November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

পিতৃতন্ত্রের বিষ

সাহারা ইসলাম ।। রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় প্রায় প্রতিদিনই নারীদের অদ্ভুত কিছু দৃষ্টির সম্মুখীন হতে হয়। সেদিন বাজার করে বাসায় ফেরার পথে একজন হিজাব বোরকা পরা মাঝবয়েসী নারী এমনভাবে তাকালো যেন আগুনে ভস্ম করে দেবে। অদ্ভুতভাবে আমি তার দিকে যখন তাকালাম সে তার দৃষ্টি সরিয়েও নেয়নি, ওইভাবেই তাকিয়ে থেকে থেকে চলে গেছে। প্রতিদিনই এমন ঘটছে। যেসব নারীরা পর্দা করে তারা অসম্ভব সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগে। বেপর্দা নারী অর্থাৎ যারা বোরকা হিজাব পরে না তাদের দেখলে এদের আচরণ উগ্র কাঠমোল্লাদের মতোই হয়ে যায়। বিষদৃষ্টিতে তাকানোতেও অনেকে সীমাবদ্ধ থাকে না, কেউ কেউ তো কথাও শুনিয়ে দিতে চায়। এরা এ ধরনের নারীদের নিয়ে কুৎসা প্রচার করে এবং নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

নারী অধিকার নিয়ে কথা বলা নারীদেরও তারা ঘৃণা করে। এই ঘৃণার চাষ কেন ও কীভাবে হচ্ছে? যদি সব মেয়েরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে তাহলে পিতৃতন্ত্রের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠবে। পিতৃতন্ত্রও এমনই একটি চক্রান্ত করেছে যেন খুব সহজেই নারীদের হাতের মুঠোয় রাখা যায়। নারীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া আটকাতে তাদের হাজারো প্রচেষ্টা এবং কুটকৌশলের সবচেয়ে কার্যকরী যেটা, তা হলো – নারীদের এক শ্রেণিকে লাগিয়ে রাখা অন্য শ্রেণির বিরুদ্ধে। যেমন আমরা দেখি, গৃহিনীরা সহ্য করতে পারে না কর্মজীবী নারীদের, পর্দানশীল নারী সহ্য করতে পারে না বেপর্দা নারীদের, ধর্মান্ধ নারীরা সহ্য করতে পারে না প্রগতিশীল নারীদের। এভাবেই তারা নারীদের মধ্যে শত্রুতা, বিরোধীতা জিইয়ে রাখে আর নিজেরা জাগতিক সকল কাজকর্মে অংশ নেয়। নারীদের ব্যস্ত রাখে গৃহের একঘেয়েমীপূর্ণ কাজকর্মে এবং ঘৃণাচাষে।

একটি কথা বহুল প্রচলিত – নারীরাই নারীদের সবচেয়ে বড় শত্রু। এই কথা এত বেশি প্রচারিত হয়েছে যে, নারীদের শেখানো হয়েছে পুরুষ নয়, নারীই তার প্রধান শত্রু। নারীকে বিশ্বাস করানো হলো নারীরাই নারীদের হিংসা করে, তাদের ক্ষতি করে আর পুরুষ তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী; অথচ নারীদের নিজেদের মধ্যে কেন এই শত্রুতা, কীভাবে এর সৃষ্টি এসব ভাবার অবকাশ তাদের দেয়া হয় না।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীদের চাকরির জন্য আবেদন করারও সুযোগ দেয়া হয়না। আবেদন করার শর্তগুলোয় লেখাই থাকে শুধু পুরুষরা আবেদন করতে পারবে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান নারীদের চাকরি দিলেও রিসিপশনিস্ট পদেই নিতে আগ্রহী থাকে। এর বাইরে অন্য যেসব পদে নারীরা নিজ যোগত্যায় চাকরি পেলেও তাদের দেয়া হয় না উপযুক্ত পারিশ্রমিক, এমনকি প্রমোশনও আটকে রাখা হয়। অথচ একই পদের পুরুষটি পায় পদন্নোতি এবং অনেক বেশি বেতন। পুরুষটি যদি নারীর চেয়েও কম যোগত্যাসম্পন্ন হয় তবুও সুযোগ সুবিধা সেই ভোগ করে। আর নারীটিকে শিকার হতে হয় নিগ্রহের ও বৈষম্যের।

এটা তো কর্মস্থলের কথা, আর গৃহে যে নারীরা খেটে যাচ্ছে গাধার খাটুনি, তাকেও দেয়া হয় দাসীর মর্যাদা। ‘নিজের সংসারের কাজে লজ্জা নেই, গৃহিনী হওয়া অনেক বেশি সম্মানের’- ইত্যাদি গান শুনিয়ে ওইসব নারীকে আটকে রাখা হয় গৃহেই। তার জীবন করে দেয়া হয় সীমাবদ্ধ। তাই তাদের নিজেদের তৈরি হয় না কোনো অর্থনৈতিক ভিত্তি। তাদের করে রাখা হয় অধীন। বিবাহের পূর্বে পিতার, বিবাহের পর স্বামীর আর বৃদ্ধবয়সে পুত্রের। তার কোনো অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটে না। বাবার সম্পত্তি থেকেও সে বঞ্চিত হয়। তাকে দেয়া হয়না তার ন্যায্য অংশ। ধর্মগুলোও তাদের নিয়মে করে রেখেছে নারীদের বঞ্চিত কারণ নারী সবসময়ই কারো না কারো অধীনে থাকবে। তার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাকে সবসময় থাকতে হবে নির্ভরশীল। অর্থের ওপরই যেখানে নির্ভর করে সম্মান এবং স্বাধীনতা সেখানে অর্থনৈতিক অভাবের পরিণতি মারাত্মক।

গৃহিনী নারীদের বোঝানো হয় স্বামীর টাকাই তার টাকা, স্বামীর যেকোনো প্রাপ্তি তারও প্রাপ্তি। এ যেন প্রভুর শ্রেষ্ঠত্বে দাসের উন্নতি! সেজন্যেই অসংখ্য নারী স্বামীর যেকোনো সাফল্য বা অর্জনেই শুধু গর্বিত হয় না বরং সেটাকে নিজের সাফল্য মনে করে সন্তুষ্ট থাকে এবং অহংও করে। পরগাছার মতো জীবনযাপন করে। নারী আজীবন গৃহেও খেটেছে, বাইরেও খেটেছে। কখনও কখনও পুরুষের চেয়ে অধিক খেটেছে। তবু পায় নি ন্যায্য পারিশ্রমিক এবং সম্মান। এই যে বঞ্চনা ও বৈষম্য- তা ভুলিয়ে রাখতেই পিতৃতন্ত্রের এতো কৌশল ও এতো প্রচেষ্টা।

তাই নারীরা, আপনারা অন্য নারীদের পোশাক, চরিত্র, পেশা, বিশ্বাস এইসব বিষয় নিয়ে ভাবিত না হয়ে নিজেদের অধিকার নিয়ে ভাবিত হন। নিজেদের সাথে হওয়া অন্যায় বৈষম্য নিয়ে ভাবিত হন। আওয়াজ তুলুন।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *