রাজনীতির মজ্জাগত পুরুষতন্ত্র
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।। সদ্য সমাপ্ত ঢাকা সিটি নির্বাচনে মোহাম্মদপুরের একটি এলাকার কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন ডেইজী সারওয়ার। নির্বাচনে জিততে পারেননি। তিনি নিজ দলেরই আরেক প্রার্থীর সহিংসতার শিকার হয়েছেন। বলতে গেলে নির্বাচনী মাঠেই থাকতে পারেননি। অবধারিতভাবেই পরাজিত হয়েছেন।
নির্বাচনের সময়টায় যেমন, নির্বাচন পরবর্তী সময়েও তেমনভাবে তিনি আলোচনায় আছেন। তার প্রচারে ব্যবহৃত নির্বাচনী গান ও সমর্থকদের নৃত্য ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। প্যারোডি গান সবাই করেছে, কিন্তু কারও গান নিয়ে এতটা ট্রল হয়নি যতটা হয়েছে ডেইজী সারওয়ারকে নিয়ে। তিনি হেরে যাওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমে ট্রল যেন আরও বেড়েছে। ডেইজী আগেরবার নারী সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন। এবার ছিলেন সাধারণ ওয়ার্ডে পুরুষদের বিরুদ্ধে নারী প্রার্থী। এটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর জন্য। নির্বাচনে সক্রিয় থাকা রাজনৈতিক পুরুষতন্ত্রে তার এই সাহস ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে। তারাই ট্রলের উদ্যেক্তা। এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ট্রল করছেন নারীরাও। ওই নারীদের ভেতর সুপ্ত পুরুষতন্ত্র কতখানি জায়গা দখল করে আছে সেটি তারা নিজেরা অনুধাবনও হয়তো করতে পারছেন না।
অথচ নগর সরকার হোক বা সুশাসনের অঙ্গীকার হোক, যেকোন উছিলায় এই নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিল প্রার্থীদের মুখ থেকে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দের একটি ছিল নারীর ক্ষমতায়ন। টেলিভিশন টকশো, পত্রিকার সম্পাদকীয়, সামাজিক মাধ্যম বিশ্লেষণে কত কথাই না হল এ নিয়ে। ব্যাপক আলোচনা হয়েছে – কিভাবে এই শহরকে নারীবান্ধব করা যায়, নারীদের কিভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রে আরও বেশি করে আনা যায়।
নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়টা কী? খুব সহজ করে বললে, নারী-পুরুষের মধ্যে পূর্ণ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্য। আমাদের রাজনীতির দুর্বলতা ঠিক এখানেই। অভ্রান্ত নারীবাদ পুরুষের কথাও বলবে। কারণ নারী পুরুষ সবাইকে নিয়েই মানুষের সভ্যতা। কিন্তু লিঙ্গ রাজনীতি নারীকে সরিয়ে রাখতে চায় সবকিছু থেকে। নানাবিধ প্রচেষ্টায় নারীরা স্বাধীনতার দিক দিয়ে হয়তো কিছুটা এগিয়েছে। কিন্তু এটিই যথেষ্ট নয়। পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষ (সে নারী বা পুরুষ উভয়ই হতে পারে) নারীকে শুধুই প্রজননের জরায়ুযন্ত্র হিসেবে দেখছে। আর তা দেখেছে বলেই পুরুষতন্ত্র মনে করে সেই প্রজনন যন্ত্রের ওপর তার প্রভুত্বের অধিকার আছে।
ডেইজী সারওয়ারের ঘটনা আমাদের মনে প্রশ্ন জাগায় আমাদের রাজনীতিতে এমন কোনও সক্ষমতার অভাব যা নারীদের মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে কুন্ঠিত হচ্ছে? আমদের নেতা নেত্রীরা প্রায়ই বলেন, নারীরা এখন আগের চেয়ে এগিয়ে আসছে, থানায় অভিযোগ করছে বেশি। আর সে কারণেই নারী নির্যাতন ও সহিংসতার খবর বেশি করে গণমাধ্যমে আসছে। এগুলো নিখাদ রাজনৈতিক বক্তব্য। আমরা চাই নারী আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হবে এবং তারা লজ্জা রেখে, ভয়ে লুকিয়ে না থেকে প্রকাশ্যে নির্যাতনের বিচার চাইবে।
আমাদের রাজনীতি কতটা অ-রাজনীতি অন্তত: নারীর রাজনীতি ও ক্ষমতায়ন প্রশ্নে, সেটা বোঝা যায় ডেইজী সারওয়ার ইস্যুতে। কিন্তু তার চাইতেও বড় অভিযোগও আছে। পুরোটাই সঠিক রাজনৈতিক বোধের অভাব। ক্ষমতার বণ্টনই রাজনীতি। সুস্থ রাজনীতি মানুষে মানুষে ক্ষমতার সমতা আনে। খারাপ রাজনীতি বৈষম্য তৈরি করে, বৈষম্য বজায় রাখে। নারীর সক্ষমতা, নারীর আত্মবিশ্বাস কেড়ে নেওয়ার সব চাইতে সহজ উপায়ের একটি হল সামাজিক মাধ্যমে ট্রল করে সামাজিকভাবে তাকে হেয় করা। এটি প্রকারান্তরে যৌন সহিংসতা। একটিই বার্তা – তুমি অনেক কিছু করতে পার, বেশি রোজগার করতে পারো, ভোটে দাঁড়াতে পার, পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী পুরুষ ও নারী তোমাকে তা করতে দিচ্ছে বলেই করছ। এই বার্তাটি হলো পুরুষতন্ত্রের দুর্বিনীত ক্ষমতার বার্তা।
নারীর প্রতি সহিংসতার জমি তৈরি হয় এভাবেই। এই মানসিকতাই স্বচ্ছন্দে-সানন্দে নারীর দেহ এবং শ্রমের উপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।
পুরুষতন্ত্র মানসিকতার রাজনীতি কখনও স্বীকার করবেনা যে, রাষ্ট্র ও সমাজ কোন না কোনভাবে নারী নির্যাতনের অংশিদার। রাষ্ট্রের মদত না থাকলে নারীপাচার, পনহত্যা, ধর্ষণ চলতে পারে না এত ব্যাপক হারে। রাষ্ট্রের সেই মুখ বদলাতেই আমাদের নারীরা, সাম্যবাদে বিশ্বাসী পুরুষরা রাস্তায় নামে, ধর্ষণের আইন বদলাতে চায়, প্রশাসনের নিয়ম-কানুনে নারীর জায়গা করে দিয়ে বলতে চায় এই দেশ নারীদেরও। কিন্তু পুরুষতন্ত্র বারবরই চায় রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে নারীদের সক্ষমতায় আঘাত করতে।
শাসকরা ইচ্ছাকৃতভাবে, শয়তানি করে নারীদের পিছিয়ে রাখে বিষয়টা ঠিক এমন নয়। কিন্তু রাষ্ট্র ও রাজনীতির ভেতর একটা মজ্জাগত পুরুষতন্ত্র আছে যা সর্বব্যাপী।
আধুনিক সভ্যতার প্রদীপের আলোর নীচেই থাকে গভীর অন্ধকার। সেখানে এখনও নারীরা আলোর পথ খুঁজছেন। নানাকিছু ভেঙে মেয়েরা বেরিয়ে আসছে। কিন্তু এখনও বহু পুরনো মানসিকতা দানা বেঁধে রয়েছে আমাদের ভেতর। সেটাই মাঝে মাঝে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে। আসলে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো আমাদের ভাবতে শিখিয়েছে কিভাবে নারীকে দেখতে হবে। ডেইজী সারওয়ার নিজেও যে রাজনীতি করেছেন, যেভাবে করেছেন বা করছেন সেটাও সেই কাঠামোরই রাজনীতি। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে পারেননি পুরুষতন্ত্রের কারখানা থেকে। রাজনীতিতে নারীর উপস্থিতি শুধুই উপস্থিতি, তারা সেখানে দেখার বস্তু। তাই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় অশ্লীল ভাবে ট্রলের শিকার হতে হয় তাদের।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]