডানা মেলে। তাহলে কী নারীর মধ্যে সেই তেজোদীপ্ত ব্যাপারটি পুরুষ লেখকরা উপলব্ধি করেছিলেন? নিশ্চয়। নইলে রূপায়ণ করবেন কীভাবে? সৃষ্টিশীল মানুষদের সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি থাকে। যা কেবল অনেকদূর নয়, গভীর অব্দি দেখতে পায়। হয়তো নারীর ভেতরের মানুষটিকে দেখে থাকবেন তারা। তাই তাদের লেখায় এমন বর্ণিলভাবে উদ্ভাসিত হয়েছেন নারীরা।

কিন্তু লেখকদের এই ভাবনাকে এভাবে তলিয়ে দেখে না সমাজ। তারা বিশ্বাস করে “নারীরা শেক্সপিয়র লিখতে পারে না।” ভার্জিনিয়া উল্ফ বলছেন শেক্সপিয়রের আমলে কোনো নারীর পক্ষে শেক্সপিয়রের মতো প্রতিভাসম্পন্ন হওয়া সম্ভবপর ছিল না। বড় আক্ষেপে তিনি বলেন, “কেননা সে-রকম প্রতিভা অশিক্ষিত, শ্রমজীবী দাসশ্রেণির মানুষদের মধ্যে জন্মায় না।” আসলে ঐ সমাজে প্রাথমিক স্কুলের সীমানা ডিঙানোর আগেই মেয়েদের বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে ফেলা হতো। এমিলি ব্রন্টি বা জেন অস্টেনদের জন্ম হওয়াটা দৈবাৎ কোনো ঘটনা। নারীরা অনেকসময় নিজেদের প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ পেলেও সেটায় নিজের নাম গোপন রাখত। অনেকে মনে করেন গ্রামীণ লোককথার অনেকটাই নারীদের রচনা। এ প্রসঙ্গে খুব ভালো একটা কাল্পনিক গল্পের তথা চরিত্রের অবতারণা করেন ভার্জিনিয়া উল্ফ। বলেন আমরা যদি ধরে নিই শেক্সপিয়রের একটি মেধাবী বোন ছিল যার নাম জুডিথ। সে তার ভাইয়ের মতো ওভিদ, ভার্জিল, হোরেস, ব্যাকরণ, যুক্তিশাস্ত্র পড়ার সুযোগ পেত না। তাকে বই না পড়ে মোজা সেলাই বা রান্না করতে উদ্বুদ্ধ করা হতো। তার বয়স কুড়িতে পড়লে তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হতো। সে বাড়ি থেকে পালিয়ে লন্ডনে গিয়ে অভিনেত্রী হওয়ার চেষ্টা করত। তার ভাইয়ের মতোই নাট্যপ্রতিভা তারপরেও মঞ্চের দ্বারে দ্বারে ঘুড়ে বেড়াতে হতো তাকে। তার মুখে শেক্সপিয়রের আদল থাকায় তাকে দয়া দেখাতে পারে কেউ। ভার্জিনিয়া উল্ফ এর লেখা থেকে বাকিটুকু এই গল্পের :

– অভিনেতা কাম ম্যানেজার নিক গ্রিন তার ওপর দয়াপরবশা হলেন ও সে নিজেকে আবিষ্কার করল তার সন্তানের জননী হিসেবে – নারীদেহে আটকে পড়া কবিহৃদয়ের উত্তাপ ও আক্রোশ পরিমাপ করবে কে? – এবং এক শীতের রাতে আত্মহত্যা করে এখন সে শুয়ে আছে ক্যাসল ও এলিফ্যান্টের মোড়ে যেখানে বাসগুলো এসে থামে।

নারীর এই পরিণতি আজকের সমাজেও অহরহ চোখে পড়ে। তাই ভার্জিনিয়া উল্ফ এর এই কাল্পনিক গল্পটির একটি চিরন্তন আবেদন রয়েছে। যদিও তিনি সন্দেহ পোষণ করেছেন যে শেক্সপিয়রের সময় এমন প্রতিভাবান মানে শেক্সপিয়রের মতো মেধাবী মেয়ের জন্ম হওয়াটা অকল্পনীয়। কেননা প্রতিভাকে লালন করতে হয়, পরিচর্যা করতে হয়। যেটা ঐ সমাজে সম্ভবপর ছিল না নারীদের ক্ষেত্রে। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। প্রশ্ন হলো কতটা বদলেছে? কতটা উদার হয়েছে? এখনও যদি কোনো পরিবারে দুটো সন্তান(ছেলে-মেয়ে) সমান মেধাবী হয় আর তাদের যদি আর্থিক টানাপোড়েন থাকে তাহলে অবশ্যই ছেলে সন্তানটিই তার পছন্দমাফিক জীবন গড়ার সুযোগ পাবে, এটা দিনের আলোর মতো সত্য। আমরা এই সত্যকে ধারণ করেই নিজেদের অতি আধুনিক, সভ্য, এসব কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছি। নারীকে, নারীর ইচ্ছেকে, নারীর মেধাকে পরিচর্যা করার জন্য যে উদারনৈতিক মানসিকতার দরকার সেটা এখনও সুদূর পরাহত। ভার্জিনিয়া উল্ফ দেখাচ্ছেন মেয়েরা কেবল উপন্যাস লেখায় মনোনিবেশ করে। কবিতা, নাটক বা শিল্পের অন্য কোনো মাধ্যমে লেখক হিসেবে তাদের দৃঢ় অবস্থান লক্ষ করা যায় না। তিনি বিভিন্ন উদাহরণ টেনে বিষয়টি দেখিয়েছেন। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীদের প্রতিভা বিকাশের কোনো পথই খোলা ছিল না। তিনি সম্ভবত ডাচেস থেকে উল্লেখ করেন, “নারীরা বাদুড় কিংবা প্যাঁচার মত বাঁচে, পশুর মত পরিশ্রম করে, আর কীটের মত মরে।” কথাটির বাস্তবতা প্রশ্নাতীত। ভার্জিনিয়া উল্ফ ঊনবিংশ শতাব্দীর নারীদের প্রসঙ্গে বলেন “সঙ্গীতের প্রধান পুরোধা” নারী হলেও এবং ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে নারী কবির আবির্ভাব ঘটলেও নারীরা কেবল উপন্যাসই লেখে। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বলেন :

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাড়িতে একটি মাত্র যৌথ বসার ঘর থাকত! কোন মেয়ে যদি লেখালেখি করত তবে তাকে তা সারতে হত সেই যৌথ বসার ঘরে আর সকলের মধ্যে বসেই। এবং মিস নাইটিঙ্গেল যেমনটি তীব্র ভাষায় অভিযোগ করেন – “মেয়েদের এমন নিরবিচ্ছিন্ন আধঘণ্টা সময় হত না কখনও যাকে তার নিজের বলা যেতে পারত”; সেরকমই ক্রমাগত বাধার সম্মুখীন হত সে। তবু এই পরিবেশে কবিতা কিংবা নাটক লেখার চেয়ে গদ্য কিংবা উপন্যাস লেখা সহজতর ছিল। কম মনঃসংযোগ দরকার হতো তার জন্য। জেন অস্টেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এভাবেই লিখেছেন। তাঁর ভাইপো স্মৃতিকথায় লেখেন, “তিনি যে কী করে এসব লিখেছেন ভাবলে বিস্মিত হতে হয়, কেননা তাঁর নিজের বলে কোন কামরা ছিল না, তাঁর সিংহভাগ বইই লিখিত হয়েছে এই যৌথ বসার ঘরে সমস্ত প্রাত্যহিক বাধা ও বিপত্তির মধ্যেই।”

জেন অস্টেন তাঁর লেখা লুকিয়ে রাখতেন। প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস এর তো বইও লেখার পর তাঁকে লুকিয়ে রাখতে হতো। তিনি সমাজবাস্তবতাকে মেনে নিয়েছিলেন। নিজের আকাঙ্ক্ষা অবদমন করতে শিখে ফেলেছিলেন কিংবা এটা অনায়াস একটা ব্যাপার ছিল। ভার্জিনিয়া উলফ বলছেন জেন অস্টেন তাঁর পারিপার্শ্বিকতাকে মানিয়ে নিতে শিখেছিলেন। তিনি বৃত্তের বাইরে যেতে চেষ্টা করেননি। কিন্তু শার্লট ব্রন্টিকে নিয়ে বলছেন তার লেখার মধ্যে একটা স্পষ্ট আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ আছে। খোলা আকাশের নিচে সে তাঁর দৃষ্টির সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে চেয়েছে। বইয়ে পড়া জীবনের পথে বাস্তবে হাঁটতে চেয়েছে। তার অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা থাকলে হয়তো তার লেখায় এর প্রভাব পড়ত।

ভার্জিনিয়া উলফ উপন্যাসের বিশ্লেষণে লিঙ্গের প্রভাব বিষয়টিকে জোর দেন। তাঁর ধারণা, “বাস্তবিকই, যেহেতু প্রকাশের স্বাধীনতা ও পূর্ণতাই শিল্পের প্রধান নির্যাস সেহেতু ঐতিহ্যের এই ঘাটতি, হাতিয়ারের এই স্বল্পতা ও অভাব, নারীর লেখালেখির ওপর বিপুল প্রভাব ফেলেছিল।”এখানে উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার, উপন্যাসের গঠন, ভাষাগত বিষয়, নারী ও পুুরুষ উপন্যাসিকের বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা প্রভৃতি নিয়ে কথা বলেছেন ভার্জিনিয়া উল্ফ। তিনি উপন্যাসের সমালোচনার একটা ভিন্ন কৌশলও উপস্থাপন করেন। এবং সেই কৌশলে অবশ্যই লিঙ্গগত ব্যাপারটি চলে এসেছে।

পরবর্তীসময়ে লেখা এবং লেখকদের নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ভার্জিনিয়া উল্ফ দেখাচ্ছেন নারী ও পুরুষ প্রায় সমান সমান লিখছে। এবং নারীরা উপন্যাসের পাশপাশি সব ধরনের বই লিখছে যেমন: ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, সমালোচনা, জীবনী, ভ্রমণ, গবেষণাবিষয়ক বই। তিনি মেরি কারমাইকেলের প্রথম উপন্যাস লাইফ’স অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে আলোচনা করেন। এখানে একটা অংশে দেখা যায় “ক্লোই অলিভিয়াকে ভালবাসত।” অর্থাৎ একজন নারীর আরেক নারীর প্রতি প্রেম সে সময়ের সাহিত্যে প্রথম। বিষয়টি এঁকেছেন একজন নারী লেখক। যেটা অনেকটাই বিস্মিত হওয়ার মতো ঘটনা। প্রসঙ্গক্রমে ভার্জিনিয়া অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্টার কথা বলেন। এখানেও দুজন নারী ছিল কিন্তু তাদের মধ্যে অর্থাৎ অক্টাভিয়া ও ক্লিওপেট্টার সম্পর্ক ঈর্ষার। তাদের সম্পর্কে সে অর্থে জটিলতা নেই। নারীর চরিত্রায়ন ও জীবনের রূপায়ণ বিষয়ে ভার্জিনিয়া উল্ফ এর তাত্ত্বিক মনের প্রকাশ তাঁর ভাষা থেকে দেখা যাক :

জেন অস্টেনের সময়ের আগ পর্যন্ত, সাহিত্যের সব নারীচরিত্রকে শুধু অপর লিঙ্গের দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হয়নি, দেখা হয়েছে তাদের সঙ্গে সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতেও। কী সামান্যই না নারীজীবনের সে অংশটুকু, আর তারই কী সামান্যই না জানতে পারে পুরুষ তাদের নাকের ডগায় বসানো লিঙ্গরঞ্জিত কালো কিংবা গোলাপি চশমায়। এজন্যই সম্ভবত; উপন্যাসের নারীদের প্রকৃতি অদ্ভুত, তার সৌন্দর্য ও বিভীষিকার বিস্ময়কর চরমতা, স্বর্গীয় সততা ও নারকীয় দুর্নীতির মধ্যে ওঠাপড়া, কেননা একজন প্রেমিক তাকে তার প্রেমের উত্থানপতন কিংবা সুখঅসুুখের সঙ্গে এভাবেই সম্পর্কিত করে দেখে থাকে। অবশ্যই তা ঊনবিংশ শতাব্দীর উপন্যাসিকদের বেলায় সত্য নয়। সেখানে নারীরা অনেক বেশি জটিল ও বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। . . . নারীবিষয়ক জ্ঞানে পুরুষ নিছকই আংশিক ও সাংঘাতিকভাবে সীমাবদ্ধ, নারীদের বেলাতেও যা সমান সত্য।

ভার্জিনিয়া উলফ তাঁর সিদ্ধান্তে এভাবে আসেন যে নারীরা যদি স্বাধীনতা বা নিয়ন্ত্রণহীন একটা সুযোগ পেত তাহলে তাদের লেখার বৈচিত্র্য পুরুষের মতোই হতো। “বাস্তবিকই যতবার নারীদের মুখের ওপর একেকটি করে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, ততবারই কী পরিমাণ দরিদ্র হয়েছে সাহিত্য তা আমাদের গোনার বাইরে।” ভার্জিনিয়া উলফ লেডি উইনচিল্সি, শার্লট ব্রন্টি, এমিলি ব্রন্টি, জেন অস্টেন, জর্জ এলিয়টদের সঙ্গে মেরি কারমাইকেলকে তুলনা করতে গিয়ে বলেন তাকে নিজের একটি কামরা, বছরে পাঁচশত পাউন্ড এবং মনের কথা বলার সুযোগ দিলে সে আরও ভালো লিখবে। এবং অবশ্যই একশত বছর সময়ও দিতে হবে। নারীর আর্থিক সচ্ছলতার বিষয়টি তিনি বারবার সামনে এনেছেন। তিনি গত একশ বছরে উল্লেখযোগ্য কবিদের জীবন বিশ্লেষণ করে দেখান তাদের প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধাগুলো তাদের চলার পথকে মসৃণ করেছে। আর নারীদের সেসব কবিদের আশেপাশে নাম রাখারই সুযোগ ছিল না। কেননা :

বৌদ্ধিক মুক্তি নির্ভর করে আর্থিক স্বচ্ছলতার [সচ্ছলতার] ওপর। কবিতা নির্ভর করে বৌদ্ধিক স্বাধীনতার ওপর। এবং নারীরা সব সময়ই গরিব, কেবল গত দুইশত বছর ধরেই নয়, সৃষ্টির শুরু থেকেই। আথেন্সের দাস সন্তানের চেয়েও মেয়েদের বৌদ্ধিক স্বাধীনতা কম। নারীর তাহলে কবিতা লেখার কোন সুযোগই ছিল না।

শুধু কবিতা নয় বৌদ্ধিক স্বাধীনতার ওপর মানুষের আচরণ থেকে শুরু করে তার সৃষ্টিশীলতা এসবই নির্ভর করে। পদে পদে বাধা মানুষকে কূপম-ূক করে গড়ে তোলে। চারাগাছের যেমন আলো ও বাতাস লাগে, লাগে পানি – মানুষেরও লাগে স্বাধীনতা। আর মানুষ সে নর বা নারী যেই হোক না কেন তার বেড়ে ওঠায় বাধা প্রদানের অধিকার কারও নেই।

ভার্জিনিয়া উলফ তাঁর লেখা তথা এই ‘উপন্যাস ও নারী’ শিরোনামের আলোচনাটির উপসংহারে বলেন যে পৃথিবীর এত এত অর্জন অর্থাৎ যুদ্ধ, শিল্প, বাণিজ্য এসবে নারীদের কোনো ভূমিকা নেই। অনেকটা অভিমান থেকেই বলেন তখন নারীদের হাতে অন্য কাজ ছিল। “একশত বাষট্টি কোটি ত্রিশ লক্ষ মানুষ” জন্ম দিয়েছে নারীরা, তাদের লালন-পালন করেছে, ছয়-সাত বছর পর্যন্ত শিক্ষা দিয়েছে। এসবকে কী কোনো সমাজ সেভাবে মূল্যায়িত করেছে? এমন প্রশ্ন কিন্তু আজও বিদ্যমান। ভার্জিনিয়া উলফ দেখিয়েছেন নারীদের জন্য বরাদ্দ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা, আইনি অধিকার, ভোটাধিকার সংক্রান্ত আইন, পেশা নির্বাচনের বিষয়গুলো। এসব নিয়ে কথা বলেন এবং অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন :

হাতে কিছু সময়, মগজে কিছু বিদ্যা – অন্য অভিজ্ঞতা যথেষ্ট হয়েছে আপনাদের এবং আপনাদের কলেজে পাঠানো হয়েছে অংশত, আমি সন্দিহান, অশিক্ষিত করার জন্যই – এ নিয়ে আপনারা নিশ্চয়ই দীর্ঘ, শ্রমসাপেক্ষ ও দুর্জ্ঞেয় পেশাপর্বে প্রবেশে প্রস্তুত। সহস্র কলম উম্মুখ হয়ে আছে আপনাদের কী করা উচিত এবং কী প্রভাব পড়বে আপনাদের এই কর্মকাণ্ডের, সে-বিষয়ে উপদেশ দিতে।

ভার্জিনিয়া উলফের ক্ষোভের সুরে বলা এই কথাগুলো আসলে নিদারুণ এক বাস্তবতার ছবি তুলে ধরে। এই আলোচনায় এ প্রসঙ্গটা এসেছে যে নারীকে আজ যে শিক্ষার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে তা কতটুকু তার ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্য আর কতটুকু সমাজের উপকারের জন্য? অর্থাৎ পুরুষের জীবনকে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করার জন্য। শিক্ষিত নারী কী সর্বাঙ্গে, সর্বাংশে তার কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারছে? ভার্জিনিয়া উলফ শেষ অংশে আবার তাঁর কাল্পনিক গল্পের শেক্সপিয়রের বোন জুডিথ এর প্রসঙ্গ তোলেন। বলেন তিনি মারা যাননি। আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন। কেননা কবিরা মরে না। এবং তিনি বলছেন আমরা যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হই, এক শতাব্দী বাঁচি,

বছরে পাঁচশত পাউন্ড ও নিজের একটি কামরার ব্যবস্থা থাকে আমাদের প্রত্যেকের; আমাদের যদি স্বাধীনতার অভ্যাস এবং যা ভাবি হুবহু তা-ই লেখার সাহস থাকে, আমরা যদি যৌথ বসার ঘর থেকে পালিয়ে গিয়ে কিছুটা হলেও মানবসমাজকে দেখি, . . . একলা এগিয়ে চলি এবং ভাবি যে, আমাদের সম্পর্ক জগতের বাস্তবতার সঙ্গে, তার নারীপুরুষের সঙ্গে নয় তাহলে সুযোগ আসবে এবং সেই মৃত কবি, শেক্সপিয়রের বোন, পুনরায় শরীর ধারণ করবে, যে এতকাল সমাহিত ছিল।

এমন প্রতিজ্ঞায় ভার্জিনিয়া উলফ তাঁর ‘উপন্যাস ও নারী’ শীর্ষক বক্তৃতাটির উপসংহার টেনেছেন। তিনি যে প্রতিজ্ঞার কথা বলেছেন সেটা পূর্বসূরিদের আত্মত্যাগকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা এবং সেখান থেকে আত্মসম্মানের শক্তি অর্জনের। তিনি এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন দৃঢ়তার সাথে। বুকে প্রত্যয়, মনে সাহস আর কর্মে নিষ্ঠা থাকলে যেকোনো বাধা অতিক্রম করা সহজ। জীবন এক বিশাল পরীক্ষা ক্ষেত্র। এখানে যোগ্যতমের জয় সুনিশ্চিত। একথা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অযোগ্য পুরুষেরও কোনো মূল্য নেই সমাজের কাছে। আর নারী যদি ভাবে কিংবা অপেক্ষা করে সমাজ তাকে হাতে ধরে টেনে তুলবে, মূল স্রোতধারায় এগিয়ে নেবে তাহলে ভুল। তাকে নিজেকেই এগিয়ে আসতে হবে। নিজের জয়ের ইতিহাস নিজেকে তৈরি করতে হবে। সময় এসেছে বাস্তবতাকে অনুধাবন করার। পুরুষের পেশিশক্তির দিন ফুরিয়েছে। এখন লড়াই মেধা আর প্রতিভার। নারী তার অনুকূল পরিবেশ পাবে না এটা এক চরম সত্য। কিন্তু সেই সত্যকে বুকে আগলে রেখে দুঃখের পাহাড়ে আত্মনিমজ্জন কোনো কাজের কথা না। পূর্বে যে পরিবেশ, অবরুদ্ধতা, অন্ধকারাচ্ছন্নতা ছিল – আজ সেখানে কিছু না কিছু পরিবর্তন এসেছে। সমাজের চাওয়াকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ার সময় এখন।

নারীর স্বাধীনতা, তার আর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এখন স্বাভাবিক ফেনোমেনা। সুযোগ কেউ কাউকে দেয় না, তৈরি করে নিতে হয়। নারী এতদিন জীবনের প্রবাহকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য যে শ্রম দিয়েছে, যে সেবা দিয়েছে সমাজ তার যথাযথ মূল্যায়ন করেনি। ভার্জিনিয়া উলফ অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে বলছেন পৃথিবীর ইতিহাসে বড় বড় ঘটনায় নারীর কোনো ভূমিকা নেই। কেননা সে সময় সে বাচ্চা গর্ভে ধরেছে, জন্ম দিয়েছে, শিক্ষা দিয়েছে ছয়-সাত বছর বয়স অব্দি। তার এই কর্ম সমাজের কাছে কোনো গুরুত্বই বহন করেনি। অথচ নারীাকে পুরুষের মতো বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা তথা প্রতিভা বিকাশের কোনো সুযোগ সমাজ দেয়নি। কাল্পনিক গল্পের জুডিথ এর মতো পরিণতি হতো যদি কোনো নারী নিজের ইচ্ছেকে সম্মান জানাতে ঘর ছাড়তো। এটা এখনো রয়েছে। তবে সময়টা যখন একুশ শতক তখন হাতে অনেক অপশন রয়েছে। দেয়ালহীন বিশ্ব আর ইন্টারনেটের বদৌলতে নিজেদের প্রতিভাকে ছড়িয়ে দেওয়ার এই সুযোগ নারীর হাতের মুঠোয়। তিনি ৯৪ বছর আগে এক শতাব্দী সময় চেয়েছেন মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য। সেই সময় এখন সমাগত। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে নারীর নিজের জন্য একটা কামরা নিশ্চিত হবে। অর্থাৎ নিজের জন্য সে আলাদা স্পেস তৈরি করতে পারবে। সেখানে সে তার চিন্তাকে আদিগন্ত বিস্তৃত করতে পারবে। নিজের জন্য সময় আর চিন্তনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। তার মননশীলতা আর সৃজনশীলতা বাতাসের মতো প্রবহমান হয়ে উঠবে। উপকৃত হবে মানবসভ্যতা, এগিয়ে যাবে জীবন নামক কার্যক্রম। একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জীবন তার কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়। সেই পথে দরকার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সম্মিলিত প্রয়াস। তাদের মিলিত উদ্যোগে এই কার্যক্রম সফলতার মুখ দেখবে। নারীর মেধাকে সম্মান করতে না শেখাটা এক ধরনের পশ্চাদপদতা। এটা যেকোনো ব্যক্তিত্ববান পুরুষ এবং নারীর জন্য নেতিবাচক গুণ। তাই পরস্পরকে শ্রদ্ধা করা আর মূল্যায়ন করার মধ্যেই তাবৎ কল্যাণ নিহিত। এজন্য নারী বা পুরুষ ধারণা থেকে বের হয়ে এসে ‘ব্যক্তি’ হয়ে ওঠার সাধনায় নিজেদের ব্যাপৃত করা উচিত। তবেই না জীবন এগিয়ে যাবে জীবনের পথে। এবং সফলতা, শান্তি আর স্বস্তির সোনালি শস্যে ভরে উঠবে এই চরাচর।

 

ড. নূর সালমা খাতুন
সহকারী অধ্যাপক, নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ, রাজশাহী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *