December 3, 2024
সাহিত্যগল্পফিচার ২

কবি হওয়ার দণ্ডে ফুটে ওঠা সূর্যমুখী

রাফসানা ইমাম পুষ্প ।। আমি এই পৃথিবীতে কোন শিশুর জন্ম দিতে চাই নি। আমি চাই নি এমন একটা প্রাণের অস্তিত্ত্ব এই পৃথিবীজুড়ে এলোমেলো পা ফেলে ঘুড়ে বেড়াক যে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আমার ভেতর থেকে। যে প্রাণের সাথে একটা নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগ থেকে যাবে আমার। কিন্তু তবুও আমি চেয়েছিলাম এই পৃথিবীতে একটা নতুন সূর্যমুখী ফুটুক। যেই সূর্যমুখী ফোটানোর জন্য কখনো প্রয়োজনবোধ হবে না আমার জরায়ুর! যেই সূর্যমুখীর কান্নার শব্দে হাসি ফুটে উঠবে না আমার মুখে! কিন্তু আমি সেই শিশুটির জন্য রেখে যাব একটা মহাকাল ধ্বংসের গল্প। যে মহাকাল ধ্বংসের শব্দ কখনো না শুনেও শিশুটি সারাজীবন বধির কান নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকবে এই পৃথিবীতে! যে ধ্বংসের মুখোমুখি না হওয়া সত্ত্বেও ভয় পেতে থাকবে শিশুটি! চুপিচুপি,বলতে থাকবে তুমি কে? কেমন করে মুখোমুখি হয়েছো এই ধ্বংসের? ফিসফিস করে নিজেকে বলতে থাকবে এই ধ্বংসের শব্দগুলোকে তুমি কেন একটার পর একটা সুরের ছকে বাঁধতে চেয়েছো?

নতুন শিশুটির জন্য আমি রেখে যাব একটা বিষন্ন মহাকালের গল্প। যে গল্প উৎসর্গিত হয়েছে শিশুটির জন্য। কিন্তু সেই শিশুটি আমার নয়। সেই শিশুটি কখনো আমার হবে না। সেই শিশুটি কখনো আমার হয়নি। সেই শিশুটি আমার প্রেমিকের! যেই শিশুটি হঠাৎ এক আশ্চর্য রাতে তৈরি করেছে আরেকটা নতুন মহাকাল। যার মুখোমুখি হবার একটা করুণ দুঃস্বপ্নসম সুখ আমি আমার জীবনে পাইনি। মূলত পেতে চাইনি। আমি মূলত কী চেয়েছি এই জীবনে? জীবনের কাছে আমার কি আসলেই কিছু চাওয়ার ছিল? বারংবার এই জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসেছি।

একজন নারী এবং একটি পরিপক্ব জরায়ুর অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও একটা নির্দিষ্ট বয়সের আগ পর্যন্ত প্রতিটা ঝাঝালো দুপুরে আমার মনে হয়েছে একটি শিশু জন্ম দেওয়া এবং দেওয়া সংক্রান্ত জটিল ও যন্ত্রণার প্রক্রিয়াটির থেকে নিষ্ঠুরতম কোনো ঘটনা এই পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত আর ঘটে না! আমি মকর রাশির জাতিকা। জন্ম পরবর্তী সময়ে বড় হতে থাকার সময়ে জেনেছি আমার বাবা ফুল ভালোবাসতো বলে নাম রাখা হয়েছিল পুষ্প। কিন্তু বড় হতে থাকার প্রতিটা পদক্ষেপে আমি বুঝতে শিখেছি এই পৃথিবীতে আমি ফুল হয়ে জন্মালেও আমার জন্মানোটা বস্তুত একটা ধ্বংসের নাম। দুটো ভিন্ন এবং ধ্বসে যাওয়া মানুষের বিচ্ছেদকে আটকে দিয়ে আমি তাদের মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে পড়েছি। ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠার এক পর্যায়ে আমার পরিচয় ঘটে কবিতার সাথে। কবিতা ভালোবেসে কোনো এক ভোরবেলাতে আড়িয়াল বিলের পাশের ছোট্ট টলটলে দিঘি সমেত পুকুর আর আধপাকা দোতালা বাড়ি ছেড়ে আমি পা রাখি শান্ত, স্নিগ্ধ এবং ধুলো ভরা শহর খুলনায়। খুলনায় পা রাখবার পর বুঝতে পারি এই শহরে কবিতা ভালোবাসা মূলত পাপ! সবার বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলা পড়তে যাওয়াটাও মূলত পাপ! কারণ বাংলাকে সবাই ঘৃণা করে! কবিতাকে সবাই ঘৃণা করে! গল্পকে সবাই ঘৃণা করে! কারণ কবিতা, গল্প আর বাংলা থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাওয়া যায় না। অতএব আমাকে ঘৃনা করতে থাকেন আমার বাবা! আমাকে টাকা পাঠানো বন্ধ করতে থাকেন বাবা! ধুলোর শহরে কোনো রকমে এদিক সেদিক ছাপিয়ে চলতে যেয়ে এক ভর দুপুরে আমি মুখোমুখি হই এক বিষন্ন মহাকালের। সেই বিষন্ন মহাকালের মুখোমুখি হওয়ার আগে পুষ্প নামের আড়ালে হালিত ইকবাল নামধারী আমি লিখে ফেলেছিলাম দু’টো কাব্যগ্রন্থ। আমি জানি না নিজের কাছে পড়ার অযোগ্য মনে হওয়া দুটো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশক কেন নিজ দায়িত্বে ছাপাতে রাজি হয়েছিল! আমি জানি না আমার লেখা দুঃখবোধ সংক্রান্ত অজস্র অকারণ শব্দগুলো কিভাবে মানুষের পাঠযোগ্য হয়ে উঠেছিল! সম্ভবত আমি কখনো জানতে চাইনি বা জানার চেষ্টা করিনি।

মিথ নামের এক বিষন্ন মহাকালের সাথে পরিচয় হওয়ার পর আমার জীবনে অজস্র দুপুর পার হতে থাকে ধীরে ধীরে। আমি অবাক হয়ে দেখতে থাকি আমার এতদিনকার সমস্ত অনুভূতি আর জ্ঞান কেমন করে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে নিজের পায়ের কাছে! আমি অবাক হয়ে দেখতে থাকি কবিতা লেখা এবং কবিতা লিখতে চাওয়া বস্তুত পাপ! আমি অবাক হয়ে দেখতে থাকি এই শহরে হেঁটে বেড়ানো মানুষের মাঝখানে কয়েকটা শব্দের কবিতা মূলত “কিস্যু না” নামক এক বিভ্রম! আমি আর মিথ সহস্র দুপুর হেঁটে বেড়াতে যেয়ে এক সবুজরঙা দেয়ালে ঘেরা বদ্ধ কামরায় বাস করতে শুরু করি কোন এক বিষন্ন বিকেল থেকে। সেই বিকেলের পর এক রৌদ্রময় দুপুরে আমি অবাক হয়ে দেখতে থাকি মিথ নিজেই একটা আস্ত কবিতা, যার মুখোমুখি হবার আগে আমি যা লিখেছি তা মূলত অ্যাবোরশন করে ফেলে দেওয়া অপরিপক্ক মৃত নবজাতকের মস্তিষ্ক! মিথ,একটা ধ্বসে যাওয়া নক্ষত্র। যাকে ছুঁতে যেয়ে আমি ধীরে ধীরে ছুঁয়ে ফেলতে থাকি অজস্র দুঃখবোধ। যেন তাকে ছোঁয়ার আগে আমি কখনো কোনদিন দুঃখদের ছুঁয়ে যাইনি! যেন তাকে ছোঁয়ার আগে হতাশারা আমার গলা টিপে ধরেনি মাঝরাতে! যেন তাকে ছাপিয়ে আকাশে ওড়ার আগে আমি পরিচিত হইনি কোন শব্দ, অক্ষরের এবং বাক্যের সাথে! মিথ, এক অনিন্দ্য সুন্দর বেদনা। যে আমাকে ধীরে ধীরে শেখায় কবিতার শব্দ কেমন করে বদলানো যেতে পারে। আমি শিখতে থাকি বেয়োনেট আর চিৎকারের বাইরে কেমন করে লিখতে হয় কৃষ্ণচূড়া নিয়ে। আমি শিখতে থাকি প্রেম, কাম এবং হস্তমৈথুনের পার্থক্যের মধ্যে কেমন করে লেগে থাকে আমাদের মানবিক চাহিদার অনুভূতি! মিথের বিষন্ন চোখ আমাকে বলতে থাকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর চোখের অধিকারী কখনো কবি শেলী হতে পারে না। অথচ এতকাল ধরে বেগুনি-নীল চোখের অধিকারী কবি শেলীকে আমি জেনে এসেছি এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর চোখ আর মুখশ্রীর অধিকারী সুদর্শন পুরুষ! আমরা সহস্র পথ হেঁটে বেড়াতে যেয়ে আবিষ্কার করতে থাকি আমরা পরস্পরকে ছুঁয়ে পাশাপাশি থাকবার মতো শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে জন্মাইনি। আমাদের জীবনের সাথে সাথে পাশাপাশি চলার পথ আলাদা হতে থাকবার কালে আমরা নিঃসঙ্গ হতে থাকি ক্রমশ! শহরের শেষ প্রান্তের ডাস্টবিনের পাশের এক সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের চিলেকোঠায় ঘোরলাগা মানুষের মত দুলতে দুলতে সিড়ি বেয়ে উঠতে যেয়ে আমার মনে হতে থাকে এই শহরে কবিতা ভালোবাসতে শেখাটা একটা দণ্ড!

আমি জীবনের সিঁড়ি বেয়ে ক্রমশ উপরে উঠতে গিয়ে দেখতে থাকি আমার লেখা সমস্ত শব্দে কোন বিদ্রোহ নেই, বিপ্লব নেই, ঝংকার তোলা অস্ত্র নেই! উপরে উঠতে উঠতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হতে গিয়ে আমি দেখতে থাকি আমার লেখা সহস্র শব্দগুলো মূলত প্রেম কিংবা শূন্যতার মাঝামাঝি কোনো এক সেতু। যে সেতুর মাঝপথে দাঁড়িয়ে আমি একটা মহাকালের গল্প লেখার চেষ্টা করে যেতে থাকি দীর্ঘ কতগুলো রাত ধরে। হারাতে থাকা মানুষ আর শব্দের ভীড়ে নিজের মৃত্যু দেখতে গিয়ে প্রতিদিন ভোরে একই স্বপ্ন দেখার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে আমি জেগে উঠি প্রতি সকালে। আমি ভাত খাই, রান্না করি, কুচি দিয়ে শাড়ি পরে পড়াতে যাই এবং শব্দ সংক্রান্ত গুটিকয় ভাষণ দিয়ে সেমিনার ও আড্ডা থেকে ফিরে এসে হস্তমৈথুন করি। আমি প্রতিরাতে শূন্যতাদের ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে দেখি আমার হাত ভর্তি সিডেটিভের পাতা। আমি বসে থাকি টেবিলে। কল্পনা করতে থাকি এই শহরে কবি নামধারী আমি বহুরাত নির্ঘুম কাটিয়ে এক মহাকালের গল্প লিখে ফেলেছি। যেই মহাকালের গল্প পড়ে প্রেমিকের বীর্য থেকে জন্মানো সন্তান এই কোলাহলে ভালোবাসতে শিখেছে! আমি দেখতে থাকি নতুন জন্মানো সেই শিশুটি ধীরে ধীরে বড় হয়ে এক অসীম শূন্যতার গল্প পড়ে অনুভব করতে শিখেছে দুঃখবোধ আঁকড়ে ধরে মানুষ কেমন করে বেঁচে থাকে! এই পৃথিবীর নতুন সূর্যমুখী আমার মতো ছোটো ছোট চোখভর্তি পানি নিয়ে বাবাকে প্রশ্ন করা শিখেছে- “এই শব্দগুলো কেন বুক ভেদ করে যাচ্ছে, বাবা? আমাকে আপনি বলুন – এই শহরের মানুষেরা কি ভালোবাসতে ভুলে যাচ্ছে বাবা?”

টেবিলে বসে কয়েকপাতা সিডেটিভ হাতে নিয়ে আমি দেখতে থাকি আমার জরায়ু থেকে না জন্মানো এক নতুন সূর্যমুখী একটু একটু করে অনুভব করতে শিখছে কবি হতে গিয়ে আমি কেমন করে তার বাবাকে ভালোবেসেছিলাম!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *